ওয়াসার পানি, শরবত ও দায়িত্বশীলদের কথা

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

চিররঞ্জন সরকার | 2023-08-25 06:26:02

দায়িত্বশীল পদে থাকলে মানুষ দায়িত্বশীল আচরণ করবেন, দায়িত্বশীল কথা বলবেন, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু আমাদের দেশে সচরাচর তা দেখা যায় না। এখানে যে যত গুরুত্বপূর্ণ বা দায়িত্বশীল পদে থাকেন, তার মুখে কথার খই ফোটে তত বেশি। এই বেশি কথা বলার প্রবণতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমস্যা ও বিতর্ক সৃষ্টি করে। বুদ্ধি-বিবেচনাহীন স্থূল সব মন্তব্য করে তারা নিজেরাও হাসির খোরাক হন। সম্প্রতি লাগামহীন সব মন্তব্য করে আলোচিত হয়েছেন ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান।

তিনি দাবি করেন, ‘ওয়াসার পানি শতভাগ সুপেয়।’ তার এমন মন্তব্যে সঙ্গত কারণেই নাগরিকরা ক্ষুব্ধ হন। কারণ রাজধানীবাসী প্রতিদিনের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন যে, ওয়াসার পানি মোটেও সুপেয় নয়। বরং যুগ যুগ ধরে ময়লা ও দূষিত পানি নিয়েই নিরুপায় নগরবাসী ‘সন্তুষ্ট’ রয়েছেন। কিন্তু তার এই ‘সুপেয়’ পানির ‘বিজ্ঞাপনে’ রাজধানীর কয়েকজন ‘রসিক’ নাগরিক এক জগ পানি, চিনি আর লেবু নিয়ে যান, তাকে এই ‘সুপেয় পানি’ দিয়ে বানানো শরবত খাওয়াতে। যদিও সেদিন তিনি অফিসে ছিলেন না!

এমন ঘটনায় গণমাধ্যমে সাড়া পড়ে যায়। সাংবাদিকরা তাকে টেলিফোনে শরবত খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘আমি কোনটা খাব, না-খাব; সেটা তো আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।’ পানি ‘শতভাগ বিশুদ্ধ’ বলে দাবি করলেও সেটা দিয়ে অন্যের বানানো শরবত খেতে আপত্তি আছে বলে জানান তিনি।

উল্লেখ্য, টিআইবির এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ওয়াসার নিম্নমানের পানির কারণে সেবাগ্রহীতাদের ৯১ শতাংশ ফুটিয়ে পানি পান করেন। এতে প্রতিবছর অন্তত ৩৩২ কোটি টাকার গ্যাস অপচয় হয়।

টিআইবির প্রতিবেদনের বিরোধিতা করে তাকসিম এ খান এক সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে বলেন, ‘আমাদের পানি ১০০ ভাগ সুপেয়। কাজেই আপনি গ্যাস পোড়াচ্ছেন, এটা তো আমার কাছে আশ্চর্য কথা।’

কথিত আছে ময়মনসিংহ অঞ্চলের এক নেতা একবার বক্তৃতায় আবেগের আতিশয্যে বলেছিলেন, ‘ত্রিশ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরাস্বাধীনতা অর্জন করেছি’। এরপর একজন তার কথা সংশোধন করে কানেকানে বলেছিলেন, ‘ত্রিশ লক্ষ নয়, বলেন তিন লক্ষ।’ কিন্তু ওই নেতামাইকের সামনেই বলেন, ‘যা কইছি কইছি। এর কোনো নড়চড় হবে না।’ এখন ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানও ‘যা কইছিকইছি’র মর্যাদা রাখতে একের পর এক কাণ্ডজ্ঞানহীন মন্তব্য করেই যাচ্ছেন! কথার বুলেট ছুড়েই যাচ্ছেন!

কথা বড় মারাত্মক জিনিস। কবি লিখেছেন: ‘মধুবাবুর কথার বিষে, পাড়ার লোকে হারায় দিশে’—অর্থাৎ কথায় সত্যি বিষ আছে। নাম ‘মধু’ বাবু হলে কি হবে, কথার জ্বালায় সবাইকে অতিষ্ঠ করতে পারেন তিনি।কথায় কী হয়? এ কথার জবাবটা বোধহয় সহজ নয়। কথায় অনেক কিছু হয়। হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। মূল ব্যাপার হলো—কোন কথা, কেমন কথা, কে বলছেন, কাকে বলছেন! ভাবুকরা বলে থাকেন, ‘কথাশতধারায় বয়’।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিখ্যাত একটি কবিতা আছে—‘কেউ কথা রাখেনি’।‘তেত্রিশ বছর কাটল কেউ কথা রাখেনি’। এটা হলো কবিতারপ্রথম লাইন। আর কবিতার শেষে আছে, মোক্ষম কথাটা, ‘কেউ কথা রাখেনা’! কবিতাটিতে বেশ কতক কথা-না-রাখার ছোট-ছোট গল্প বলেছেন কবি। বলেছেন অসাধারণ চিত্রকল্প সহযোগে। বৈষ্ণবী, নাদের আলি, বরুণা- কথা প্রত্যেকেই দিয়েছিল, কেউই কথা রাখেনি। মানুষের জীবনকি তা হলে এইরকমই কথা-না-রাখার পঞ্জিকা? এমনই নৈরাশ্যজনকঅস্তিত্ব?

তা হলে, সেই কবিতা, এমন নেতিবাচক কবিতা যুগযুগান্ত ধরে এমনপ্রসিদ্ধ হয় কী করে? আসলে এ কবিতা বলতে চায়, মানুষের কথা রাখা উচিত, তাই কথা রাখার ব্যাপারে এক আশ্চর্য আকুলতা সৃষ্টি করে কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এ কবিতা। কবিতাটা নেগেটিভ, নট ফর নেগেটিভ। নেগেটিভ ফর পজিটিভ।

অপর এক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন অন্য কথা। বলেছিলেন, ‘আগে কথায় কাজ হত।’ কথাটার মানে হলো, আগে মানেআগেকারকালে। আর এখন কথা হয়, কাজ হয় না।

আগেকারকালে কথা রাখার জবরদস্ত রেওয়াজ ছিল বলেই না রামায়ণসৃষ্টি হয়েছিল! রানী কৈকেয়ীকে দেয়া কথা যদি রাজা দশরথ না রাখতেন, তা হলে রামায়ণ কি সত্যি সত্যিই সৃষ্টি হতে পারত?

কথা শব্দটির নানান মানে| সুনীলের কবিতায় কথা মানে প্রতিশ্রুতি| কিন্তুসুভাষের বাক্যে কথা মানে বাণী। বা কথা মানে সত্যকথা বা কথা মানেমানুষের সুচেতনার অভিব্যক্তি। কথার আরো নানা অর্থ হতে পারে, হয়।কথা বলতে অনেক সময় আখ্যান বা জীবন-আখ্যান বোঝায়।কথাসাহিত্য শব্দজোটে কথা বলতে গল্প বা আখ্যান বোঝায়। ফেরধর্মকথা বলতে আমরা যেমন ধর্মের কাহিনী বুঝি, ধর্মের উপদেশও বুঝি, ফের আধ্যাত্মিক আদর্শও বুঝি| কিন্তু যখন আমরা বলি মুখের কথা, তখনকখনো কখনো আমরা মুখের বাক্যকে তুচ্ছ করি।

আমাদের দেশে দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আসল কথা না বলে ফালতু কথা বলেন। অনেক সময় অসত্যও বলেন। এ নিয়ে তাদেরমধ্যে কোন খেদ বা অনুশোচনা কখনো দেখা যায় না। ফলে কথা পরিণতহচ্ছে কথার কথায়। যা রাখা না রাখার কোন দায় নেই। কি নিজের কাছে, কী অন্যের কাছে।

বেশি কথা বললেও কিন্তু সমস্যা হয় না, যদি সেটা কাজের কথা হয়।আবার অকাজের কথা বা বাজে কথা কম বললেও তা অনেকের কাছেসহনীয় মনে হয় না। কেউ কেউ আবার কিছু না বলেও অনেক কথা বলেযান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমনটি বলেছেন, ‘অনেক কথা যাও গো বলিকোনো কথা না বলি।’ একদিক থেকে দেখলে আসলে কথাই মানুষকেবাঁচিয়ে রাখে। সুখের কথা যদি আমরা কাউকে না বলি সে সুখের মূল্য কি? আবার যখন দুঃখ আসে তখন কারো মুখের দুটো কথাই বাঁচার আশাজাগায়। কথাই অনেক সময় আনন্দ, আবার কথাই দুঃখ। কথার কারণেইভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়, আবার কথা দিয়েই তা ভাঙানো হয়। কথাইমানুষকে বড় করে, কথাই আবার মানুষকে নিচে নামায়। কথাতেই সত্যপ্রকাশ পায় আবার মিথ্যাও কথার মাধ্যমেই আসে। সবটা আসলে নির্ভরকরে আমাদের মর্জির ওপর। আমরা কোন কথা মুখ দিয়ে বলার জন্যেবেছে নেব। আর কোন কথাটা এড়িয়ে চলব।

অনেকে কম কথা বলেন, কাজ বেশি করেন। কেউ কথা বেশি বলেন, কাজকম করেন। অনেকে যতটুকু বলেন, ততটুকু করেন। কেউ আবার না করেওবলেন। আর কেউ না বলেও করেন। এই কথা ও কাজের ক্ষেত্রে কে ভালোকে মন্দ, তা সবাই জানেন। তার পরও একটা মান বা স্ট্যান্ডার্ড বোধহয়আমাদের চারপাশ থেকেই বোঝার আছে।

কম কথা বলে যে কাজ করে যায়, তার কাজই তাকে মানুষের কাছে স্মরণীয় করে রাখে। কথার মানুষ আর কাজের মানুষ এক নয়। অনেকে নিভৃতচারী, কেবল কাজই করে যান। আপাতদৃষ্টিতে তাদের কেউ অনেকটা অবহেলিত কিংবা তার সময়ে তেমন দাম পান না। কিন্তু মৃত্যুর পর ঠিকই তার কাজ তাকে অবিস্মরণীয় করে রাখে। কাজ করলে তা বলা দরকার, তাতে হয়তো মানুষ বুঝতে পারে। কাজ না করে বলাটা নিশ্চয়ই সমীচীন নয়। অল্প করে বেশি বলাও উচিত নয়।

তবে কথা বলার ক্ষেত্রে যেমন আমাদের দায়িত্ববান হওয়া উচিত, কথা রাখার ক্ষেত্রেও সচেষ্ট হওয়া দরকার। রামায়ণের যুগ থেকেই কথা রাখার গল্প চলে আসছে। কথা এখানে মুখের কথাই। রাজনীতিতে আজকের দিনেও এর মূল্য কমেনি। কথা দিলে কথা রাখতে হয়, এটা মূল্যবোধ। কথায় কাজ হয়, এটাও মূল্যবোধ। দাগা খেয়েও মানুষ কথাতেই ভরসা রাখে। এর কারণ কী?

কারণ কথায় বিশ্বাস না রাখলে গরিব তার আহত-মলিন জীবনটাকে সামনের দিকে ঠেলে ঠেলে নিয়ে যেতে পারে না। বার বার সে রামকে বিশ্বাস করে ঠকে, যদিও রামের মুখোশ পরা রাবণকে চিনতে পারে না। ঠকতে ঠকতেও ভাবে এবারের রাম আসল রাম। এটি মুখোশ নয়।

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট

এ সম্পর্কিত আরও খবর