নিছক একটি জঙ্গি হামলা নয়!

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ফরিদুল আলম | 2023-08-31 11:43:29

দুর্ঘটনা যে ঘটবে তা আগে থেকেই অনেকটা অনুমেয় ছিল। ঘটনার সূত্রপাত গেল বছর অক্টোবর মাস থেকে, যখন বর্তমান প্রেসিডেন্ট কর্তৃক বরখাস্ত হন প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রমাসিংহ এবং তার স্থলে নিয়োগ দেয়া হয় সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসেকে।

টানা দুই মাসের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কেবল শ্রীলঙ্কার শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদদের ঘুম হারাম করেনি, এর সাথে স্বার্থসংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে চলতে থাকে নিজ নিজ প্রভাব অন্বেষণের লড়াই, যার বলি হতে হল কয়েকশ মানুষকে।

২০০৯ সালে জাতিগত দাঙ্গা অবসানের পর দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে সেসময় থেকে অভ্যন্তরীণ পুনর্গঠন এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অতিমাত্রায় চীন নির্ভরতা দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয় ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রকে। বর্তমান সময়ের ভারত-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নিরিখে চীনের এই প্রভাব এই উভয় দেশের জন্য একটি অভিন্ন দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এদিকে আফগানিস্তানকে বশে আনার স্বার্থে পাকিস্তানকে একসময় বিপুল সাহায্য দিয়ে আসলেও, দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টিলেজেন্সের (আইএসআই) ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসী দল এবং সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষকতা ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সম্পর্কোন্নয়নের অন্যতম ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। ফলতঃ চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হতে থাকে।

ভারতের মূল দুশ্চিন্তা ব্যাপক আর্থিক দুরবস্থা এবং বৈদেশিক দেনায় পর্যুদস্ত হয়ে শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর ৯৯ বছরের জন্য চীনের কাছে ইজারা দেবার ফলে ভারত মহাসাগরের এই দ্বীপরাষ্ট্রটিতে প্রচ্ছন্নভাবে চীনের প্রভাব বেড়ে যাওয়া। কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্বে ভারতের ঠিকমত পেরে না ওঠার পেছনেও রয়েছে চীনের সমর্থন। কথিত আছে যে পাকিস্তানের সামরিক বাজেট তথা আইএসআই’র অর্থের অন্যতম উৎস চীন। আর এর মাধ্যমেই তারা তাদের স্বার্থে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে পেলেপুষে রাখছে। এমন অবস্থায় শ্রীলংকায় চীনের নিরবচ্ছিন্ন স্বার্থরক্ষার প্রয়োজনে সম্ভাব্য সকল হুমকি মোকাবিলায় চেষ্টার কোনো বিকল্প নেই।

গত ২১ এপ্রিল কলম্বোয় জঙ্গি হামলা নিয়ে ব্যাপক যে বিশ্লেষণ চলছে এর সারমর্ম হচ্ছে বৈশ্বিক জঙ্গি এবং সন্ত্রাসবাদ। অনেকে ক্রাইস্টচার্চ হামলার মাত্র ৩৫ দিনের মাথায় এই হামলাকে উগ্রপন্থী ইসলামী শক্তির পক্ষ থেকে একধরনের প্রতিশোধপরায়ণতা হিসেবে দেখছেন। হামলার পরদিনই শ্রীলঙ্কার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী তো বলেই ফেললেন যে ক্রাইস্টচার্চ হামলার প্রতিশোধ নিতেই এই হামলা চালানো হয়েছে, যদিও পরবর্তীতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী এই বক্তব্যকে সমর্থন করেননি।

বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী হামলার যে ধরণটি আমরা বর্তমান সময়ে প্রত্যক্ষ করি তা হচ্ছে এই হামলার পেছনে কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সুনির্দিষ্ট কোনো উদ্দেশ্য থাকলে তারা হামলা চালানোর পরপরই এর দায় স্বীকার করে। এটা তাদের দিক থেকে একধরণের সফলতা হিসেবে প্রচার করার একটা প্রয়াস।

এক্ষেত্রে কলম্বোতে যে হোটেল এবং গির্জাগুলোতে একযোগে হামলা চালানো হল এই বিষয়ে হামলার পর এধরনের কোনো দায় স্বীকার করতে দেখা গেল না। দেশটির পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই হামলায় ন্যাশনাল তৌহিদী জামাত বা এনটিজি নামক একটি অখ্যাত ইসলামী সংস্থাকে দায়ী করার দুইদিনের মাথায় আইএস দাবি করে তাদের মদদপুষ্ট এই সংস্থা এই হামলা চালিয়েছে, অর্থাৎ এই হামলা তাদের নির্দেশনায় হয়েছে।

দেশটির পুলিশ প্রধান দাবি করছেন যে, এমন একটি হামলা হতে পারে তা তিনি আগেই গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে জানিয়েছিলেন। জানা যায় যে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা এমন হামলার বিষয়ে সেদেশের পুলিশ প্রশাসনকে আগাম তথ্য দিয়েছিল। তার কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে সরকারের তরফ থেকে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হলে হয়ত এই হামলা ঠেকানো যেত।

অথচ হামলার ৫ দিনের মধ্যে দেশটির প্রেসিডেন্ট প্রতিরক্ষা সচিব এবং পুলিশ প্রধানকে পদত্যাগ করতে নির্দেশনা পাঠান। এই নির্দেশনা মেনে প্রতিরক্ষা সচিব পদত্যাগ করলেও পুলিশ প্রধান তার পদ ছাড়েননি। এক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কার সংবিধানে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য যে রক্ষাকবচ রয়েছে তা হচ্ছে কোনো কর্মকর্তাকে তার পদ থেকে সরাতে হলে সংসদের মাধ্যমে একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। পুলিশ প্রধান প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রমাসিংহ কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত এবং তিনি নিশ্চয়ই এক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বেশি আস্থাশীল।

তবে প্রশ্ন হচ্ছে কেন আগাম সতর্কতার পরও যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হল না এই মুহূর্তে এর কারণ হিসেবে সেদেশের রাজনৈতিক টানাপড়েনকে বড় কারণ হিসেবে দেখা যেতে পারে। আমরা জানি দেশটির বর্তমান সরকার এখন দুইভাগে বিভক্ত। একদিকে রয়েছেন চীনপন্থী প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা, অপরদিকে প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রমাসিংহে, যিনি ভারতপন্থী হিসেবে পরিচিত। মাত্র কিছুদিন আগে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় প্রেসিডেন্ট এবং তাঁর কিছু ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের হত্যার ছক তৈরি করা হচ্ছে এমন অভিযোগে রানিল বিক্রমাসিংহকে প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসেকে তার স্থলে নিয়োগ দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা। অনেক রাজনৈতিক ঘাত প্রতিঘাতে অবশেষে সংসদে এই নিয়োগের বৈধতা পাননি সিরিসেনা। আবারও পুনর্বহাল করতে বাধ্য হন বিক্রমাসিংহকে।

এখন প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে যখন একটি জঙ্গি বা সন্ত্রাসী হামলা পরিচালিত হয় তখন হামলাকারীদের কিছু উদ্দেশ্য সাধনের বিষয় থাকে, শ্রীলংকার এই হামলার পেছনে হামলাকারীদের সুনির্দিষ্ট কি উদ্দেশ্য কাজ করেছিল? যদ্দুর জানা যায় কোনো সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য এতে ছিল না; বরং সেখানে দীর্ঘদিন ধরেই সকল ধর্মের মানুষ শান্তিতে সহবস্থান করে আসছিল।

দেশটির উত্তরাঞ্চলে তামিল বিদ্রোহীদের সাথে সরকারের যুদ্ধ চলেছে ২৬ বছর। উল্লেখ্য যে তামিলদের মধ্যে যারা মুসলিম রয়েছেন তারা কিন্তু অপরাপর তামিলদের মত একটি স্বাধীন তামিল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিকে সমর্থন করেননি; বরং তাদের মনে হয়েছিল এতে করে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ সিহংলী সরকারের শাসন থেকে হিন্দুত্ববাদী শাসনে পরিণত হবে। এমন উদ্দেশ্য সাধনের মাধ্যমে মুসলমানদের জন্য কিছুই অর্জিত হবে না। আর তাছাড়া গোটা শ্রীলংকায় মুসলমানরা বলতে গেলে সবচেয়ে সংখ্যালঘু, তারা মোট জনসংখ্যার ৬-৭ শতাংশ।

রাজাপাকসে সরকারের তামিলদের আন্দোলন চিরতরে দমনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা হওয়ার পেছনে সেখানে বসবাসরত মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি তাকে যথেষ্ট সহায়তা করেছিল। আর সেজন্যই গৃহযুদ্ধ অবসানে পাকিস্তান এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

২০০৮ সালে সে সময়কার শ্রীলঙ্কান সেনাপ্রধান শরত ফনসেকা পাকিস্তান সফর করলে পাকিস্তান থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ক্রয়ের চুক্তি করে শ্রীলঙ্কা। সেই সাথে এসব ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ পাকিস্তানের বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষিত পাইলটরা পর্যন্ত তামিল বিরোধী যুদ্ধে অংশ নেয়, যার মাধ্যমে সরকার তার অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছায়, গৃহযুদ্ধ মুক্ত হয় শ্রীলঙ্কা। এই যুক্তি মানলে অনেকের কাছে এটাই মনে হতে পারে যে তাহলে তো মুসলমানরাই উল্টো হামলার শিকার হবার কথা!

আমরা জানি পাকিস্তানের আইএসআই’কে একটি বিতর্কিত সংগঠন হিসেবেই চেনেন অনেকে আর এর মূল কারণ হচ্ছে দেশের ভেতর সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে পেলেপুষে রাখা ছাড়াও নিজস্ব ভূসীমানার বাইরে পাকিস্তানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়, বিশেষত সন্ত্রাস রফতানিতে এটি সুচতরভাবে কাজ করে। গৃহযুদ্ধ অবসানের পর এই আইএসআই শ্রীলঙ্কার প্রত্যন্ত অঞ্চলে মুসলমানদের মধ্যে ছড়িয়ে তাদের সংগঠিত করতে কাজ করতে থাকে। এরই ফলশ্রুতিতে জাফরান হাশিমীর মত গঠন করা হয় এনটিজে নামক সংগঠন।

এ কথা সবাই জানেন এবং মানেন যে এমন একটি ছোট এবং অসংগঠিত সংগঠনের পক্ষে এত কম সময়ের মধ্যে এধরণের ভয়াবহ হামলা পরিচালনা করা সম্ভব না, অর্থাৎ এখানে আন্তর্জাতিক চক্রের ইন্ধন রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে আগাম সতর্কতার পরও কেন ব্যবস্থা নেয়া হল না? এর একটা কারণ হতে পারে পুলিশ প্রধান গোয়েন্দাদের জানিয়েছিলেন এমনটা, কিন্তু তারা সরাসরি প্রেসিডেন্টের অধীন।

শ্রীলঙ্কার আইন অনুযায়ী দেশটির অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব প্রেসিডেন্টের কাছে। তিনি যদি না চান তাহলে এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টরা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেন না। তাহলে কি এই দাঁড়ায় না যে প্রেসিডেন্ট ইচ্ছাকৃতভাবে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক নিয়োগকৃত পুলিশ প্রধানকে অসহযোগিতা করে এর দায়টি বিক্রমাহিংহে সরকারের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছেন।

এখানে এখন পর্যন্ত এই নিয়ে চুপ করে থাকা চীনের ভূমিকা কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে রয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা আইএস-কে এই ঘটনার সাথে জড়িত মর্মে স্বীকারোক্তি দিতে শুনলাম। কি স্বার্থ রয়েছে আইএস-এর। বর্তমান সময়ে সংগঠনটির কার্যক্রম ছাড়াও অতীতের বেশ কিছু ঘটনা এমনকি বাংলাদেশে হোলি আর্টিজানসহ কিছু ঘটনায় আইএস-এর সংশ্লিষ্টটা দেখলে বুঝতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে এরা আসলে ভাড়ায় খাটা একটি সংগঠন, যারা দেশীয় কিছু এজেন্টের সহায়তায় আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এসব হামলাগুলো পরিচালনা করে।

এই নেটওয়ার্কগুলো কিন্তু এত দুর্বল নয়। এখানে চীনের মতো রাষ্ট্র যদি অর্থ সহায়তা দিয়ে থাকে কিংবা ইসরাইলের মোসাদের মত গোয়েন্দা সংস্থা যদি টেকনিক্যাল সহায়তা দিয়ে থাকে তবে বুঝতে হবে এর পেছনে সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে, যা অনেকের কাছেই দৃশ্যমান।

গত ৭০ বছর ধরে ফিলিস্তিনের মুসলমানরা নিজভূমে পরবাসের মত জীবন যাপন করছে। চীনের উইঘুরে ২০ লক্ষ মুসলমানকে আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। আইএস যদি এদের প্রভাবমুক্ত হয়ে সত্যিকারের নির্দিষ্ট আদর্শভিত্তিক সংগঠন হত তাহলে এই দুটো দেশে সবার আগে হামলা পরিচালনা করা হত। আসলে আইএস-কে ভাড়ায় খাটিয়ে কারা কোন উদ্দেশ্যে কী ধরনের হামলা পরিচালনা করছে সেটাই এখন মূল ভাবনার বিষয়।

ফরিদুল আলম: সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর