প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফর অর্থনৈতিক কূটনীতির এক মাইলফলক

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ফরিদুল আলম | 2023-08-28 17:04:01

১২ দিনের জাপান, সৌদি আরব, ফিনল্যান্ড ও ভারত সফরের প্রথম পর্যায়ে গত ২৮ মে জাপান পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর জাপান সফরের উদ্দেশ্য দেশটির টোকিওতে ফিউচার এশিয়া সামিটে যোগদান, তবে এটি এক অর্থে দ্বিপক্ষীয় সফরও বটে।

সর্বশেষ ২০১৬ সালের মে মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরের পর একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের বাংলাদেশ সফরের সময়ই দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে উল্লেখযোগ্য যে বিষয়টি ফুটে উঠে তা হচ্ছে অর্থনৈতিক কূটনীতি। এখানে মনে রাখা দরকার, বিভিন্ন সময়েই বাংলাদেশের সরকারপ্রধান দ্বিপাক্ষিক সফরে বিদেশ গমন করলেও সেসব দেশের পক্ষ থেকে ফিরতি সফর তেমনভাবে দৃশ্যমান না হলেও শেখ হাসিনার জাপান সফরের পর এত অল্প সময়ের মধ্যে জাপানের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে জাপানের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব প্রকাশ পেয়েছে একথা ভাবার অনেক সঙ্গত কারণ রয়েছে।বর্তমান বিশ্ব রাজনৈতিক অর্থনীতির বিবেচনায় যে কয়েকটি রাষ্ট্র উদার অর্থনীতি অবলম্বনের মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিসরে নিজেদের মেলে ধরতে পেরেছে জাপান নিঃসন্দেহে তাদের একটি। আর তাই জাপানের কূটনীতির মধ্যে সবকিছু ভেদ করে সবসময় যে বিষয়টি সবচেয়ে মূর্ত হয়ে উঠে তা হচ্ছে অর্থনৈতিক কূটনীতি।

প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এই বিবেচনায় যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় সফরের দ্বিতীয় দিনে ২৯ মে দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতে আড়াই বিলিয়ন ডলারের ৪০তম ওডিএ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা বাংলাদেশি টাকায় ২২ হাজার কোটি টাকার বেশি। এই চুক্তির অধীনে মাতারবাড়ি সমুদ্র বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প (১), ঢাকা মাস র‍্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (লাইন-১), বিদেশি বিনিয়োগ সহায়ক প্রকল্প (২), জ্বালানি দক্ষতা এবং সুরক্ষা সহায়ক প্রকল্প (২) এবং মাতারবাড়ি আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প (৫)-এ অর্থায়ন করা হবে।

এর মধ্যে জাপান সরকার কর্তৃক প্রথম দুটি নতুন প্রকল্পের অনুমোদন এবং চলমান অপর ৩টি প্রকল্পে নতুন করে অর্থায়নের সিদ্ধান্ত এটই প্রমাণ করে যে সামনের দিনগুলোতে দেশটি বাংলাদেশের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করে যেতে আগ্রহী।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই সফরের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী জাপান সরকারের কাছ থেকে বাংলাদেশে বসবাসরত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট সমাধানে পূর্ণ সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন। এই সংকটের শুরু থেকে জাপান এই বিষয়ে তাদের সুস্পষ্ট অবস্থান ব্যাখ্যা করতে ইতস্তত করছিল। এর আগে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ও মানবাধিকার কমিশনে বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ মিয়ানমারের নিন্দায় সোচ্চার হলেও জাপানের ভূমিকা তেমন একটা উল্লেখ করার মতো ছিল না। কেবল গত বছর জানুয়ারি মাসে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারো কোনো মিয়ানমার সফরে গিয়ে সেদেশের সরকারকে কেবল এই মর্মে স্মরণ করিয়ে দেন যে, রোহিঙ্গাদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ দেখানো ঠিক হবে না।

সাম্প্রতিক উদাহরণ টানতে গেলে বলা যায়, ভারতের সঙ্গেও জাপান বর্তমানে ব্যাপক অর্থনৈতিক সম্পর্কে উপনীত হয়েছে এবং ভারত-জাপান অর্থনৈতিক বলয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দুই দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরণের পরিবর্তনের সম্ভাবনাও ইতোমধ্যে আরও উজ্জ্বল হয়েছে। ভারত-জাপান সম্পর্কের ইতিহাস জাপানের মিজি শাসনের সময় থেকে শুরু হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে জাপানের আজকের শিল্পোন্নয়নে রয়েছে ভারতের বিশেষ ভূমিকা। মূলত ভারতের কাঁচামাল জাপানের শিল্পের প্রধান রসদ হিসেবে কাজ করেছে। তবে জাপান-ভারত ও জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নয়নে জাপানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগ লক্ষণীয়।

শিনজো আবে যখন ২০০৬ সালে প্রথমবারের মত সরকারের দায়িত্বলাভ করেন তখন থেকেই মূলত ভারত-জাপানের সম্পর্ক উন্নয়নকল্পে কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যার মধ্যে অন্যতম দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের সম্প্রসারণ, শিল্পোন্নয়ন, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে বাংলাদেশের সাথে জাপানের বর্তমান সম্পর্কের স্বরূপ বিশ্লেষণ করলেও দেখা যায় যে বাংলাদেশকেও জাপান পেতে চাচ্ছে বাণিজ্যের একটি অন্যতম অংশীদার হিসেবে।

ভারতের বিশাল জনসংখ্যাকে উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি বিবেচনা করে কেবলমাত্র পুঁজির সমস্যাকে সেদেশের উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় মনে করে ভারতে জাপানের সাম্প্রতিক ব্যাপক অর্থনৈতিক বিনিয়োগ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এখানে আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ভারতের সঙ্গে জাপানের সম্পর্কের বড় ধরনের অগ্রগতিটি কিন্তু সাধিত হয় মোদি সরকারের আমলে। এবারের নির্বাচনের মাধ্যমে মোদি সরকারের আবারও জনগণের ম্যান্ডেটলাভের মধ্য দিয়ে এমনটা আশা করা যেতে পারে যে জাপান অনানুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ এবং ভারতকে নিয়ে এশিয়ায় একটি শক্তশালী অর্থনৈতিক বলয় তৈরি করতে চায়।

এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উন্নয়ন, চীন-জাপানের মধ্যকার ঐতিহাসিক বিরোধ এবং সেই সঙ্গে বর্তমান সময়ে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যকার বাণিজ্য বিরোধে জাপান খুব কৌশলে তার অর্থনৈতিক কুটনীতিকে শাণিত করতে চাইছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ ভবিষ্যতে জাপানি বিনিয়োগকারীদের জন্য আরও সহায়ক পরিবেশ তৈরি করবে, যা সদ্য স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলোর মধ্যে বাণিজ্য সহায়ক চুক্তি থেকে পরিষ্কারভাবে অনুমান করা যায়।

ইতোমধ্যে এটি মোটামোটি স্পষ্ট হয়ে গেছে যে এতদিন চীনের সস্তা শ্রমের বাজারে জাপানি বিনিয়োগ নিবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে চীন যেহেতু নিজেদের শিল্পের সম্প্রসারণের মাধ্যমে তাদের অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে অনেক মজবুত করেছে তাই স্বাভাবিক কারণেই সেখানেও এখন জাপানের পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়ছে এবং সঙ্গত কারণেই এর প্রভাব পড়ছে জাপানের অর্থনীতিতে। সেক্ষেত্রে জাপানও এখন ধীরে ধীরে চীনের বাজার সঙ্কুচিত করে দক্ষিণ এশিয়ার দিকে ঝুঁকতে চাইছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জাপানের জন্য সবচেয়ে সুবিধার দিকটি হচ্ছে এদেশে শ্রমের বাজার ভারতের চেয়েও সস্তা। আর তাই তারা বাংলাদেশের কাছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার সুযোগ চাইছে। বাংলাদেশও এ বিষয়ে আগ্রহী। আশা করা যায়, শেখ হাসিনার এই সফরের মধ্য দিয়ে সামনের দিনগুলোতে ব্যাপকভাবে এদেশে জাপানি বিনিয়োগের সমাবেশ ঘটতে পারে।

ফরিদুল আলম: সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর