জাপায় অনলাইন নিষিদ্ধ, এরশাদ-কাদের ও কিছু কথা

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ | 2023-09-01 02:10:21

সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের চিন্তাধারা আবারও হোঁচট খেলো। খোদ জাপার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের সাম্প্রতিক কার্যক্রমে এই বাস্তবতা প্রকাশ পেয়েছে।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অনেক সমালোচনা থাকতে পারে, কিন্তু তিনি কখনও সাংবাদিকদের এড়িয়ে চলতেন না। এমনকি তিনি অনলাইন গণমাধ্যমকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। এরশাদের সেই চিরায়ত চিন্তাকে জলঞ্জলি দিয়ে কূটনৈতিকদের সম্মানে জাতীয় পার্টির ইফতারে অনলাইনকে অনেকটা অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ করে দেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জিএম কাদের।

কথিত রয়েছে শুধুমাত্র খরচ বাঁচাতে কূটনৈতিকদের সম্মানে আয়োজিত ইফতার অনলাইন নিউজ পোর্টালের সাংবাদিকদের দাওয়াত প্রদান থেকে বিরত থাকা হয়। আবার সিলেক্টিভ কিছু পত্রিকা ও টিভিতে দাওয়াত পাঠানো হয়। বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও তার কাছের নেতাদের নামে যারা সমালোচনামূলক রিপোর্ট করেন তাদেরকেও দাওয়াত প্রদান থেকে বিরত থাকা হয়।

কিন্তু জাতীয় পার্টি কিংবা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কখনই এমন ছিলেন না। তার বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারী থেকে শুরু করে সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে অনেক রিপোর্ট হয়েছে। কিন্তু এরশাদ কি কখনও সেই পথে হেঁটেছেন? ইতিহাস ঘাটলে উত্তর পাওয়া যাবে, না।

এখানে একটি ঘটনা উদাহরণ হতে পারে। ফেনী নদী লংমার্চে ফেনীতে বসেই এরশাদের সমালোচনামূলক একটি লেখা আপলোড করা হয় অনলাইনে। ফেনী সার্কিট হাউসে অবস্থানকারি এরশাদের সঙ্গে রাতে সামনাসামনি দেখা হয়ে গেলে একজন অতি উৎসাহী নেতা বলে বসেন, ‘সিরাজতো আপনার বিরুদ্ধে নিউজ করেছে স্যার। সঙ্গে সঙ্গে এরশাদ বলেন, সমালোচনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি আমি।’

এরশাদ যখন শিক্ষা গ্রহণের কথা বলছেন, তার উত্তরসূরি জিএম কাদের কি করতে চাচ্ছেন, কি বার্তা দিতে চাচ্ছেন সমালোচকদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করে! জাপার সিনিয়র নেতারা মনে করছেন এটা খারাপ উদাহরণ তৈরি হলো। এটা জাপা ও জিএম কাদেরের রাজনীতির জন্য সুখকর কিছু বয়ে আনবে না।

সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হচ্ছে অনলাইনকে আমন্ত্রণ না জানানোর কারণে। জাপা কিন্তু কখনই এমন ছিলো না। বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ অনেক আগে থেকেই অনলাইনের প্রতি ঝুঁকে ছিলেন। বরং পত্রিকার থেকেও বেশি।

কিছু ঘটনা তুলে ধরলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ২০১৩ সালে ৫ দিনের সফরে যাবেন সাতক্ষীরা। সঙ্গে শুধু অনলাইন নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, আর একটি টিভি। যুক্তি ছিলো, পত্রিকাতো অনলাইন থেকেই কপি করে। তাই অনলাইন গেলেই সব কভার হয়ে যাবে। এখানে একটি ঘটনা এরশাদকে প্রভাবিত করেছিলো বলে ধারণা করা হয়।

সেটি হচ্ছে এরশাদ একটি সাংবাদিক সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য দিয়েছিলেন। একটি অনলাইন তার বক্তব্য কিছুটা বিকৃতভাবে প্রচার করে। পরদিন দেখা যায় বেশিরভাগ পত্রিকাও বিকৃতভাবেই প্রচার করেছে। তখন পত্রিকায় ফোন করে কারণ জানতে চাইলে প্রভাবশালী ওই দৈনিকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো, তারা অনলাইন থেকে কপি করেছেন।

এরপর ২০১৪ সালের উত্তাল দিনগুলোতে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একাধিক দিনে ফোনে করে বলতেন, তোমার হাতে কাগজ কলম আছে, লিখতে পারবা। হ্যাঁ সূচক জবাব দিলে চলমান ঘটনায় প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন। এরপর বলতেন কি লিখলা পড়ো, পড়ে শোনানোর পর বলতেন, আপলোড করে দাও।

এতে কিছুটা বিড়ম্বনা তৈরি হয়। সিনিয়র অনেক সাংবাদিক তার এসব বিবৃতি খুঁজতে গেলে বলেছিলেন, প্রেস রিলিজ করা হয়নি। অনলাইন থেকে নিয়ে নাও। কেউ এটাকে অসম্মানের মনে করতেন। আরও এ রকম অসংখ্য ঘটনার উদাহরণ দেওয়া যাবে।

কিন্তু তার আপন ছোট ভাই, ভারপ্রাপ্ত হওয়ার পর প্রথম দাওয়াতে অনলাইনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। মিডিয়াকে দাওয়াত কার্ড সমেত হাজির থাকতে বললেন। যার কারণে অনেকে হাজির হলেন না।

আপনার বাসায় ঈদের দাওয়াত কাকে দেবেন, না দেবেন- এটা একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু যখন খবরের বিষয় তখন আপনি কিছু সাংবাদিকের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারেন না। এটা মিডিয়ার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বিদেশ গেলে তার সফরসঙ্গীর তালিকায় যারা রয়েছেন তারা ৪ জনেই (বিএসএস, ইউএনবি, বিডিনিউজ ও বাংলানিউজ) কিন্তু অনলাইনের।

বিশ্বে এখন অনলাইনের জয়জয়কার। অনেক বড়বড় জায়ান্ট পত্রিকা তাদের প্রিন্ট ভার্সন বন্ধ করে অনলাইনে যাচ্ছে। বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোও প্রিন্টের পাশাপাশি অনলাইনে ঝুঁকছে। আপনি নিজেই অনলাইনে পেজ খুলে নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছেন।

আপনাকে একটি বিষয়ে বলতে চাই, কোনো একদিন অনুষ্ঠানে গুনে দেখবেন। পত্রিকা, টিভি নাকি অনলাইনের সাংবাদিক আপনার বক্তব্য তুলে ধরার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে। আর কতোজন শ্রোতা আপনার বক্তব্য শোনার জন্য হাজির থাকেন। তাহলেই বুঝতে পারবেন বর্তমান সময়ের বাস্তবতা।

কোন গণমাধ্যমে জানছে আপনার বক্তব্যগুলো। কতজন মোবাইলে অনলাইনের খবর দেখছে, আর কতজন টিভিতে দেখছে। আর কতজন পরদিনে সেই সংবাদটি পত্রিকায় পড়ছে।

আর হ্যাঁ, আপনি কাউকে খাওয়াতে না চাইলে তাতে আপত্তি নেই। সাংবাদিকরা না খেয়ে সকালে ঘর থেকে বের হন না। এখানে সুপারিশ হচ্ছে প্রথমে রিপোর্ট দিয়ে দ্বিতীয় সেশনে ভূঁড়িভোজ সারতে পারবেন। তাতে কেউ আপনাকে বাঁধা দেবে বলে মনে হয় না।

আপনার বড় ভাইয়ের তৈরি করা একটি ধারা রয়েছে। জনসভা ছিলো মুন্সীগঞ্জে (২০১২ সালে)। দুপুর ২টায় জনসভা শুরুর কথা ছিলো। সিডিউল ছিলো ঢাকা থেকে গিয়ে প্রথমে সার্কিট হাউসে মধ্যাহ্নভোজ। এরপর জনসভায় যোগদান।

প্রথম ব্যাচে চেয়ার সংকটের (কিছুটা ভিড়) কারণে ৪ জন সাংবাদিক বাদ পড়ে যাই। নিজের খাওয়া শেষে সাংবাদিকদের খোঁজ নিয়ে যখন জানতে পারেন চারজনের খাওয়া হয়নি। তখন দ্রুত খাবার দিতে বলে ডাইনিং টেবিলেই বসে থাকেন এরশাদ।

কয়েক মিনিট গেলে আবার তাগাদা দেন। তখন প্রেসিডিয়াম সদস্য সালমা ইসলাম এসে বলেন, স্যার আপনি চলেন ওদের খাবার দিচ্ছে। তখন এরশাদ বলেছিলেন, ওরা খাবে তারপর আমি উঠবো। সেদিন সালমা ইসলাম বলেছিলেন, স্যার খাবার ঘাটতি পড়েছে, কয়েক মিনিট সময় লাগবে। আপনি চলেন জনসভা দেরি হলে লোকজন চলে যাবে। সেদিন আপনার ভাই বলেছিলো, তাহলে জনসভা বাতিল করে দাও। সাংবাদিকদের খাওয়া শেষ না হওয়া পর‌্যন্ত টেবিলে বসেছিলেন।

আপনি সৎ মানুষ, আপনার আর্থিক সংকট রয়েছে। মন্ত্রী থাকাকালেও অন্যদের মতো ধান্ধা-ফিকির করেননি এটা আমরাও কিছুটা অবগত। তাই কথা দিচ্ছি, আর কোনোদিন আপনার পার্টির সৌজন্যে সরবারহকৃত কোনো খাবারে আমার জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে না, তাও অন্তত নিউজ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবেন না।

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ: স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম

এ সম্পর্কিত আরও খবর