ফণী তো গেল, আমাদের কি কিছু শিক্ষা হলো?

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

চিররঞ্জন সরকার | 2023-08-31 22:07:14

না, আমাদের দেশে প্রাণ একেবারেই মূল্যহীন। তা না হলে দুর্বল ফণীর ঝড়বৃষ্টিতেই ১৬ জন মানুষ প্রাণ হারাবে কেন? আবহাওয়াবিদদের অঙ্ক মেনে সময়মতোই বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ঘূর্ণিঝড় ফণী৷ তবে তা অনেকটাই দুর্বল৷ ঝড়, বজ্রবৃষ্টির সঙ্গে ঘণ্টায় প্রায় ৮০ কিলোমিটার বেগে হাওয়া ছিল৷ এই সামান্য ঝড় ও বজ্রপাতে বাংলাদেশে মৃত্যু হয়েছে ১৬ জন মানুষের৷ অথচ এই ঝড়ে আমাদের দেশে হতাহতের সংখ্যা শূন্য হওয়াটাই বাঞ্ছনীয় ছিল। আপাতত ঘূর্ণিঝড় ফণী চলে গেছে। আশঙ্কা এবং ধ্বংসের দিন শেষ। তবে ফণী কিন্তু অনেক কিছু বলে দিয়ে গেছে।

ফণী চলে যাওয়ায় পরদিন সকাল থেকেই বাংলার আকাশ মেঘমুক্ত এবং ঝলমলে। আর পাঁচটা রোদেলা দিনের থেকে বেশি ঝলমলে। সেটাই স্বাভাবিক। মেঘ যখন আশঙ্কার হয়, সেই মেঘ কাটলে চারপাশ উজ্জ্বল লাগে বেশি। তবে ঝঞ্ঝামুক্ত রৌদ্রোজ্জ্বল আলোয় কিছু কালিমাও থেকে গেল যে। সেই কালিমা আমাদের কুৎসিত মানসিকতার।

প্রাকৃতিক বিপদের কথা আগাম জেনে সতর্ক হতে পারলে বড় ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আগাম বার্তা জেনে এগোনোটাই বিজ্ঞান। উন্নত দেশে সবাই কাজে বেরোনোর আগে আবহাওয়ার পূর্বাভাস জেনে নেয়। এটাও সভ্যতার মধ্যে পড়ে। শিক্ষার মধ্যে পড়ে।

এক সময় ঝড়বৃষ্টির আগাম খবর জানার উপায় আমাদের ছিল না। আকাশে মেঘ করলে তবে বোঝা যেত, আজ ছাতা নিয়ে বেরোতে হবে। চাষি ভাই ক্ষেতে দাঁড়িয়ে চোখের ওপর হাত রেখে আকাশ দেখতেন। ভ্রু কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করতেন মেঘের চেহারা কেমন হবে, বৃষ্টি হবে কতটা। কী আর করবেন। আগাম আবহাওয়া জানার উপায় ছিল না বলে একটা সময় আমাদের দেশে ঝড়ে কত যে প্রাণহানি হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। দশ–বিশ হাজার মৃত্যু কোনও ব্যাপারই ছিল না। কিন্তু এখন আমরা এই বিষয়ে অনেক উন্নতি করেছি। যে কোনও বড় দেশের সমান হয়েছি। আমাদের উপগ্রহ এখন অনেক আগে থেকে দু্র্যোগের খবর পায়। কখন ঝড় হবে, কতটা বৃষ্টি হবে বলে দিতে পারে। সেই আগাম হিসেব মোটের ওপর ঠিকও হয়। সেই অনুযায়ী সরকার এখন ব্যবস্থা নেয়। রেডিও, টিভি, নিউজ পোর্টালের মাধ্যমে মানুষ জানতে পারে। অনেক আগে সর্তক হয়। বিপদ থেকে যাতে খানিকটা রক্ষা পাওয়া যায়, তার ব্যবস্থা করে।

আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে ওড়িশার রাজ্য প্রশাসন দারুণ কাজ করেছে। ফণীর মতো ভয়ঙ্কর ঝড় সেখানে বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটাতে পারেনি। প্রায় দুইশ কিলোমিটার বেগে আছড়ে পড়া ঝড়ে সেখানে হাজার ঘরবাড়ি ধ্বংস করলেও তুলনামূলকভাবে মানুষ হতাহত হয়েছে অনেক কম। কয়েক বছর আগে এমন ঘটনা ঘটলে লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটত। আজ বিশ্বমিডিয়ায় স্থান পেত সেখানকার মৃতদেহের ছবি। এবার সেখানে তা হয়নি। এজন্য সেখানকার প্রশাসন অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য।

দুর্যোগের সতর্কবার্তাকে ছোট করে দেখা, তাচ্ছিল্য করা বোকামি ছাড়া কিছু নয়। একজন ব্যক্তিগতভাবে তা করতে পারে, প্রশাসন পারে না। প্রশাসনের সামান্য অবহেলার জন্য লক্ষ মানুষের প্রাণ চলে যেতে পারে। ওড়িশার প্রশাসন তা করেনি। করেনি পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনও। সতর্কবার্তাকে গুরুত্ব দিয়ে বহু আগে থেকেই কৃষকদের ধান কাটতে পরামর্শ দিয়েছে, সমুদ্র এবং নদীতীর থেকে মানু্ষকে সরিয়ে এনেছে নিরাপদ আশ্রয়ে, ত্রাণশিবির তৈরি করেছে, খাবার ব্যবস্থা করেছে, শহরের পথে যাতে লোক কম বেরোয় তার আবেদন রেখেছে, জীর্ণ বাড়ি থেকে মানুষ সরিয়েছে, সরকারি কর্মীদের ছুটি বাতিল করেছে, বন্যা হলে তা মোকাবিলার জন্য প্রস্তত হয়েছে।

আমাদের দেশের প্রশাসনও তেমন প্রস্তুতির কথা জানিয়েছিল। কিন্তু যখন ৮০ কিলোমিটার বেগে বয়ে যাওয়া ঝড় আর বজ্রপাতে ১৬ জন মানুষের মৃত্যু হয়, তখন প্রশাসনিক ব্যবস্থার গলদটাই বড় হয়ে দেখা দেয়। ভাগ্যিস আমরা দুর্বল ফণীর দেখা পেয়েছিলাম। তাই বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি, এটা আনন্দের। কিন্তু ঘটলে আমাদের প্রশাসন তার সঙ্গে সত্যিই কি লড়াই করতে পারত?

এবার কিন্তু মানুষ রেডিও, টিভি, সংবাদপত্র থেকেও ঝড়ের কথা জেনেছে। সর্তক হয়েছে। কেউ ভয়ে, কেউ সহজভাবে। যেভাবেই হোক, সতর্ক তো হয়েছে। তাই সংবাদমাধ্যমকেও ধন্যবাদ। যদি ঝড় নিয়ে একটু ‘বাড়াবাড়ি’ হয় ক্ষতি কী? মানুষের প্রাণের জন্য একটু কেন, আমি বেশি ‘বাড়াবাড়ি’র পক্ষে। ফণী এখানে আছড়ে পড়েনি। যদি পড়ত? তখন কি ‘বাড়াবাড়ি’ বলা হত?

তারপরও কেউ কেউ পথে বের হয়েছেন। বাজ পড়ে কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। এই মৃত্যুর দায় কার? কেবলই কি ওই মানুষগুলোর? আমরা কি তাদের যথাযথ সতর্কবার্তা দিতে পেরেছিলাম? যে কারণে মানুষ দুর্যোগের দিনে ঘর থেকে বাইরে বের হয়, সেই ‘প্রয়োজন’ মেটানোর ব্যবস্থা কি করেছিলাম? তা যদি না করা হয়, তাহলে শুধু ওই হতভাগ্য মানুষগুলোকে দোষ দেব কোন যুক্তিতে?

এবার আসি ভিন্ন একটি প্রসঙ্গে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, কিছু মানুষ ঘূর্ণিঝড় ফণী আসেনি বলে খুব দুঃখ পেয়েছে। আক্ষেপ করেছে। হায়! ঝড় ‘এনজয়’ করা হলো না! তাদের ভাবখানা এমন যে, শহরের পাকা ঘরে সারাদিন বসে অপেক্ষা করেছি। তাও গ্রামের কাঁচা বাড়িতে থাকা দরিদ্র মানুষগুলোর মৃত্যু দেখা হলো না। সকালে বন্ধুকে ফোন করে বলা হলো না— ‘জানো জানো, কাল রাত ৩টের সময় তিনতলা থেকে দেখি আমাদের বাড়ির সামনের নারকেল গাছটা পাশের বস্তির ঘরের চালে ভেঙে পড়লো। কী যে মজা!’ এদের কী বলব? গালি দেব?

ফেসবুকে এমন রসিকতাও দেখেছি, প্যারোডি গান বানানো হয়েছে, ‘সে তো এলো না, ফণী এলো না...।’ এই কিসিমের মানুষগুলো আসলে কী চাইছিল? হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু? পুরো দেশ লণ্ডভণ্ড হওয়ার দৃশ্য? ফণী এসে ক্ষেতের পর ক্ষেত নষ্ট করে দিক? গৃহহারা, সর্বস্বহারা হোক কয়েক লক্ষ মানুষ? এমন বাঁদরদের কায়কারবার দেখলে নিজের মেজাজ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। ইচ্ছে করে, ঠাস করে গালে একটা চড় কষিয়ে দিই!

শুধু কি একজন? প্রাণঘাতী দুর্যোগ নিয়ে এবার ঠাট্টা–মশকরা কম হয়নি। আর সবটাই হয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়ায়। ফেসবুকে। ছিঃ ছিঃ। রসবোধের নামে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, পরশুরাম, সুকুমার রায়, শিবরাম চক্রবর্তী, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, রজনীকান্ত সেন, মোতাহার হোসেন চৌধুরী, ড. আহমদ শরীফের উত্তরাধিকার বাঙালি এ কী নিম্নরুচির সব কথামালা আমদানি করলো! ঝড়–আতঙ্কিত গোটা দিন ধরে একটার পর একটা ‘মশকরা’ তৈরি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো হয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে এবং লজ্জা হয়, বিপদ নিয়েও আমাদের মশকরা! রাজনীতি নিয়ে, সাহিত্য নিয়ে, সিনেমা, ক্রীড়া, গান ইত্যাদি নিয়ে যা খুশি তাই হোক। যত খুশি হোক। তাই বলে ফণীর মতো বিধ্বংসী দুর্যোগ নিয়েও মশকরা!

ঘূর্ণিঝড় ফণী চলে গেলেও আশঙ্কা এবং ধ্বংসের ভয় কি শেষ হলো? একদিন ঝড় থেমে প্রকৃতি শান্ত হয়, কিন্তু মানুষ? তার কি আত্মপোলব্ধি হয়? বোধ জাগে? হয় শিক্ষা?

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।

এ সম্পর্কিত আরও খবর