পাকা ধানে আগুন!

, যুক্তিতর্ক

চিররঞ্জন সরকার | 2024-01-15 20:23:03

বাংলা ভাষায় ‘পাকা ধানে মই’ দেওয়া বলে একটা কথা চালু আছে। অভিধানে এর মানে দেওয়া আছে- নিশ্চিত প্রাপ্তি বা লাভের আশা নষ্ট, সুসম্পন্ন কাজ পণ্ড। সত্যি সত্যি কেউ কারও পাকা ধানে কখনো মই দিয়েছিলেন কিনা জানা যায়নি, তবে কথাটি চালু আছে।

আমাদের দেশের মানুষ যেমন পরশ্রীকাতর ও প্রতিহিংসাপরায়ণ, তাতে সত্যি সত্যি কেউ কারোর পাকা ধানে মই দিয়ে থাকলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমাদের দেশে কৃষকদের পাকা ধান প্রায় অদৃশ্য মইয়ের খাড়ায় পড়ে। কখনো অতিবর্ষণ, কখনো ঘূর্ণিঝড়, কখনো পোকামাকড়ের তাণ্ডব কৃষকের পাকা ধানে সত্যি সত্যিই মই দিয়ে দেয়। কৃষক আর খেতের ধান ঘরে তুলতে পারেন না।

না, এবার পাকা ধানে ঠিক মই নয়, পাকা ধানে আগুনের ঘটনা নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। গত রোববার (১২ মে) দুপুরে টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী উপজেলার পাইকড়া ইউনিয়নের কৃষক আব্দুল মালেক তার পাকা ধান ক্ষেতে আগুন ধরিয়ে দেন৷ এ ঘটনার পরদিন একই জেলার বাসাইলের কাশিল গ্রামের কৃষক নজরুল ইসলাম খানও নলী বিলের বোরো ধানক্ষেতে আগুন ধরিয়ে দেন। উৎপাদনের খরচের তুলনায় ধানের দাম অত্যন্ত কম হওয়ায় তারা এমন কাণ্ড করেন।

রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে সন্তানের মত যত্ন-আত্তি করে কৃষক যে ধান ফলিয়েছে, সেই সোনার ধানে কৃষক নিজেই আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনা আমাদের দেশে নজিরবিহীন। তবে ঘটনাটিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার।

তিনি বলেছেন, ‘কৃষকের ধানক্ষেতে আগুন দেওয়ার যে ছবি মিডিয়ায় এসেছে তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সরকারকে বেকায়দা ফেলার জন্য।’

মন্ত্রীর এমন বক্তব্য কৃষকদের কাছে তো নয়ই, খোদ সরকার দলীয় সংসদ সদস্য আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনেরও পছন্দ হয়নি। তিনি নিজের ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসে খাদ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। লিখেছেন, ‘কৃষকের সঙ্গে দয়া করে মসকরা করবেন না। ক্ষমতা কি মানুষকে অন্ধত্বের দিকে ঠেলে দেয়? আমার জানা মতে, সুস্থ চোখ অন্ধ হতে সময় লাগে। কিন্তু মাত্র ৪ মাসে ধানের ভাণ্ডার নওগাঁর গাঁও-গেরাম থেকে উঠে আসা খাদ্যমন্ত্রী গাঁয়ের কৃষকদের সঙ্গে তার আত্মিক সম্পর্ক ভুলে গেলেন! অন্ধ হয়ে গেলেন এসির ঠাণ্ডা বাতাসে!’

সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন আরও লিখেছেন, ‘কৃষককে ধানের মূল্য দিতে পারবেন না, বিনয়ের সঙ্গে সম্মানিত কৃষকদের সীমাবদ্ধতার কথা অবহিত করুন। সমস্যা কোথায়? অসীম সমস্যার এই দেশে সব কিছু রাতারাতি ঠিক হবে না, একথা বিনয়ের সঙ্গে বললে মানুষ গ্রহণ করবে। একজন অসহায় কৃষকের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকেও সহ্য করতে পারবেন না? …

আগুন দিয়েছে নিজের ক্ষেতে, আপনার পাঞ্জাবিতে দেয়নি। তাতেই সহ্য হচ্ছে না! শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকারটুকুও দেবেন না কৃষককে। কৃষক বলে কি তাদের প্রতিবাদ করার অধিকার নেই! প্রজাতন্ত্রের দায়িত্বশীল পদে থেকে অসহিষ্ণু হওয়া সমীচীন নয়।

কৃষক উৎপাদন করে, ন্যায্য মূল্য পায় না। একথা অন্য রাজনীতিবিদ না জানলেও আপনার, আমার অজানা নয়। ধানের দামের খোঁজ নিন, প্রতি মুহূর্তে নিজের ম্যাকানিজম দিয়ে খবর নেন। অফিসারদের ওপর শতভাগ নির্ভরশীল থাকবেন না। দেখেন, হাটে বাজারে ধানের প্রকৃত দাম কত? আপনি এই মন্ত্রণালয়ে নতুন। কথিত আছে, এই মন্ত্রণালয়ে অধীনস্থ খাদ্য বিভাগের শুধু কর্মচারী নয়, অফিসের দেয়ালও না কি ঘুষ চায়। ভুমিমন্ত্রীর মত সচল হোন, দুর্নীতির জঞ্জাল পরিষ্কার করুন।

কৃষককে প্রতিপক্ষ ভেবে সময় নষ্ট না করে, বিনয়ের সঙ্গে কৃষককে আর কিছু দিন ধৈর্য্য ধরতে বলুন। প্রতিবেশী ভারত বা অন্য কোনো দেশে ধানের আধুনিক সাইলো বা গুদাম পরিদর্শন করুন। নিজে লেগে থেকে প্রকল্প প্রস্তুত করে একনেকে অনুমোদন করান। দেশে বড় বড় ধানের সাইলো নির্মাণ করুন। বিনা কমিশন বা ঘুষে সরাসরি কৃষকের নিকট থেকে ধান ক্রয়ের ব্যবস্থা করুন। তবেই কৃষক বাঁচবে। কৃষকরত্ন শেখ হাসিনার শ্লোগান- কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে।’

সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন এমপি যে কথাগুলো বলেছেন, এর পর আর কোনো মন্তব্য চলে না। তিনি সত্যিকার অর্থেই সমস্যার গভীরে গিয়ে সমাধানের প্রকৃত পথ বাতলেছেন। এ জন্য এমপি সাহেবকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাতে হয়। পাশাপাশি খাদ্যমন্ত্রী মহোদয়কে সবিনয়ে বলতে চাই, ধান ক্ষেতে আগুন দেওয়ার ঘটনাটি হয়তো চমক, দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা, কিন্তু সত্যিই কি কৃষকরা ধানের দাম পাচ্ছে? তাদের উৎপাদন খরচ মিটছে? বিষয়টির গভীরে গিয়ে সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজুন।

কালিহাতির আলোচিত কৃষক আব্দুল মালেক গণমাধ্যমের কাছে বলেছেন, এক বিঘা (৩৩ শতক) জমিতে ধান চাষ করতে খরচ হয় কমপক্ষে ১৪ হাজার টাকা৷ ধান পাওয়া যায় ১৫-১৬ মণ৷ ধানের মণ এখন ৫০০ সাড়ে ৫০০ টাকা৷ ফলে ১৬ হাজার টাকা খরচ করে যে ধান হয়, তার দাম কোনোভাবেই ১০ হাজার টাকার বেশি নয়৷ তাহলে আমরা পোষাবো কীভাবে?

 

ধানের কম দাম নিয়ে কৃষকের ক্ষোভ শুধু টাঙ্গাইল জেলায় নয়, এই চিত্র সারাদেশের কৃষকদের। কৃষকদের সঙ্গে কথা বললে তাদের ক্ষোভ টের পাওয়া যায়। কৃষকদের অভিযোগ, তাদের দিকে কেউ নজর দেয় না। তারা রোদ-বৃষ্টিতে পুড়ে ফসল ফলান কিন্তু তারা সুখে নেই। তারা তাদের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারছেন না। তারা তিন বেলা ভালোভাবে খেতে পারেন না। তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে সম্প্রতি এক কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায়। আর এক মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকায়। ফলে এক মণ ধান বিক্রি করে এক কেজি মাংসও কিনতে পারছেন না একজন কৃষক। অনেক কৃষক ইলিশ মাছের স্বাদ ভুলে গেছেন। একটা বড় ইলিশ এক থেকে তিন হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে যা একজন প্রান্তিক কৃষকের পক্ষে কেনা সম্ভব নয়।

ধানের মূল্য কম পাওয়ার ক্ষতি কিন্তু বহুমুখী। আমাদের দেশে প্রায় ৫৮ ভাগ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি, সেখানে এক বছরের ক্ষতিও অনেক পরিবারকে দারিদ্র্যসীমার নিচে ঠেলে দিতে পারে।

সরকারি নীতি বাস্তবায়নেও রয়েছে সীমাহীন গলদ। এবার সরকার প্রতি মণ ধানের দাম নির্ধারণ করেছে ১ হাজার ৪০ টাকা৷ প্রতি কেজি ২৬ টাকা করে৷ কিন্তু বাস্তবে বাজারে সাড়ে ৫০০ টাকার বেশিতে কোথাও ধান বিক্রি করতে পারছেন না কৃষক৷ তাতে প্রতি কেজির দাম পড়ছে ১৩ টাকা ৭৫ পয়সা৷ এটা সর্বোচ্চ দর৷ আর সরকারের হিসাবেই প্রতি কেজি ধানের উৎপাদন খরচ ২৫ টাকা ৩০ পয়সা৷ সরকারের হিসাব মেনে নিলেও প্রতি কেজি ধান উৎপাদন করে কৃষককে ১১ টাকা ৫০ পয়সারও বেশি লোকসান গুণতে হয়৷

সরকার যে ধানের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সেই দামে কৃষকের কাছ থেকে সারাদেশে খাদ্য কর্মকর্তাদের ধান কেনার কথা৷ কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সরকার যখন ধান কেনে প্রান্তিক চাষিরা তার আগেই তা বিক্রি করে দেন। ফলে সরকার নির্ধারিত মূল্যের সুফল কৃষক পান না।

কৃষকরা সরাসরি সরকারি খাদ্য গুদামে ধান বিক্রি করতেও পারেন না৷ বিক্রি করার দালাল আছে৷ তারা কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে ধান কিনে বেশি দামে সরকারি গুদামে বিক্রি করে৷ আর এই মধ্যবর্তী লাভের ভাগ নেওয়ার জন্য একটি চক্র আছে৷ এই চক্রের সঙ্গে খাদ্য গুদামের কর্মকর্তারাও জড়িত৷ একটা দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়ে কৃষকরা বঞ্চিত হচ্ছে। অথচ এর কোনো প্রতিবিধান হচ্ছে না!

এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, কৃষকের বঞ্চনার অবসান ঘটাতে হলে প্রয়োজন কৃষিব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। সরকারি উদ্যোগকে আরও বাস্তবমুখী ফলপ্রসূ করা। এ জন্য যা করা প্রয়োজন, তা হলো:

ক. কৃষকদেরকে নিয়ে উৎপাদক সমবায় এবং ভোক্তাদের নিয়ে ভোক্তা সমবায় গড়ে তোলা। দুই প্রান্তের এই দুই সমবায়ের মধ্যে সরাসরি কৃষি পণ্য বেচা-কেনার ব্যবস্থা করা।

খ. আরও বেশি খাদ্যগুদাম নির্মাণ করা।

গ. সরকারের উদ্যোগে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে কিংবা তাদের সমবায় থেকে শস্যসহ কৃষি সামগ্রী ক্রয় করা।

ঘ. রাইস মিলগুলোর মালিকানায় কৃষকের অংশীদারত্ব নিশ্চিত করা এবং কৃষক সমবায়ের উদ্যোগে রাইস মিল প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ ও সহায়তা প্রদান করা।

ঙ. সরকারের উদ্যোগে পর্যাপ্তসংখ্যক আধুনিক রাইস মিল স্থাপন করা।

চ. ধান রোপণ ও মাড়াইয়ে যন্ত্রপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে শ্রমিক নির্ভরতা কমানো।

কৃষককে চটিয়ে-ক্ষেপিয়ে কৃষকের সমস্যার সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করে কেবল ‘ষড়যন্ত্র’ খুঁজতে চাইলে এর পরিণাম শুভ হবে না। এই কথাটা সরকারের কর্তাব্যক্তিদের তা মনে রাখা দরকার!

লেখক- চিররঞ্জন সরকার, কলামিস্ট

এ সম্পর্কিত আরও খবর