ধানের দেশ ছেড়ে মরণ সাগরে ভাসি কেন?

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-09-01 10:31:53

এখন দেশে ধানের দাম কম, অনেকের ঘরে ভাত আছে। তবে কেন মরণপণ করে অবৈধপথে দেশান্তরী হতে চাই? কোন দু:খে, কেন চোরাই পথে এই সবুজ-শ্যামল ভূমি, সোনালি ধানের দেশ ছেড়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মরণ সাগরে ভাসি? সীমান্তে কাঁটাতার আছে, দু’দেশের পাহারাদার আছে। এয়ারপোর্টে পাসপোর্ট-ভিসা দেখে কঠিন নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করা হয়। তারপরেও ওরা অবৈধপথে সীমান্ত পার হয় কিভাবে?

তিউনিশিয়ার সাগর সীমান্তে ৬৪ জন বাংলাদেশি ক’দিন ধরে সাগরে ভাসার সংবাদ প্রসঙ্গে একজন তীর্যক স্বরে জানালেন- দেশে ভাত আছে, তবে ভালো কাজের অভাব প্রকট। যাদের কাজ আছে তাদের কষ্ট করে কাজ করার মানসিকতা নেই, তাই এদের কারো কারো সুখ-শান্তি নেই। সেজন্য পাসপোর্ট ছাড়াই পাইলট-ইমিগ্রেশন পার হয়ে বিদেশ চলে যায়। ইয়াবা সম্রাটের দেশের বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ হলেও মক্কায় ওমরাহ করতে দেখা যায়। ফেরারি রাজনৈতিক নেতাকে সীমান্তের ওপারে শিলং এর পথে ঘুড়তে দেখা যায়। আবার একজন ওসিকে দেশেই খুঁজে পেতে কষ্ট হয়। এদেরকে বিদেশে পালিয়ে যেতে দেয় কে বা কারা? নিশ্চয়ই সেটা ঘুষ-অথবা স্বজনপ্রীতি? পথে পথে অবৈধভাবে ছেড়ে দেয়ার সুযোগসন্ধানীরা সবসময় ওঁৎ পেতে আছেই। তা না হলে ধানেভরা সোনার দেশ ছেড়ে বার বার মরণ সাগরে ভেসে বিশ্বগণমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছি কোন দু:খে?

এতে কি জাতি হিসেবে আমাদের বৈশ্বিক মান-মর্যাদা কমে না? ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে যাবার সময় সাগরের ওপারে দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে ক্রিকেটের জয়ে আমরা যখন উল্লাস করছি অন্যদিকে এপারে তখন আফ্রিকার আরেকটি দেশ তিউনিশিয়ার সমুদ্র জলসীমায় মিসকিন শরণার্থী হয়ে ভেসে মৃত্যুর প্রহর গুণছি- এটা আমাদের জন্য চরম অমর্যাদাকর।

সেজন্য সীমান্তে ও বিমানবন্দরে যারা অবৈধ অর্থ লেনদেন করে ওদেরকে সীমান্ত পার করার সুযোগ করে দেয় তাদের বিরুদ্ধে এখনই কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা দরকার। কারণ, চারদিকে তাদের অনৈতিকতার চর্চা, অদৃশ্য আয় ও অবৈধ অর্থ ব্যয়ের বাহারি ফুটানি আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা ও দেউলিয়াত্বকে প্রকাশ করে। এসব দুর্নীতিবাজদের জন্য আমরা বিশ্বদরবারে কেন বার বার হেয় প্রতিপন্ন হব?

এখানে ব্যক্তিমানুষের মর্যাদা নাই আবার সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার ভয় আছে পদে পদে। তাই বড় বড় ব্যাংকার, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার সবাই ভিসার জন্য উন্নত দেশের দূতাবাসে অফিসের কাজ ফেলে লাইন দেন।

আর একটা দিক হলো- এখানে অনেকেই রাজনৈতিক লেবাস লাগিয়ে কাজে ফাঁকি দিয়ে ফুটানি দেখানোর সাহসই শুধু করেন না-অন্যের কাজ করার স্বাধীনতার ওপরও অযাচিত হস্তক্ষেপ করেন। বিশ্বের মহান রাজনৈতিক নেতারা ছিলেন ত্যাগী ও নির্লোভ। তাদের ধন-সম্পত্তি তেমন ছিল না। তারা জ্ঞান-বুদ্ধি, বিবেক দিয়ে মানুষের কল্যাণ করতেন। বিন্তু এখনকার যুগে বিশ্বের বড় ব্যবসায়ীরাই বড় দেশের রাজনৈতিক নেতা বনে গেছেন। কারণ, টাকা ছাড়া রাজনীতি করা যায় না। সংবাদমাধ্যমে জানা গেছে- বাংলাদেশেও শতকরা আশিভাগ রাজনীতিবিদ ও সাংসদ ব্যবসায়ী।

নানা কারণে দেশে ভাতের আবাদ হলেও তার সঠিক সংরক্ষণ ও সুষম বণ্টন নেই। আবাদিরা ক্ষতিগ্রস্থ ও হতাশ। একজন প্রান্তিক ধানচাষীর বার্ষিক উৎপাদন ও আয় আর একজন ছোট চাকুরীজীবীর বার্ষিক আয়ের মূল্য ও ব্যবধান অতি চরম। এই ধরনের আর্থিক ব্যবধান ও বৈষম্যের কাছে কল্যাণ অর্থনীতির সূত্র গোলমেলে হয়ে পড়েছে। এছাড়া আছে লাগামহীন দুর্নীতির সুযোগ। এছাড়া শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কাজের অভাব রয়েছে। তাইতো সবকিছু ভুলে, সবাইকে ফেলে অবৈধভাবে দেশান্তরী হয়ে মরণসাগরে ভাসতে দ্বিধা নেই!

এজন্য কেউ কেউ ভিটে-মাটি সহায় সম্বল বিক্রি করে হলেও বিদেশ যেতে চায়। বিদেশে পাড়ি জমানোর এই হিড়িক দেখে সুবিধাবাদী দালাল শ্রেণি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এদের কেউ মানব পাচার করে, কেউ পাচারে সহায়তা করে লাভবান হবার ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। এই ব্যবসা দেশের সংসদ থেকে শুরু করে গ্রামের ভাঙ্গা কুঁড়েঘর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়েছে। এজন্য একদিকে সাংসদ, অন্যদিকে ফেলানীরা অবৈধভাবে সীমান্ত পেরুনোর সুযোগ পায়। দুর্ভাগ্য হলো-মহারথীরা পার পেলেও ফেলানীদেরকে গুলি খেয়ে কাঁটাতারে ঝুলতে হয় অথবা অথৈ সাগরে ডুবে মরতে হয়!

তবে এখন কেউ আর দেশে বড় দু:খের কারণে সখিনাকে দুবাই যেতে পীড়াপীড়ি করে না। সখিনারা নিজেই সুখের আশায় দুবাইয়ে পাড়ি জমাতে চায়। কারণ, ঘরে ধান থাকলেই ধনী হওয়া যায় না, দাম না থাকায় সোনার ধান ফলানোর পরেও হতাশা-কষ্ট কুঁড়ে কুঁড়ে খায়।এর অর্থ হলো- দেশে ভাল কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষের ব্যক্তিমর্যাদার যথার্থ স্বীৃকতি ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। সামাজিক বৈষম্য কমাতে অদৃশ্য ও অবৈধ আয়ের মানুষদের সম্পদের সঠিক জরিপ করে ও তা নিরুপণ করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এরা দেশের কর প্রদান করতে গেলে ধরা পড়তে পারে তাই সঠিক পরিমাণ কর দেয় না অন্যদিকে ধর্মীয় ও নৈতিকতাবোধ না থাকায় যাকাত প্রদানেও বিরত থাকে। তাই এদের দ্বারা রাষ্ট্রের আর্থিক কোন মর্যাদা বাড়ে না, দরিদ্র মানুষের কল্যাণও হয় না।

দেশে যাদের বড় চাকরি আছে তারা কেন সেটা ছেড়ে দিয়ে একবারে বিদেশে যাবেন? দেশের একজন ব্যাংকের এজিএম কেন চাকরি ফেলে কানাডায় গিয়ে স্বল্প বেতনে আবাসিক ভবনের দারোয়ানগিরি করবেন- এ যুক্তি মাথায় আসে না। দেশে অসহনীয় যানজট, সড়ক দুর্ঘটনা ও যথাযথ চিকিৎসা সুবিধা না থাকার বিষয়টি অনেকে মেনে নিতে পারেন না। লাগামহীন দুর্নীতি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন পিছু ছাড়ছেই না।

এদিকে অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আই.ই.পি-র প্রতিবছরের মতো এবারের রিপোর্টে প্রকাশ- ২০১৮ সালে বিশ্ব শান্তি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৯২-তে থাকলেও ২০১৯ সালের জুনে এসে তা ৯ ধাপ পিছিয়ে ১০১তম হয়েছে। বিশ্ব শান্তি সূচকে এক বছরে নয়ধাপ অবনমন আমাদের দেশের জন্য ভয়ংকর অশনি সংকেত। মানুষ আসলে শান্তির আশায় হন্যে হয়ে বিদেশে ছুটে যেতে চায়। তাইতো দেশের সব মানুষের স্বাচ্ছন্দ্য ও শান্তিতে বসবাসের জন্য কর্মসূচি নিয়ে আজকেই ভাবনা শুরু করা দরকার ।

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

এ সম্পর্কিত আরও খবর