মোদি ঝড়ে মমতার স্বপ্নভঙ্গ

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ফরিদুল আলম | 2023-08-14 06:24:29

এবারের লোকসভা নির্বাচনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বুথ ফেরত ভোটারদের নিয়ে করা সমীক্ষা কেবল সত্যই হয়নি, বরং সেই সত্যকে আরও জোড়ালো করে ২০১৪ সালের নির্বাচনের চেয়েও বেশি আসনে জয়লাভ করল বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট। সবশেষ ফলাফলে বিজেপির আসন ৩০২, যা গতবারের তুলনায় ২০টি বেশি, তাদের নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের ৩৫০ (যা গতবারের চেয়ে ১৬টি বেশি), কংগ্রেসের ৫০ (গতবারের চেয়ে ৬টি বেশি), তাদের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোটের ৯২টি (যা গতবারের চেয়ে ৩৩টি বেশি)।

সরলভাবে বললে বিজেপি এবং কংগ্রেস উভয়েই ভালো করল, কিন্তু কংগ্রেসের জন্য এটি কেবল সংখ্যাগত বিবেচনা, যা ছাপিয়ে আগামী দিনের রাজনীতির এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ দেখছে তারা। জয় নিশ্চিত হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদি জানিয়েছেন, বিজেপি এককভাবে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও তারা জোট সঙ্গীদের নিয়েই সরকার গঠন করবে।

আসলে এবারের নির্বাচনে ভারতব্যাপী সরকার গঠনের সমীকরণটি ছিল একটু ভিন্ন ধাঁচের। প্রতিটি নির্বাচনে যেখানে প্রধান দুই প্রতিপক্ষ সরকার গঠনের জন্য নির্বাচনে তোড়জোড় চালায়, এক্ষেত্রে এবারে স্পষ্ট যে ব্যতিক্রম দেখা গেল তা হচ্ছে কংগ্রেসের তরফ থেকে ভারতে সরকার গঠনের ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয়টি সেরকমভাবে দেখা যায়নি।

২০১৪ সালের নির্বাচনে শোচনীয় (৪৪টি আসন) পরাজয়ের পর গত পাঁচ বছরে কংগ্রেস সেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে তো পারেইনি, বরং নির্বাচনকে সামনে রেখে বিজেপি বিরোধীদের নিয়ে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোটকে শক্তশালী করার সেরকম চেষ্টা করতেও ব্যর্থ হয়েছেন রাহুল গান্ধী। ফলতঃ যা হবার তাই হলো, আরও টানা দ্বিতীয়বারের মত শোচনীয় পরাজয় বরণ করে নিজেদের রাজনীতিকে কঠিন করে তুলল কংগ্রেস। রাহুল আরও কঠিন করে তুললেন নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে। পারিবারিক আসন খ্যাত আমেথি থেকে পরাজিত হয়েছেন বিজেপি প্রার্থী স্মৃতি ইরানীর কাছে, যদিও কেরালার ওয়ানন্দ আসনে তিনি জয় পেয়ে নিজে পার্লামেন্টে যাবার সুযোগটুকু পেয়েছেন।

কংগ্রেস যে এবার সরকার গঠন করতে পারবে না সেটা রাহুল গান্ধীর বিভিন্ন কথাতেই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। মোদি সরকার হটানোর প্রয়োজনে তিনি জোটসঙ্গীদের নিয়ে সরকার গঠন করতে প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রী পদ ছেড়ে দিতেও প্রস্তুত বলে তার মন্তব্যে ভোটারদের মধ্যে কংগ্রেসের প্রতি আস্থাহীনতাই বেড়েছে। এর বিপরীতে ২৯ রাজ্যের মধ্যে মাত্র ১২টি রাজ্যে তারা জোটবদ্ধভাবে এবারের নির্বাচনে লড়াই করতে সক্ষম হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলোর মধ্যে উত্তরপ্রদেশ (৮০টি আসন), মহারাষ্ট্র (৪৮টি আসন), পশ্চিমবঙ্গ (৪২টি আসন), তামিলনাড়ুতে (৩৯টি আসন) তারা বিরোধীদের সঙ্গে জোট করে নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে উত্তর প্রদেশের মত গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে বহুজন সমাজবাদী পার্টির মায়াবতী এবং সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদবের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে লড়াই করার সুযোগ নিজেরাই নষ্ট করেছে।

বিগত বিধানসভা নির্বাচনে রাজস্থান এবং মধ্যপ্রদেশে এই দু’টি দলের ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করে তাদের ইউপিএ জোটে না নেবার প্রতিশোধ সরূপ তারা এবার লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। অথচ মায়াবতী এবং অখিলেশ যৌথভাবে মোদির বিরুদ্ধেই নির্বাচন করেছেন। সবচেয়ে বড় রাজ্যটিতে সফল জোট করতে কংগ্রেসের ব্যর্থতা মোদির সেখানে ব্যাপক সাফল্যের পাশাপাশি সরকার গঠনের পথকে আরও সহজ করে দিয়েছে।

এদিকে নির্বাচনের আগে রাজ্যের ৪২টি আসনের সবকটি জয় করে মোদি বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে জোট করে ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হবার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন মমতা ব্যানার্জি তার অপমৃত্যু ঘটল। এক প্রতিক্রিয়ায় বিজয়ীদের অভিনন্দন জানিয়ে পরাজিতদের উদ্দেশে সান্তনা দিয়ে বলেন, সব পরাজয়ই পরাজয় নয়।

গত নির্বাচনে যেখানে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি তৃণমূলের ৩৪টি আসনের বিপরীতে পেয়েছিল মাত্র দু’টি আসন, এবার সেখানে তৃণমূল ২৩ এবং বিজেপির ১৮টি আসনে জয়লাভ জানান দিচ্ছে যে সামনের বিধানসভা নির্বাচন মমতার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে টিকে থাকার জন্য কঠিন পরীক্ষা নিয়ে হাজির হচ্ছে। রাজ্যে বিজেপির এই উত্থান এবং সেই সঙ্গে অপরাপর রাজ্যগুলোতে আশাতীত ফলাফল অর্জনের মধ্য দিয়ে বিজেপি সত্যিকার অর্থেই একটি সর্বভারতীয় দলে পরিণত হলো।

এবারের লোকসভা নির্বাচনে মোদির সঙ্গে মমতার লড়াইটা জমেছিল বেশ। সাত দফার নির্বাচনে প্রায় প্রতিটিতেই নরেন্দ্র মোদি পশ্চিমবঙ্গ সফর করেছেন। ভোটারদের সামনে তুলে ধরেছেন মমতার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ এবং রাজ্যব্যাপী তৃণমূলের দুর্নীতির বিষয়টি। বিভিন্ন জনসভায় তিনি মমতার শাসনামলে পশ্চিমবঙ্গে সারদা, নারদা মামলাসহ উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ব্যর্থতার দিকটি তুলে ধরে নিজেকে ‘চৌকিদার’ হিসেবে উল্লেখ করে ভোটারদের উদ্দেশে বলেন, এই চৌকিদারই উপহার দিতে পারবে একটি সুখী ভারত।

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির এই অভাবনীয় উত্থানের নেপথ্যে এখন অনেকেই মমতার অহংবোধকে দায়ী করছেন। প্রচার চলাকালে তিনি বিভিন্ন সময় মোদির বিরুদ্ধে যে ভাষায় বিষোদগার করেছিলেন এবং এর বিপরীতে মোদির ধীরস্থির এবং শালীন জবাব এই নির্বাচনের ফলাফলে স্পষ্ট হয়েছে বলে অনেকের ধারণা।

তাছাড়া এই রাজ্যে মোদি নিজে এবং বিজেপি সভাপতি বিভিন্ন দফা নির্বাচনের আগে যেভাবে চষে বেড়িয়েছেন, তার যথার্থ ফলাফল পেয়েছেন বলেও ধারণা করা হচ্ছে। মোদি নিজে ১৯টি জনসভায় ভোটারদের কাছে হাজির হয়ে তার ভাষায় তার মত চৌকিদারের হাতেই ভারত সবচেয়ে নিরাপদ বলে ভোটারদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন।

গেরুয়া শিবিরে স্বাভাবিকভাবেই উল্লাস চলছে। দলের পক্ষ থেকে ২০ হাজার কর্মীকে গত সন্ধ্যায় দলের সদর দফতরে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেখানে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে জমকালো সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এছাড়াও দলের নির্বাচিত সব সাংসদদের আগামী ২৫ মে নয়াদিল্লিতে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ২৮ মে নতুন সরকার শপথ নেবে।

মোদি সরকারের গত পাঁচ বছরের দৃশ্যমান ব্যর্থতা এবং প্রধান বিরোধী দল হিসেবে কংগ্রেসের ঘুরে দাঁড়ানোর অক্ষমতা অপরাপর যেসব নেতৃবৃন্দকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবার স্বপ্ন দেখিয়েছিল তার অগ্রভাগে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। তিনি অনেকটা দৃঢ়তার সঙ্গেই ঘোষণা দিয়েছিলেন যে রাজ্যের ৪২টি আসনের সবকটি তারা দখল করে নেবেন এবারের নির্বাচনে। গতবার ৩৪টি আসন পেয়েও আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে তামিলনাড়ুর জয়ললিতার দল এআইএডিএমকে (৩৭)র পরেই নিজের দলের অবস্থান ধরে রেখেছিলেন। জয়ললিতার মৃত্যুর পর বিজেপির সঙ্গে এআইএডিএমকে’র জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করার ফলে এবং অপরাপর প্রতিদ্বন্দ্বী উত্তর প্রদেশের মায়াবতী এবং অখিলেশ যাদব এবং অন্ধ্রের চন্দ্রবাবু নাইডু আসন সংখ্যার বিচারে তৃণমূল কংগ্রেসের চেয়ে ভালো করতে পারবে না ধরে নিয়েই নির্বাচন পরবর্তী সময়ে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএসহ মোদি বিরোধী সব দলকে সঙ্গে নিয়ে সরকার গঠন করলে সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী পদের বড় দাবিদার মমতারই হবার কথা ছিল। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে বিজেপি যেভাবে নিজেদের আদর্শের সঙ্গে সমমনা দলগুলোকে ধরে রাখতে পেরেছে, বিরোধী দলগুলো মোদি বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও সমস্বরে বিজেপির বিরুদ্ধে তাদের অভিন্ন কর্মসূচি নিতে ব্যর্থ হওয়াতে আপাতদৃষ্টিতে বিগত পাঁচ বছরের অনেক ব্যর্থতা সত্ত্বেও সাফল্য গিয়ে ধরা দিল বিজেপির ঘরে।

এটা ভারতের রাজনীতির জন্য এক বড় শিক্ষা, তবে এই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে তারা সামনের দিনগুলোতে যে সঠিক পথ অবলম্বন করতে পারবে তার নিশ্চয়তা নেই, কারণ দলগুলোর ভেতর মোদি বা বিজেপি হটানোর মত বৃহত্তর কর্মসূচির চাইতে দলীয় এবং ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র স্বার্থই যে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটা এবার অনেক স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হল।

ফরিদুল আলম: সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর