মাথা ব্যথার চিকিৎসা মাথা কেটে ফেলা নয়

, যুক্তিতর্ক

প্রভাষ আমিন, হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ | 2023-08-27 14:03:23

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম আগামী দুই বছরের মধ্যে ঢাকাকে রিকশাশূন্য করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। আমি তার প্রত্যয়ের সঙ্গে একমত। দুই বছরের মধ্যে হয়তো নয়, তবে আগে আর পরে ঢাকা একসময় রিকশাশূন্য হয়ে যাবে। এটাই যুগের চাহিদা, সময়ের দাবি। এখন যেমন ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়। একটা সময় হয়তো ঢাকার একটি বা দুটি রাস্তায় রিকশা চলবে। মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে গাড়ি দিয়ে রিকশা চড়তে আসবে। এটা কল্পনা নয়। একসময় ঢাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় বাহন ছিল ঘোড়ার গাড়ি। এখন শুধু গুলিস্তান থেকে সদরঘাট রুটে কয়েকটি ঘোড়ার গাড়ি চলে।

আরো কত পেশা আমাদের চোখের সামনে হারিয়ে গেছে। গুলিস্তানে একসময় ফুটপাতে স্টুডিওতে বক্স ক্যামেরায় ছবি তোলা হতো। সেগুলো তো গেছেই, বড় বড় স্টুডিও হারিয়ে যাওয়ার দশা। এক মোবাইলেই খেয়ে ফেলেছে কত কিছু। এই ঢাকায় একসময় তিন চাকার বেবি ট্যাক্সি চলত, মিশুক চলত। এখন হারিয়ে গেছে। মুড়ির টিন হিসেবে পরিচিত কিছু লক্কড়-ঝক্কড় বাস চলতো ঢাকায়, এখন সেগুলো জাদুঘরে গেলেও দেখা যাবে না। তাই রিকশাও হয়তো একসময় কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে। কিন্তু সেই সময় আসেনি এখনো, আগামী দুই বছরেও যে আসবে না, আমি নিশ্চিত। যতদিন দেশে রিকশা চালানোর মতো মানুষ থাকবে, যতদিন রিকশায় ওঠার মতো মানুষ থাকবে; ততদিন আপনি রাজধানীকে রিকশাশূন্য করতে পারবেন না। সময়ের আগে কিছু করতে চাইলে বিক্ষোভ হবে, মারামারি হবে, অবরোধ হবে, ভোগান্তি হবে।

রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে রিকশা বন্ধ হবে

ঢাকায় বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে ১১ লাখের মতো রিকশা আছে। এরমধ্যে বৈধ রিকশা আছে মাত্র ৮০ হাজারের মতো। বাকি সবই অবৈধ। ১৯৮৬ সালের পর আর রিকশার অনুমোদন দেওয়া হয়নি। তার মানে ১৯৮৬ সাল থেকেই রাজধানীকে রিকশাশূন্য করার পরিকল্পনা চলছে। কিন্তু অনুমোদন না দিলেও চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে রিকশার সংখ্যা খালি বেড়েছেই। এই যে মহাসড়কে নসিমন, করিমন, ভটভটি, রিকশাসহ সব ধরনের ধীরগতির যান চলাচল বন্ধে এত কথা বলা হচ্ছে। মহাসড়কে দুর্ঘটনার প্রধান কারণ এই ধীরগতির যান চলাচল। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। চাহিদ আছে, তাই চলছে। এখন প্রধানমন্ত্রী সকল মহাসড়কে ধীরগতির যানবাহনের জন্য আলাদা লেন নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছেন। আপাতত এটাই সমাধান। আর বাংলাদেশে প্রথানমন্ত্রীর নির্দেশ ছাড়া কিছুই হয় না। ঢাকায় রিকশা বন্ধের ব্যাপারেও এমন কোনো সমাধান লাগবে। মাথা ব্যথা বন্ধের সমাধান কখনোই মাথা কেটে ফেলা নয়।

ঢাকা শহরে কারা রিকশা চালায়? পুরান ঢাকার আদি ঢাকাইয়ারা নিশ্চয়ই নয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে-প্রান্তে থাকা অতি দরিদ্র মানুষরা একসময় প্রান্তচ্যুত হয়ে যায়। তখন তারা শেষ আশ্রয় হিসেবে ঢাকায় ছুটে আসে। নদী হয়তো কারো সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে। বন্যা হয়তো কারো ফসল ভাসিয়ে নিয়েছে। কেউ হয়তো বারবার ধান চাষ করে ফতুর হয়েছেন।

একসময় মুড়ির টিন হিসেবে পরিচিত কিছু বাস চলতো ঢাকায় / ছবি. মিশেল লরেন্ট

 

শখ করে কেউ রিকশা চালায় না। রিকশা অনেক কায়িক পরিশ্রমের কাজ। পেট চালানোর আর কোনো উপায় না থাকলেই মানুষ রিকশা চালায়। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে টাকা আয়ের যে কথা আমরা বলি, তা সবচেয়ে ভালো খাটে রিকশাওয়ালাদের ক্ষেত্রে। আমার ক্ষমতা থাকলে আমিও রিকশা চলাচল বন্ধ করে দিতাম। একজন মানুষ রিকশায় বসে থাকবে। আর তার চোখের ঠিক সামনে বসা মানুষটির শরীর ঘামে ভিজে যাবে, এই দৃশ্য অমানবিক। কিন্তু তারচেয়েও অমানবিক তাদের পেট চালানোর বিকল্প ব্যবস্থা না করে তাদের আয়ের উৎসটি বন্ধ করে দেওয়া। ঢাকায় ১১ লাখ রিকশা আছে মানে কিন্তু শুধু ১১ লাখ রিকশাচালক বা তাদের পরিবার নয়। রিকশার মালিক, রিকশার গ্যারেজ, রিকশার মেরামত, রিকশার যন্ত্রাংশ, রিকশা থেকে চাঁদাবাজি; সব মিলিয়ে রিকশাকেন্দ্রিক অর্থনীতির আকারটা বেশ বড়।

আমি জানি, ঢাকার অসহনীয় যানজটের একটা প্রধান কারণ রিকশা। তাই পর্যায়ক্রমে রিকশা তুলে দিতে হবে। তবে হুট করে নেওয়া কোনো সিদ্ধান্তই কার্যকর হয় না। ঢাকায় রিকশা বন্ধ করে দিলে রিকশাওয়ালারা গ্রামে চলে যাবে। আর তাহলে গ্রামে ধান কাটার শ্রমিক পাওয়া যাবে, এমন ভাবনা যাদের মাথায়, তাদের মানসিক সুস্থতা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। ঢাকাকে রিকশামুক্ত করতে হলে পর্যায়ক্রমে রিকশা তোলার কথা ভাবতে হবে এবং রিকশাচালকদের বিকল্প কর্মসংস্থানের কথাটিও মাথায় রাখতে হবে।

আমা‌দের হাঁটার অভ্যাস করা উ‌চিত : সাঈদ খোকন

রিকশা বন্ধ করে দিলেই তো আর রিকশাচালকরা গ্রামে ফিরে যাবে না। তারা চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই করবে। আচ্ছা রিকশাচালক বা তাদের পরিবারের কথা আপনি না হয় নাই ভাবলেন; রিকশা যাত্রীদের কথা তো আপনাকে ভাবতেই হবে। রিকশার চাহিদা আছে বলেই তো এর সংখ্যা বেড়েছে। আপনার মনে যদি ঢাকাকে রিকশাশূন্য করার আকাঙ্ক্ষা থাকেই, তাহলে আপনি এভাবে অবৈধ রিকশা বাড়তে দিলেন কেন? সরকার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তো বেবি ট্যাক্সি, মিশুক হারিয়ে গেল; তাহলে ঢাকায় ১০ লাখের বেশি অবৈধ রিকশা চলে কিভাবে? রিকশা তুলতে হলে আগে যাত্রীদের জন্য বিকল্প যান নিশ্চিত করতে হবে।

৭ জুলাই থেকে ঢাকার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কে রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাই নিয়ে এখন তুলকালাম। রিকশাচালকদের অবরোধে অচল ঢাকার একটি বড় অংশ। তার প্রভাবে যানজটে স্থবির ঢাকা। ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলছেন, রিকশার পরিবর্তে কুড়িল-বিশ্বরোডে বিআরটিসির চক্রাকার গাড়ি নামানোর চিন্তা করছি আমরা। একই ধরনের চিন্তার কথা বলছেন ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকনও। মিরপুর রোডে বাস নামানোর ভাবনার কথা জানিয়েছেন তিনিও। খুব ভালো ভাবনা। কিন্তু মাননীয় মেয়রেরা আপনাদের ভাবনাটা একটু উল্টো হতে পারত। আপনাদের উচিত ছিল আগে নির্ধারিত সড়কগুলোতে বাস নামানো। সেই বাসে এলাকাবাসীকে অভ্যস্ত করা। মানুষ যদি ভালো বাস পায়, যদি কম সময়ে, কম পয়সায় গন্তব্যে যেতে পারে; কেন তিনি রিকশায় উঠবেন। সেগুলো কিছু না ভেবে হুট করে গুরুত্বপূর্ণ সড়কে রিকশা বন্ধ করে দেওয়া সুবিবেচনাপ্রসূত নয়। আপনাদের চক্রাকার বাস নামানোর চিন্তা বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত এই এলাকার মানুষ কিভাবে চলাচল করবে?

ঢাকার রাস্তায় একসময়ের জনপ্রিয় যানবাহন বেবিটেক্সি / ছবি. জর্জ ওয়েব

 

সাঈদ খোকনের পরামর্শ মেনে অবশ্য তারা হেঁটে চলাচল করতে পারেন। আচ্ছা জনাব সাঈদ খোকন, মানুষকে হাঁটার পরামর্শ দেওয়ার আগে নিজে একটু হেঁটে দেখান। আপনার ঢাকার ফুটপাত কি হাঁটার উপযোগী? নিজে যেটা পারবেন না, করবেন না; সেটা নগরবাসীকে করতে বলার নৈতিক অধিকার কি আপনার আছে?

রিকশা বন্ধের প্রতিবাদে চালকদের রাস্তা অবরোধ

রিকশা ঢাকার যানজটের অন্যতম কারণ, কিন্তু একমাত্র তো নয়। ঢাকার কোনো ব্যস্ত সড়কের ছবি দেখলে যে কেউ মানবেন যানজটের প্রধান কারণ ছোট ছোট ব্যক্তিগত গাড়ি। তো আপনি যানজট নিরসনে রিকশা নিয়ন্ত্রণের কথা ভাবলেন, প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণের কথা ভাবলেন না কেন? একটা স্বাভাবিক শহরে ২৫ ভাগ রাস্তা থাকে। আমরা অস্বাভাবিক শহর, আমাদের আছে ৮ ভাগ। আর এই ৮ ভাগ সড়কের বেশিরভাগটাই দখল করে রাখে এইসব প্রাইভেট কার। দ্রুত এইসব প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আপনি রিকশাশূন্য শহরেও যানজট নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন না। প্রাইভেট কার কমাতে হলে গাড়ির দাম বাড়াতে হবে। প্রাইভেট কারে সিএনজি সরবরাহ বন্ধ করতে হবে। এক পরিবারে একাধিক গাড়ির ক্ষেত্রে বাড়তি ট্যাক্স আরোপ করতে হবে। দিনের বেলায় বাণ্যিজ্যিক এলাকায় গাড়ি ঢোকার জন্য বাড়তি ট্যাক্স আরোপ করতে হবে।

যানজট নিরসনে রিকশা যেমন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, ব্যক্তিগত গাড়িও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তবে সবকিছুর আগে ঢাকায় একটি সাশ্রয়ী, আরামদায়ক, সহজলভ্য পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আপনার শহরের সিএনজিচালিত থ্রি হুইলার কখনোই মিটারে যাবে না। আপনার শহরে বাসে ওঠা আর এভারেস্ট জয় সমান যুদ্ধ। আপনার শহরে বাস নিরাপদ নয়, পদে পদে ওত পেতে থাকে ইভটিজার, ছিনতাইকারী আর মলম পার্টি। আপনার শহরে সাইকেলের জন্য একটা আলাদা লেন নেই। আপনার শহরে নিরাপদ, হাঁটার মতো ফুটপাত নেই। আপনি আসছেন বিকল্প ব্যবস্থা না করে ব্যস্ত সড়কে রিকশা বন্ধ করতে।

মেয়র মহোদয়েরা মনে রাখবেন, মাথা ব্যথার সমাধান কখনোই মাথা কেটে ফেলা নয়। যানজট, নাগরিক সুবিধার বিষয়গুলো সমন্বিতভাবে ভাবতে হবে; পরিকল্পনা করতে হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর