মানুষের হাতেই বিপন্ন মানুষ

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মোশারফ হোসেন | 2023-08-27 19:06:22

আমরা মানুষ, আশরাফুল মাখলুকাত- সৃষ্টির সেরা জীব। কিন্তু শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের কাজ দেখে প্রশ্ন জাগে- আমরা কি সেই মানুষ? নাকি আমরা সুরতেই মানুষ, কর্মে অন্য কিছু?

নিজের সম্পর্কে নিজের এমন মূল্যায়ন আমাকে পীড়া দিচ্ছে। আপনাকেও যদি পীড়া দিয়ে থাকে তাহলে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। কিন্তু কিছু মানুষের কর্মকাণ্ড বিবেচনা করলে আপনি নিশ্চয় আমার সঙ্গে একমত হবেন।

আজব সব জাদুকরে ভরা এই দেশ। সব সম্ভবের দেশ যেন বাংলাদেশ। তাই এদেশে আছে মৃতকে হাসপাতালের আইসিইউতে রেখে চিকিৎসার নামে মৃতের স্বজনের পকেট কাটার মত ডাক্তারি সেবা। ফলের মৌসুম শুরু না হলেও ফলের জাদুকরদের ‘ছোঁ-মন্তর’ -এর তেলেসমাতিতে মৌসুমের ঢের আগেই পেয়ে যাবেন জিবে জল আনা চোখ ধাঁধানো পাকা ফল। আমের ঋতু শুরু হয়নি, কিন্তু আপনার পাকা আম খেতে মন চেয়েছে। কোনো সমস্যা নেই। আপনি চলে যান রাজধানীর কারওয়ানবাজারের ফলের জাদুকরদের কাছে, পেয়ে যাবেন কার্বাইড আর ইথোফেন নামক হরমোনাল স্প্রে দিয়ে হলুদ বর্ণে রুপান্তরিত করা অপরিপক্ব আঁটি সমৃদ্ধ পাকা আমের ভেতর কাঁচা আম, এক আমের ভেতরে দুই আমের স্বাদ!

চাকরিজনিত কারণে আমার অবস্থান যেখানে, সেখানে প্রায় প্রতিদিনই কাঁচা কলার আড়ৎ বসে। দেখে মনে হতে পারে, সব্জি হিসেবে রান্না করে খাওয়ার জন্য এই কলার টুকরির পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু না, কার্বাইড দিয়ে এই কলাই পাকিয়ে দুই দিন পর আপনার-আমার জন্য দোকানে সাজিয়ে রাখা হবে। ক্লান্ত দুপুরে সাময়িক ক্ষুধা নিবারণের তাড়না অনুভব করে নিজের অজান্তেই দাঁড়িয়ে গেলেন কোনো এক টং দোকানের পাশে। এক প্যাকেট বিস্কুট কিংবা দুই টুকরা কেক আর এক কাপ চায়ের সাথে গোগ্রাসে খেয়ে নিলেন কার্বাইড নামক বিষ মিশ্রিত দুইটি কলা! কিন্তু কলার টসটসে হলদে রংয়ের চেহারার সাথে তাঁর স্বাদের কোনো মিল খুঁজে পেলেন না, বরং কার্বাইডের বিষ গলাধঃকরণ করার পাশাপাশি মুখের ভেতরও কেমন যেন এক ধরনের কষ্টি আর পানসে অনুভব ছড়িয়ে পড়ল- যেন মুখটাই নষ্ট হল!

স্বার্থান্ধ এইসব ব্যবসায়ীদের লোলুপ দৃষ্টিতে শুধু একটি ভাবনাই কাজ করে- ‘পৃথিবীর সব মানুষ মরে যায় যাক, সবকিছু নিপাত যায় যাক, শুধু আমি নিজে বাঁচলেই হয়।’ একইভাবে দুনিয়ার সব অর্থকড়ির মালিকও যেন একা তাকেই হতে হবে। গলা পর্যন্ত খেয়েও যেন তাদের পেট ভরে না। কিন্তু এসব খাই-খাই ব্যবসায়ীরা যে এভাবে একে অন্যের জীবন বিপন্ন করে তুলছে, সেদিকে তাদের দৃষ্টি নাই। তরতর করে বেড়ে ওঠা লাউয়ের ডগার মত রাতারাতি পয়সা কামানোর নেশায় মত্ত হয়ে আম-কলা তথা ফলমূলে কার্বাইড মেশানো ব্যবসায়ীরা ভুলে যান যে, তাকে এবং তার পরিবারকেও ফরমালিন মিশ্রিত মাছ খেতে হচ্ছে। আবার ঠিক একইভাবে এই ফরমালিন মিশ্রিত মাছ বিক্রেতাও মনে করেন যে, তার এবং তার পরিবারের কেউই কার্বাইড মিশ্রিত আম বা কলা খান না। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এসব ফল ও মাছ বিক্রেতা কর্তৃক ক্ষতিকারক রাসায়নিক মিশ্রিত খাদ্যের বিষ প্রতিদিন খেয়ে আমরা তিল তিল করে মৃত্যুবরণ করছি।

ভোজ্য তেল কিনতে দোকানে গিয়ে তীর, রুপচাঁদা, পুষ্টি ছাড়া অন্য কোনো ব্র্যান্ড আমরা খুব একটা কিনি না। অর্থাৎ ভোজ্য তেলের বড় বাজার এই কয়েকটি ব্র্যান্ডের কোম্পানির দখলেই। আমরা সাধারণ ভোক্তারাও তাদের লয়্যাল গ্রাহক। তাহলে কেন তারা আমাদেরকে ঠকাচ্ছেন? আর কতটা বড় হওয়া চাই তাদের? বড় হোন না, কে মানা করেছে। প্রাণ-আরএফএল -এর দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বিপণন সাফল্যে আমরা গর্বিত হই, আবেগতাড়িত হই। কিন্তু সেই প্রাণের পণ্যেও ভেজাল! আমরা কী খাব? কার কাছে আমরা নিরাপদ?

আমাদের নিষ্পাপ সন্তানরাও এ খাদ্যসন্ত্রাস থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ম্যাংগো জুস নামে বাজারে যে জুস পাওয়া যাচ্ছে তাতে ম্যাংগো যদি না-ই থাকে, তাহলে কোমলমতি শিশুদের আকৃষ্ট করতে কেন বলা হচ্ছে যে, এইসব আমের জুস? উপরন্তু বিজ্ঞাপন দিয়ে ফলাও করে বলা হচ্ছে, ‘আমার গাছের আম!’ শুনেছি, বাচ্চাদের অত্যন্ত জনপ্রিয় খাদ্য হরলিক্সও ঘোষিত মান প্রমাণে ব্যর্থ!

নিচে নামতে নামতে আমরা কোথায় নেমে গেছি, তা নিজেরাও জানি না। ডিসকভারি চ্যানেলে দেখি, আহত পশুর জন্য অন্য পশুদের কী মায়া, নিহত হরিণীর শাবকের জন্য হিংস্র বাঘের মাঝেও জেগে ওঠে ভালবাসা। কিন্তু মানুষের জন্য মানুষের যেন কোনো মায়াই নেই। ভূপেন হাজারিকার ‘মানুষ মানুষের জন্য’ গানটির কথা যেন আজ একটু অন্য রকম হয়েই কানে বাজে, চোখে ভাসে- ‘মানুষ মানুষ মারার জন্য’!

হাইকোর্ট ভেজাল খাদ্যের বিরুদ্ধে অবিলম্বে সরকারকে ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ করতে এবং প্রয়োজনে ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করার আহ্বান জানিয়েছেন। খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন যে, খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্সে’ সরকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও ভেজালবিরোধী অভিযান চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। মহামান্য হাইকোর্ট এবং সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এমন কঠিন মনোভাব প্রদর্শনের পরও এই খাদ্যসন্ত্রাস বন্ধ হচ্ছে না। পত্রিকা এবং টেলিভিশনের অসংখ্য সংবাদ ও প্রতিবেদনে এসব খাদ্যসন্ত্রাসের চিত্রই ফুটে উঠছে। কৃত্রিম ডিম, মাছ এবং চালের কথাও শুনছি অনেকদিন আগে থেকেই। জানি না কবে যেন এগুলোও গলাধঃকরণ করতে হয়!

অসুস্থ হলে যে ওষুধ খেয়ে সুস্থ হবেন সেই লাইফসেভার ওষুধেও ভেজাল। এভাবে প্রাণঘাতী ভেজালে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে সব খাদ্য উপাদান। খাদ্য, পানি, ওষুধ, বাতাস কোথায় নেই ভেজাল? এই প্রশ্নের কোনো উত্তরই নেই আমাদের কাছে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? এই হত্যাযজ্ঞের কোনো বিচার কি হবে না? আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম, আপনার-আমার সন্তান, আপনার-আমার মত করেই এইসব খাদ্যনামী অখাদ্যের বিষক্রিয়ায় তিল তিল করে মরে যাক, আপনি-আমি কি এটাই চাই?

ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে জল্লাদ প্রকৃতির কিছু ব্যবসায়ীকে হয়ত কয়েকদিনের জেল, সাথে কিছু টাকা জরিমানা করছে। কিন্তু প্রাণনাশের বিচার কি শুধু জেল-জরিমানাতেই শেষ? এই কারণেই দুই দিন পরেই পিশাচ প্রকৃতির এসব ব্যবসায়ীরা আবার তাঁদের স্বরূপে ফিরে আসছে। তাই বন্ধ হচ্ছে না এসব নীরব হত্যাযজ্ঞ। মানুষের হাতেই বিপন্ন মানুষ। ধর্মীয় অনুশাসন, সামাজিক বাধা, আইনের রক্তচক্ষু কিছুই যেন তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ তৈরি করতে পারছে না। তাই আমাদেরকে মরার আগেই মরতে হচ্ছে। আপনি-আমিও হয়ত অপেক্ষা করছি সেই অকাল অপমৃত্যুর জন্যই। কিন্তু কিছুটা হলেও সুখ-মৃত্যুর স্বাদ নিতে পারতাম, যদি মরার আগে জানতে পারতাম, এই মানবঘাতক মানুষগুলো ‘মানুষ’ হবে কবে?

মোশারফ হোসেন: ব্যাংকার।

এ সম্পর্কিত আরও খবর