বাজারে যাবেন, তেল কিনবেন? সবার আগেই মাথায় আসে তীর-পুষ্টি নামক নামকরা প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ডের এসব তেলের নাম। সামনে ঈদ, কিনতে হবে সেমাই, প্রাণ কোম্পানির সেমাই আমার চাই-ই-চাই! চিপস খাবেন? কাসেম ফুড কোম্পানির- সান চিপসের যেন জুড়ি নাই! মসলার বাজারেও প্রাণ, ফ্রেশ, ড্যানিশ ও এসিআই-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো উন্নতমানের ব্র্যান্ড ভেল্যু নিয়ে দেদারছে ব্যবসা করছে।
অথচ আমাদের মতো ভোক্তাদের বেশিরভাগই জানেন না পণ্যগুলোতে রয়েছে ভেজাল, রয়েছে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞাও। জানেন না পণ্যগুলোর উৎপাদন স্থগিত করেছে জাতীয় মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বিএসটিআই (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন)।
সম্প্রতি ২৭ ধরনের ৪০৬টি খাদ্যপণ্যের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেছে বিএসটিআই। এর মধ্যে ৩১৩টি পণ্যের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৫২টি নিম্নমানের ও ভেজাল পণ্য হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
এর প্রেক্ষিতে গত ১২ মে হাইকোর্ট পণ্যগুলো বাজার থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছেন। ১০ দিনের মধ্যে জব্দ করে ধ্বংসের জন্যও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। কিন্তু বড় পরিসরে এই নির্দেশনার প্রতিপালন নেই।
দোকানগুলোতে এখনও ঝুলছে সান চিপস। সারিবদ্ধভাবে সাজানো রয়েছে পুষ্টি-তীরের সরিষার তেল। ডানকান, সাফির মিনারেল নামক নিম্নমানের ভেজাল পানিও রয়েছে। লবণের সেলফেও রয়েছে এসিআই, মোল্লা সল্ট। প্রাণ, ফ্রেশ, ড্যানিশ ও এসিআই-এর ভেজাল প্রমাণিত হলুদ, ধনিয়া কারি গুঁড়াও রয়েছে। ক্রেতারাও কিনছেন এসব পণ্য।
না কেনারও কোনো কারণ নেই, কারণ বেশিরভাগ ক্রেতাই জানেন না, পণ্যগুলো ভেজাল ও নিম্নমানের। এসব পণ্য আদালত কর্তৃক 'নিষিদ্ধ'। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই ভেজাল ও নিম্নমানের পণ্য সম্পর্কে ক্রেতাদের জানাবে কে? এই বিষয়ে স্বল্প পরিসরে গণমাধ্যমগুলোতে সংবাদ প্রকাশ হলেও সেটা সাধারণ জনগণের কাছে কতটা পৌঁছেছে, সেটাও প্রশ্ন!
সেক্ষেত্রে এসব পণ্য বাজার থেকে সরিয়ে জনগণকে সতর্ক করতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে বিএসটিআই, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর ও সিটি করপোরেশনগুলো। প্রয়োজন গণমাধ্যমের আরও ঢালাও প্রচার। যদিও ইতোমধ্যে বিএসটিআই ৫২ পণ্যের ৯টির লাইসেন্স বাতিল করেছে। এছাড়া ৪৩ পণ্যের উৎপাদন স্থগিত করেছে। তবুও এসব পণ্যের দৌরাত্ম্যে ভাটা পড়েনি। হাইকোর্টের নির্দেশ মান্য করে বাজার থেকে প্রত্যাহারও করা হয়নি। এখনও চলছে রমরমা ব্যবসা।
সোমবার (২০ মে) মানিকগঞ্জ ও গোপালগঞ্জে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর অভিযান চালিয়ে এসিআই'র ২২৬ কেজি ভেজাল লবণ জব্দ করে ধ্বংস করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। ঢাকার সিটি করপোরেশনের ভ্রাম্যমাণ আদালতও শহরে অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু জায়গায় জরিমানা করেছে। কিন্তু এতেই থেমে যাবে না সারাদেশে এসব ভেজাল পণ্যের আগ্রাসন।
এই আগ্রাসন থামাতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি- ক্রেতাদের সামনে তুলে ধরতে হবে এসব ভেজাল পণ্যের তালিকা। এসব পণ্য বয়কটে ক্রেতাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। অন্যথায় এই প্রতিষ্ঠানগুলো এসব পণ্যের আগ্রাসন কমবে না, মানোন্নয়নে মনোনিবেশ করবে না।
সেক্ষেত্রে প্রতিটি দোকানে দোকানে ভেজাল পণ্যের তালিকা তৈরি করতে হবে। ব্যবসায়ীদের এসব পণ্য বিক্রি করতে নিরুৎসাহিত করতে হবে। সংশ্লিষ্টদের অধিকতর বাজার পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে দেশের জনগণের খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
আরেকটি লক্ষণীয় বিষয়, ভ্রাম্যমাণ আদালতগুলো দোকানে দোকানে অভিযান চালিয়ে ব্যবসায়ীদের জরিমানা করছে। এতে করে একদিকে ব্যবসায়ীরা এসব পণ্য বিক্রিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। কিন্তু দোকানিরা এই পণ্যগুলো নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ডিলারদের কাছ থেকে ক্রয় করেছে। এজন্য তারা পাইকারি দামটাও তারা নিশ্চয় পরিশোধ করেছে। এখন ওই প্রতিষ্ঠানগুলো যদি এসব ভেজাল পণ্য বাজার থেকে প্রত্যাহার না করে সেক্ষেত্রে ভ্রাম্যমাণ আদালতের জরিমানার মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা একটা দ্বিমুখী ক্ষতির মুখে পড়ছে।
তাই সংশ্লিষ্টদের উচিৎ ব্যবসায়ীদের চেয়েও প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেশি ফোর্স করা, যাতে তারা এসব পণ্য বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। এতে ভেজাল পণ্য উৎপাদনের দায়ে নামিদামি এসব প্রতিষ্ঠান লোকসান গুনলেও ছোট ব্যবসায়ীরা দ্বিমুখী ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবে। একই সঙ্গে বাজারে ভেজাল পণ্যের পরিমাণও কমবে।
এখানে আরেকটি শঙ্কাও রয়েছে। একটা ব্র্যান্ডের পণ্য যদি ভেজাল প্রমাণিত হয়, তখন দোকানে ওইসব পণ্য বিক্রির জন্য বেশি লাভের সুবিধা দেয় প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে দোকানিরাও বেশি লাভের আশায় ভেজাল সত্ত্বেও ওইসব পণ্য বিক্রি করে। এই বিষয়টিতেও সংশ্লিষ্টদের আরও সচেতন হতে হবে।
ফয়েজুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর, বার্তা২৪.কম