সাগরে মরণযাত্রা

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ফরিদুল আলম | 2023-08-30 10:47:19

ভাগ্যান্বেষণে দেশ ছাড়লেন তারা। ইউরোপে ঢুকতে পারলেই লাখ লাখ টাকার হাতছানি– এমন স্বপ্নে বিভোর হয়ে যাত্রা পথের কণ্টককে তুচ্ছ জ্ঞান করে ছুটলেন। কেউ একা, কেউ বা পরিবার সমেত। এর মধ্যে সিলেট অঞ্চলের একই পরিবারের চারজন রয়েছেন, যারা তাদের এই মরণ যাত্রার টিকিট কেটেছিলেন প্রতিজনের জন্য আট লাখ টাকা করে, অর্থাৎ মোট ৩২ লাখ টাকায়। ১১ মের মর্মান্তিক নৌকাডুবির ঘটনায় সাগরে সলিল সমাধি ঘটেছে ৬৫ জনের, যার মধ্যে কমপক্ষে ৩৭ জন বাংলাদেশি। লিবিয়া থেকে ইতালির উদ্দেশে যাওয়া ট্রলারটি তিউনিসিয়ার উপকূলে দুর্ঘটনায় পড়ে। যদিও ১৬ জন বাংলাদেশিকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, তবে যারা বাঁচলেন, তারা কি সত্যিই বাঁচলেন? সব কিছু হারিয়ে এই বেঁচে থাকা নাকি মৃত্যু, কোনটা শ্রেয়? এই প্রশ্ন কি তাদের তাড়িয়ে বেড়াবে না?

আসলে এটি নতুন কোনো ঘটনা নয়। প্রতিনিয়তই ঘটে চলেছে এ ধরনের দুর্ঘটনা। আর এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, এমনটা ধরে নিয়েই যারা যাওয়ার তারা যাচ্ছেন। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ভূমধ্যসাগর পারি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছুতে গিয়ে প্রতি তিনজনের একজন হয় ধরা পড়েন, নয় ডুবে মরেন। জীবন আর মৃত্যুকে এভাবে দুই হাতের মধ্যে নিয়ে যারা লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারেন, আপাতদৃষ্টিতে তারা মৃত্যুকে ফাঁকি দিলেও জীবনধারণ এবং টিকে থাকার প্রতি মুহূর্তের প্রবল প্রতিবন্ধকতা আর অনিশ্চয়তা তাদের কাছে মৃত্যুর বিভীষিকা হয়ে ধরা দেয় নিয়তই।

এ ঘটনা কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না। এর আগে ২০১৫ সালের ১৯ এপ্রিল ভূমধ্যসাগরে এক ট্রলারডুবিতে নয় শতাধিক মানুষ নিহত হওয়ার মর্মান্তিক ঘটনায় ইউরোপজুড়ে আলোড়ন তৈরি হয়। রাজনীতিবিদ এবং বিশেষজ্ঞরা এই ঘটনার জন্য লিবিয়া, ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তানসহ বিভিন্নস্থানে যুদ্ধের ফলে মানবিক বিপর্যয়কে দায়ী করেন। তখন এই ব্যবস্থা রোধকল্পে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ১০ দফা কর্মপরিকল্পনা হাতে নেয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় যৌথ টহলদারী ব্যবস্থা পরিচালনা করা; বিশেষত লিবিয়াসহ ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সব পাচারকারী জলযানগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো ধ্বংস করে দেওয়া। এর জন্য বিশেষ বাজেটও বরাদ্দ রাখা হয়েছিল।

তবে যে দু’টি বিষয়কে সেসময়, এমনকি এখন পর্যন্ত ইউরোপীয় দেশগুলোর পক্ষ থেকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে তা হচ্ছে- প্রথমত, মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন এসব মানুষের দুর্দশার পেছনে তাদের করণীয়। দ্বিতীয়ত, অবৈধপন্থায় যেসব অভিবাসী রয়েছেন তারা তো কোনো না কোনো প্রক্রিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপের দেশগুলোতে বসবাস করছেন। সেক্ষেত্রে বৈধ প্রক্রিয়ায় দক্ষ জনশক্তি আনয়নের ব্যাপারে জনঅধ্যুষিত দেশগুলোর সাথে বোঝাপড়ার ব্যবস্থা এ ধরনের ব্যবস্থা রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করা হয়।

একইভাবে, যে দেশগুলো থেকে ব্যাপক হারে ইউরোপমুখী অভিবাসনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাদের অভ্যন্তরীণ নীতির শিথিলতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে যথাযথ বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের সীমাবদ্ধতা এই ক্ষেত্রে চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। অভিবাসনের ক্ষেত্রে পুশ এবং পুল – এই দু’টি বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এক্ষেত্রে কেবল বাংলাদেশকে একটি কেস হিসেবে বিবেচনা করে আলোচনা করতে গেলে আমরা দেখব যে দেশে চরম বেকারত্ব, বিশেষতঃ শিক্ষিত তরুণদের ক্ষেত্রে দেশের অভ্যন্তরে তাদের মেধার যথাযথ মূল্যায়ণ না হওয়া, সরকারি চাকরিখাত ক্রমাগতভাবে বাণিজ্যমুখী হয়ে যাওয়া, রাজনৈতিক বিবেচনা ইত্যকার বিষয়গুলো একশ্রেণির শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে হতাশা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

ফলে দেশে বেসরকারি খাতের বিকাশের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণির মানুষের চাকরির সুযোগ যতটুকু বেড়েছে, শিক্ষিত তরুণদের জন্য সেই সুযোগ তার চেয়েও বেশি সংকুচিত হয়ে গেছে। উপায়ান্তর না দেখে এদের অনেকেই জানা অজানা অনেক শংকা মাথায় নিয়ে ইউরোপের পথে পা বাড়ান। চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকা মানুষের কাছে ইউরোপ যেন এক চোখ ধাঁধানো স্বপ্নের নাম। অনেকের কাছে শুনে, কিছুটা যাচাই করে, আবার অনেকটাই যাচাই না করেই সেই স্বপ্নের আকর্ষণে দুর্নিবার ছুটে চলা এই মানুষগুলোকে যেমন কক্ষচ্যুত করে, যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে সীমাবদ্ধতা এ ধরনের প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

বাংলাদেশের জনসংখ্যার তুলনায় যদি আমরা আমাদের অভিভাসী মানুষের হিসেব করি, তবে দেখব যে সংখ্যাটি নিতান্ত কম নয়। এক কোটিরও বেশি প্রবাসী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাস করে তাদের কষ্টার্জিত আয় এদেশের স্বজনদের পাঠাচ্ছেন, যা আমাদের রেমিট্যান্সের অন্যতম খাত। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এদের একটি বড় অংশই কিন্তু বৈধ পথে নয়, অবৈধ পথে এবং বিভন্ন ফাঁক ফোঁকর খুঁজে, জীবনের মায়াকে তুচ্ছ করে তাদের আজকের অবস্থানে পৌঁছেছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোর পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যায় যে, প্রতিবছর আমাদের শ্রমশক্তি রপ্তানি কমছে, আর এই সম্ভাবনাময় খাত থেকে বিশাল আয়ের সুযোগটি আমাদের কাছ থেকে ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। ২০১৭ সালে ১০ লাখ শ্রমিক বিদেশে গেলেও সংখ্যাটি ২০১৮ সালে কমে দাঁড়ায় ৭ লাখে এবং এ বছর তা আরও কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

দুঃখের বিষয় হচ্ছে- বাংলাদেশের এই জনশক্তি প্রেরণ কেবল মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের মধ্যেই থমকে আছে। মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি প্রায় এক বছর ধরে বন্ধ এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতেও গত ছয় বছর ধরে তা বন্ধ রয়েছে। যেখানে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দক্ষ জনশক্তির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে সেখানে আমাদের শিক্ষিত তরুণদের সর্বস্ব খোয়ানোর পরিবর্তে এই অর্থের একটি অংশ দিয়ে যদি দক্ষতা বৃদ্ধির যথাযথ প্রশিক্ষণ দেশে নিশ্চিত করা যেত, তবে আমাদের সম্ভাবনাগুলোর এমন অপমৃত্যু কিছুটা হলেও ঠেকানো যেত।

ফরিদুল আলম: সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর