বৈশাখী অর্থনীতি

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

বাশার খান | 2023-09-01 12:27:04

বাঙালির সবচেয়ে আলোড়িত জাতীয় উৎসব- বাংলা নববর্ষ। শুরুর দিকে নববর্ষকে ঘিরে কয়েকটি উৎসব পালিত হলেও বর্তমানে অনেকগুলো অনুষ্ঠান স্থানীয় এবং জাতীয়ভাবে উদযাপিত হয়। পহেলা বৈশাখ উদযাপন এখন শহরেই সীমাবদ্ধ নয়, মিশে গেছে গ্রামে-গঞ্জে, পাড়া-মহল্লায়।

মুগল সম্রাট আকবর কর্তৃক বাংলা সনের সূচনার পেছনে ছিল অর্থনৈতিক তাগাদা। খাজনা আদায়ের নানা অসুবিধা রোধ করার জন্য তিনি বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। শুরুতে সাম্রাজ্যের কোনো কোনো অঞ্চলে এটাকে ফসলি সনও বলা হত। প্রজাগণ বছর শেষের নির্দিষ্ট সময়ে সম্রাটকে খাজনা দিবে। ফসল ফললে এবং তা ঘরে উঠলেই তো খাজনা দিতে পারবে-এ জন্যই ফসলি সন বলা হত। তাই পহেলা বৈশাখের সূচনাপর্ব থেকেই এর সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিল।


সম্রাট আকবরের আমলে চালু হয় বাংলা নববর্ষ

বৈদিক যুগে অগ্রহায়ণকে বাংলা বছরের প্রথম মাস ধরা হত। বহু বছর আগে থেকেই বাংলার প্রধান ফসল ধান। প্রধানত বৈশাখ মাসেই কৃষকের ঘরে ধান ওঠে। কৃষকের হাতে নগদ অর্থ ছিল না তখন। তাই সম্রাটের খাজনা বাকি থাকত। ফসল ঘরে উঠতেই খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে সম্রাট আকবর বৈশাখ মাসকে বছরের প্রথমে এনে দিনপঞ্জিকা প্রবর্তন করেন।

পরবর্তীতে বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খান পহেলা বৈশাখ থেকে খাজনা আদায় শুরু করেন। বাংলা নববর্ষের দিনে খাজনা আদায়ের এই আয়োজনটির নাম ছিল ‘রাজপুণ্যাহ’।

‘পুণ্যাহ’ চালুর অনেক বছর পর ব্রিটিশ শাসনামলে পহেলা বৈশাখে ‘হালখাতা’ অনুষ্ঠান চালু হয়। হালখাতা পহেলা বৈশাখের একটি স্থানীয় অনুষ্ঠান। নতুন বছরের হিসাব-নিকাশের জন্য নতুন খাতা আরম্ভের উৎসব এটি। তৎকালীন গ্রামের কৃষকেরা বাকিতে তাদের দৈনন্দিন কেনাকাটা করত। ফসল ঘরে উঠলে- ফসল দিয়েই অথবা ফসল বিক্রির অর্থ দিয়ে বাকি পরিশোধ করত।

হালখাতার মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা বিগত বছরের দেনা-পাওনার হিসাব গুছিয়ে নতুন খাতা খোলার আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণ করে। নিয়মিত ক্রেতা, গ্রাহক, পৃষ্ঠপোষক এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদেরকে কার্ড বা পত্রের মাধ্যমে দোকানে আসার আমন্ত্রণ জানান। সাধ্যমত মিষ্টি এবং পানীয় দিয়ে আপ্যায়ন করেন। প্রতিষ্ঠানটিকে নকশা করা রঙিন কাগজ এবং ফুল দিয়ে সাজান। অনেকে দু’তিন আগে থেকেই আলোকসজ্জা করেন। মাইক লাগিয়ে গান বাজান। আমন্ত্রিতরা সুন্দর পোশাক পড়ে উপস্থিত হন। কোনো কোনো অঞ্চলে হালখাতা উৎসবকে “গদি শাইত”বলা হয়। গদি শাইতে দাওয়াত- বলে আমন্ত্রণ জানানো হয়।

হালখাতা বা গদি শাইতের দিনে বেচাকেনা তেমন হত না। দোকানকে ধুয়েমুছে সুন্দর করা হতো। পঞ্চবটির পাতা ( অশ্বত্থ, বিল্ব, বট, অশোক ও আমলকীর পাতা) ভেজানো পবিত্র জল ছিটানো হতো। দোকানের ফটকে আমপাতা এবং বেলপাতা সুতলিতে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হতো। ব্যবসায়ীরা দেনাদারদের পানাহার করাতেন হাসিমুখে। দেনাদারগণ তাদের দেনা পরিশোধ করে যেতেন।


জাঁকজমক হারিয়েছে হালখাতা

গ্রামবাংলার ব্যবসায়ী সমাজে হালখাতা অনুষ্ঠানটির কোথাও কোথাও স্বল্পপরিসরে প্রচলন থাকলেও এখন আর আগের সেই জাঁকজমক নেই। কালের প্রবাহে হারাতে বসেছে এটি। ঢাকা শহরে হালখাতার আয়োজন সীমিতভাবে আয়োজিত হয়- পুরান ঢাকার তাঁতিবাজার, লক্ষ্মীবাজার ও শাঁখারীবাজার এলাকায়।

ব্রিটিশ আমল থেকে উদযাপিত বৈশাখী অনুষ্ঠানের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্কটা জোড়ালোই ছিল। হালখাতা প্রায় বিলুপ্ত হলেও অর্থনৈতিক বিষয়গুলো এখনো বৈশাখী বিভিন্ন উৎসবে বাক নিয়ে অর্থনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছে।

বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের প্রধান উৎস- পোশাক শিল্প। পুষ্টিহীন দেহ, মলিন চেহারার গার্মেন্টস কন্যার দাগ পড়া হাতের স্পর্শে তৈরি পোশাক পরছে ইউরোপ আমেরিকাসহ সারা পৃথিবীর মানুষ। পোশাক রপ্তানি করে আমরা অর্জন করছি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। আমরা শুধু তৈরি পোশাক রপ্তানিতে সমৃদ্ধ তা নয়; নিজস্ব পোশাক সংস্কৃতি সমৃদ্ধ একটি দেশ।

নিজেদের জন্য পোশাক উৎপাদন এবং কেনাকাটার প্রধান দুটি পর্ব হচ্ছে- ঈদুল ফিতর এবং পহেলা বৈশাখ। পুরো দেশের বিপণি বিতানগুলোতে এ দুটি উৎসবে ক্রয়-বিক্রয়ের আসর জমে ওঠে। ঈদে ভারত-পাকিস্তানের কিছু পোশাক আসলেও পহেলা বৈশাখে দেখা যায়- পোশাকের সম্পূর্ণ নিজস্ব রূপ, বাঙালি পোশাক। তাই বাংলা নববর্ষ প্রতিবছর দেশের পোশাক ব্যবসায় দারুণ প্রভাব রেখে চলেছে।


কেনাকাটা ও আনন্দ আয়োজনে বৈশাখী মেলা

দীর্ঘকাল থেকেই বৈশাখ নিয়ে নানা আয়োজন হয়ে আসছে বাংলাদেশে। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকলেই অংশগ্রহণ করে আসছে বৈশাখী উৎসবে। একটা সময় পর্যন্ত এটা ছিল গ্রামকেন্দ্রিক উৎসব। এতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে কিছুটা প্রভাবও রাখত।

ষাটের দশক থেকে বৈশাখ নগরকেন্দ্রিক হতে শুরু করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈশাখ শহরের প্রধান উৎসবে পরিণত হয়েছে। বড়দের পাশাপাশি শহরের আধুনিক ছেলে-মেয়েরাও দেশি শাড়ী, সেলোয়ার-কামিজ এবং পাঞ্জাবী-লুঙ্গি, ফতুয়া পরে আনন্দে মেতে ওঠে এদিন। শুধু তাই নয়, অনেক বিদেশিদেরকে ঢাকার রাস্তায় শাড়ি-লুঙ্গি পরে হাঁটতে দেখা যায়। কোথাও তারা নেচে-গেয়ে নানা হৈ- হুলোড় করে।

পোশাকের পাশাপাশি পানতা-ইলিশ, জিলাপি, হরেক রকমের ফুলের মালা, বাঁশিসহ দেশি বিভিন্ন লোকবাদ্যযন্ত্রেরও বিক্রি বেড়ে যায় বৈশাখ উপলক্ষে। এমনকি পহেলা বৈশাখে রিকশাচালকদেরও বাড়তি আয় হয়। অনেকেই রিকশায় ঘুরতে পছন্দ করেন এদিন। রিকশাওয়ালাকে বাড়তি পারিশ্রমিকটা হাসিমুখেই দেন তারা।

এভাবে নানাদিক থেকে আমাদের অর্থনীতিতে পহেলা বৈশাখ ভালই প্রভাব রেখে আসছে। কোন ফ্যাশন হাউজ কত নতুন ও আকর্ষণীয় বৈশাখী পোশাক শো-রুমে তুলতে পারে- এটা নিয়ে প্রতিবছরই প্রতিযোগিতা চলে। পুরান ঢাকার ওয়ারী, বসুন্ধরা শপিংমল, ধানমন্ডি এলাকার পোশাকের বিপণিগুলোতে বৈশাখী পোশাকের পসরা সাজায়। রাপা প্লাজার ‘জয়িতা’ফ্লরটিতে অনেকগুলো বুটিকস হাউজ আছে- এদের পণ্যগুলো নারীদের তৈরি এবং প্রতিষ্ঠানগুলো নারী উদ্যোক্তাদের দ্বারাই পরিচালিত।

রাজধানীর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেট, বর্তমানে দেশি ব্রান্ড এবং দেশি পোশাকের অন্যতম কেন্দ্র। এখানকার পোশাক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবছর তাদের ব্যবসার ক্ষেত্রে বৈশাখ বড় ধরণের উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। তারা জানান, ‘রমজান ঈদের পর তাদেরকে সবচেয়ে বড় প্রস্তুতিটা নিতে হয় পহেলা বৈশাখকে ঘিরে। বিক্রিও হয় প্রচুর। কোনো বৈশাখী ডিজাইন হিট হয়ে গেলে সেটা সরবরাহ করতে রীতিমত হিমশিম খেতে হয়। তরুণ একজন ব্যবসায়ী জানান, সারা বছর যা বিক্রি হয় তাতে মোটামুটি টিকে থাকে তারা। তবে পুরো বছরের ব্যবসা পুষিয়ে নিতে পারেন- ঈদ এবং বৈশাখে।

বৈশাখকে সামনে রেখে ছোট গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির (হোশিয়ারি নামে পরিচিত) কর্মতৎপরতা বেড়ে যায়। অর্ডার সরবরাহের জন্য দিনরাত খাটেন কারিগররা। শ্রমিকরা কিছুটা বাড়তি আয়ের সুযোগ পান। স্ক্রিন প্রিন্ট এবং কাপড়ে ব্লক করার দোকানগুলোর ব্যস্ততাও বেড়ে যায়।

জানা গেছে, পোশাকের দোকানে বছরের মোট বিক্রির ১৫% হয় বৈশাখ উপলক্ষে। বর্তমানে এই হার নিশ্চয় আরও বেড়েছে। ৬ বছর আগের হিসাব মতে, মাত্র একটি দিনকে কেন্দ্র করে পুরো বছরের বিক্রির ১৫% বিক্রি হওয়া- এটা বিরাট ব্যাপার। আরও মজার বিষয় হচ্ছে, বিক্রি হচ্ছে সম্পূর্ণ দেশি পোশাক। তাই বৈশাখ বাঙালির পোশাক সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রেও বিশেষ অবদান রেখে চলেছে।

তরুণদের অনেকে বিভিন্ন জায়গায় পানতা-ইলিশের দোকান দেন। বিভিন্ন পানীয় যেমন- জুস, মিনারেল পানি, এনার্জি ড্রিঙ্কস-এর অস্থায়ী দোকান বসায়। এতে কিছুটা বাড়তি আয় হয়, যা লেখাপড়ার খরচের অতিরিক্ত যোগান হিসেবে কাজ করে। বাঁশি, ঢোল, শিঙা, শঙ্খ, সানাই, মাদল, কাঁসর, একতারা-দোতারা এবং ডুগডুগিসহ বিভিন্ন দেশি লোকবাদ্যসামগ্রী বিক্রি হয় শহরের রাস্তায় রাস্তায়। বিক্রেতারা সুযোগ বুঝে দামটাও একটু বেশি নেয়। দিনশেষে তৃপ্তির হাসি নিয়ে বাসায় ফেরেন- এ সব দরিদ্র ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী। অনেকে শিশুদের বিভিন্ন খেলনা সামগ্রীর পসরা নিয়ে বসেন মেলায়। বিক্রিও হয় প্রচুর।


বৈশাখে একটু বাড়তি আয়ের আশায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা

মাটির তৈরি তৈজস- টিয়া, গরু, ছাগল, হরিণ, মোরগ, ময়না দোয়েল, আম, কাঁঠাল, পেঁপে, কলা, লিচু নিয়ে মেলায় দোকান বসায় মৃৎশিল্পের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। সারা বছর এগুলো অল্প পরিসরে বিক্রি হয়। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় বৈশাখী মেলায়। শিশুরা মাটির তৈরি এসব জিনিস কিনতে খুবই আগ্রহী, শো-কেসে সাজানোর জন্য শখের বসে বড়রাও কিনে থাকেন।

বৈশাখে শহর ও গ্রামে চুড়ি ব্যবসায়ীরাও বাড়তি আয় ঘরে তোলে। ফুলের মালার দোকানগুলোতে ব্যাপক ভিড় লাগে। মেয়েদের বৈশাখী গয়নার মধ্যে প্রাধান্য পায় কাঠ, পুঁতি, মাটি, বাঁশ ও ধাতুর তৈরি গয়না। এর সঙ্গে প্লাস্টিক ও কাঠের বোতাম ও সুতার তৈরি নানা ডিজাইনের কানের দুল ও গলার মালা। নারিকেলের মালা, পাট ও পাথরের তৈরি কানের দুল অনেকের পছন্দ। বৈশাখে সব নারীরাই এসব গহনা পরে বের হন। এগুলো প্রস্তুতকারী ও বিক্রেতারা একটু বাড়তি আয়ের সুযোগ পান বৈশাখে।

রাস্তার মোড়ে মোড়ে তরুণরা আলপনা এঁকে দিতে দাঁড়িয়ে থাকেন। আগ্রহীদের কপালে ও গালে নববর্ষের সুন্দর কথার আলপনা এঁকে দেন। আলপনায় শিশু ও নারীদের আগ্রহই বেশি। যারা আঁকেন তাদের আয়টাও ভালই হয়। খুশি হয়ে ১০ টাকা থেকে শুরু করে ১০০ টাকা পর্যন্ত আলপনাকারীদের দিয়ে থাকেন।

বৈশাখে উপহার সামগ্রীর বিক্রিও ব্যাপকহারে বেড়ে যায়। এরমধ্যে শুভেচ্ছা কার্ড বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আজাদ প্রোডাক্টস, আইডিয়েল প্রোডাক্টসসহ বিভিন্ন শুভেচ্ছা কার্ড প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বৈশাখ উপলক্ষে বিশেষ প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। ইদানীংকালে বৈশাখী উপহার হিসেবে প্রযুক্তি পণ্য দেয়ার চল শুরু হয়েছে। প্রিয়জনকে মোবাইল, ডিজিটাল ক্যামেরা, পেনড্রাইভসহ অনেকে ল্যাপটপও দিয়ে থাকেন।

এভাবেই বৈশাখী হাওয়া আমাদের অর্থনীতিতে প্রতিবছর নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করছে। চাঙ্গা করছে বুটিক হাউজ, বিপণি বিতানের প্রতিষ্ঠান এবং লোকবাদ্যযন্ত্র ও মাটির তৈরি বিভিন্ন জিনিস প্রস্তুতকারী ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে। বাঙালির ঐতিহ্যবাহী এই সাংস্কৃতিক উৎসব অবদান রাখছে অর্থনীতিতেও। পাশাপাশি দেশীয় পোশাক সংস্কৃতি, বিভিন্ন লোকজ জিনিসপত্র এবং খাবার সংস্কৃতির প্রতি তরুণ প্রজন্মকে উদ্দীপ্ত করছে।

বাশার খান: সাংবাদিক

এ সম্পর্কিত আরও খবর