দুর্নীতিযুক্ত উন্নয়নকে ক্রমাগত প্রশ্নবিদ্ধ রাখা চাই

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

চিররঞ্জন সরকার | 2023-08-23 03:00:18

বাংলাদেশ উন্নয়নের সড়ক ধরে এগিয়ে চলছে, একথা যেমন অস্বীকার করা যাবে না, পাশাপাশি অনিয়ম ও দুর্নীতির ক্ষেত্রেও আমরা পিছিয়ে নেই; একথাও সত্যি। দেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। কিন্তু উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতিও দৃশ্যমান। এই দুর্নীতির কারণে আমরা উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত সুফল পাচ্ছি না।

দুর্নীতি যে সব সময় প্রকাশ্যে হয়, তা নয়। অনেক দুর্নীতি হয় নিয়ম মেনে, ক্ষমতার মগডালে থাকা কিছু ব্যক্তির প্রশ্রয়ে, কঠোর গোপনীয়তায়। দুর্নীতি সব সময় আড়াল করে রাখা যায় না। কোনো না কোনোভাবে সামনে চলে আসে। সব মানুষ যেমন দুর্নীতিবাজ নয়, দুর্নীতি সবাই সইতেও পারে না। অনেকের অবশ্য দুর্নীতি করার সুযোগও নেই। যাদের সুযোগ আছে এবং যারা দুর্নীতি করে, তাদের ব্যাপারে তাই মানুষের ক্ষোভ আছে।

সম্প্রতি পাবনায় নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আসবাবপত্র কেনাকাটা এবং সেগুলোর বহন খরচ নিয়ে দুর্নীতির যে অভিযোগ উঠেছে, সেটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভের ঝড় বয়ে গেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দু’টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের বিল পরিশোধ না করতে ইতোমধ্যে নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রণালয়।

কিন্তু রূপপুরের দুর্নীতির ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে বলেই না এত হৈচৈ। যে প্রকল্পগুলোর অন্দরের খবর কেউ জানে না, সেগুলোতেও না জানি কত ‘সাগর চুরি’র ঘটনা ঘটছে! এভাবে একটি প্রকল্পের দুর্নীতির ঘটনা অন্য সব প্রকল্পকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।

আসলে আমাদের আর্থিক বিকাশ ক্রমবর্ধমান হলেও, দুর্নীতিতে আমাদের অবস্থান এখনো শোচনীয় পর্যায়েই রয়ে গেছে। যদিও দুর্নীতি বিষয়টি আজ সমাজে অনেকটাই গা-সওয়া হয়ে গেছে। অদৃশ্য বা গোপন দুর্নীতি নিয়ে সমাজের কেউ আর মাথা ঘামায় না। তবে যেসব দুর্নীতির ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, কোনোভাবে সামনে চলে আসে, সেসব নিয়ে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়। এটা সমাজের জন্য ইতিবাচক। কারণ, এক সময় দুর্নীতিমুক্ত মানুষরা সমাজে বিশেষ সম্মান নিয়ে চলত। কিন্তু এখন চিত্রটা বদলে গেছে। এখন যে কোনো উপায়ে বাড়তি রোজগার করতে না পারলে পরিবারও অখুশি হয়।

কে কীভাবে টাকা উপার্জন করল, সেটা বড় কথা নয়। কাড়ি কাড়ি টাকা উপার্জন করতে পারাটাই আসল কথা। আর্থিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে আমাদের সামষ্টিক অনাগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। বড় বড় আর্থিক দুর্নীতির ঘটনাগুলোর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের ব্যাপারে সরকারকেও খুব একটা উৎসাহী মনে হয় না।

দেশের আর্থিক খাতগুলো অনিয়ম-দুর্নীতিতে বিপর্যস্ত। শত সমালোচনার পরও এর কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। লোক দেখানো কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বটে, কিন্তু তাতে পরিস্থিতি বদলায়নি। খোল-নলচে বদলে না ফেললে কেবল এক-আধজনকে পরিবর্তন করে, দু’চারজন ব্যক্তিকে জেলে ঢুকিয়ে কোনো ফল পাওয়ার কথা নয়।

অনেকেই বলে থাকেন, উন্নয়নের সঙ্গে দুর্নীতির একটা সম্পর্ক আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, উন্নয়ন আর দুর্নীতি কি হাতে হাত ধরেই চলতে থাকবে? এর কি কোনো প্রতিষেধক নেই? একথা ঠিক যে উন্নয়নকামী দেশগুলোতে উন্নয়ন ও দুর্নীতি পাশাপাশি এগোয়, অর্থাৎ, উন্নয়নও হয়, দুর্নীতিও চলতে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে এখন চিত্রটা একেবারেই আলাদা। এখানে উন্নয়ন যতটা না হয়, দুর্নীতি হয় তার চেয়ে অনেক বেশি। তাতে করে উন্নয়নের গতিমুখটাই অনেক ক্ষেত্রে বিপথে হারিয়ে যায়।

এখানে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, উন্নয়নের গতিধারা যদি ঠিক থাকে, তাহলে কিন্তু সাধারণ মানুষ দুর্নীতি নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামায় না। যেমন ধরা যাক, একজন অতি সৎ ব্যক্তি প্রচলিত নিয়ম-কানুন-ফরমালিটিজের বাধা ডিঙিয়ে এক টাকাও ব্যয় করতে পারেন না, কাজেই এক টাকাও পকেটে পোরেন না। পক্ষান্তরে আরেকজন অসৎ কিন্তু করিৎকর্মা ব্যক্তি সব কিছু ম্যানেজ করে নিমেষেই এক হাজার টাকা খরচ করে ফেলেন এবং বিশ টাকা পকেটে পোরেন। সাধারণ মানুষ কিন্তু ওই করিৎকর্মা ব্যক্তিটিকেই বাহবা দেবেন।

পরিশেষে একটি কথাই বলব, রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাসভবনের আসবাবপত্র ক্রয় নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনাটি দেশের মানুষের মধ্যে যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে, এটা খুবই ইতিবাচক। মানুষকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে, দুর্নীতি নিয়ে হৈচৈ করতে হবে। দুর্নীতি যেন উন্নয়নকে ছাড়িয়ে না যায়, সে ব্যাপারে সবাইকেই সজাগ এবং সতর্ক থাকতে হবে। দুর্নীতিযুক্ত উন্নয়নকে ক্রমাগত প্রশ্নবিদ্ধ রাখা তাই জরুরি।

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।

এ সম্পর্কিত আরও খবর