মৃত্যু নয় হত্যাকাণ্ড

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-08-27 10:57:02

৬ এপ্রিল থেকে ১০ এপ্রিল। পাঁচ দিনের লড়াই শেষে মৃত্যুবরণ করলেন ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি। 

কিন্তু এটি নিছক মৃত্যু, নাকি হত্যাকাণ্ড? বাংলাদেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থার সামনে জ্বলন্ত এই প্রশ্নটি রেখে গেলেন নিপীড়ন-নির্যাতনে অগ্নিদগ্ধ হয়ে অকালে প্রাণ হারানো নুসরাত।

ফেনীর নুসরাত, কুমিল্লার তনুরা আর্তনাদে জর্জরিত হয়ে জীবন থেকে মৃত্যুর দিকে যেতে যেতে আমাদের সামনে যেসব প্রশ্ন রেখে যান, আমরা তার উত্তর দিতে পারি না। অক্ষম, মূক, বধির সমাজ নিজের নপুংসক চোখে তাকিয়ে দেখে অত্যাচারী ও নিপীড়কের নগ্ন উল্লাস। 

এইসব পাশবিক অপরাধের ঘটনাগুলোতে হন্তারক ও দুর্বৃত্তদের বিপক্ষে দাঁড়াতে পারেনি যে সমাজের মানুষসেখানে নুসরাত, তনুরা অকাতরে নিহত হতে থাকে। বিচার ও প্রতিকারহীনতার সংস্কৃতি বিরাজমান থাকায় বাংলাদেশ দেখতেই থাকে এসব বীভৎস মৃত্যুর মিছিল। একের পর এক বৃদ্ধি পেতেই থাকে নারীশিশুহত্যাধর্ষণনির্যাতনের লোমহর্ষক ঘটনা।

আর দশটা সাধারণ শিক্ষার্থীর মতোই নুসরাত বিদ্যার্জনের জন্য এসেছিল। কিন্তু আলিম পরীক্ষার কেন্দ্রে গেলে মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে পালিয়ে যায় মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা। এর আগে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে করা যৌন হয়রানির মামলা প্রত্যাহারের জন্য নুসরাতকে চাপ দেয় তারা। 

এই ছাত্রীর পরিবারের ভাষ্যে, ২৭ মার্চ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার তার কক্ষে ডেকে নিয়ে নুসরাতের শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। তারই জেরে মামলা করায় নুসরাতকে আগুনে পোড়ানো হয় ৬ এপ্রিল।

আগুনে ঝলসে যাওয়া নুসরাতকে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে ও পরে ঢামেকে নিয়ে আসা হয়। তার চিকিৎসায় গঠিত হয় ৯ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড। শারীরিক অবস্থা চরম নাজুক থাকায় উন্নত চিকিৎসার জন্য সব আয়োজন করা হলেও তাকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো সম্ভব হয়নি। দগ্ধ শরীরের নির্মম যন্ত্রণায় কাতর নুসরাত মানবতার সামনে ন্যায়বিচারে আকুতি জানিয়ে ১০ এপ্রিল জীবনের সব লেনদেন মিটিয়ে যাত্রা করেন পরপারে।

ফেনীর নুসরাতের জীবনের শেষ দিনগুলোর নির্মম ঘটনা প্রবাহ পর্যালোচনা করা হলেবিষয়টি যে একটি সুপরিকল্পিত হত্যা প্রচেষ্টাতা স্পষ্ট হয়। মাদরাসার ছাদে আকাশ থেকে দুর্বৃত্ত আসেনি। নুসরাতও দুর্ঘটনাক্রমে আকস্মিকভাবে ছাদে যায়নি। হত্যাকারীদের সামনে তাকে প্ল্যান করে পাঠানো হয়েছে। নিরাপদ মাদরাসার ছাদে হত্যাকারী-দুর্বৃত্তদের সুপরিকল্পিতভাবে আনা হয়েছে। জ্ঞানার্জনের জন্য এসে লোলুপতার শিকার হয়েছেন তিনি। হিংস্র হায়েনাদের কবলে নিহত হয়েছেন নুসরাত।

আক্রমণের আগে ও পরে আক্রান্ত নুসরাতকে নিরাপত্তা দিতে পারিনি আমরা। আমাদের সমাজ দুর্বল ও নিরীহকে আশ্রয় দিয়ে শক্তি যোগায় না। সবলের হাতে দুর্বলের নিগৃহীত হওয়ার ঘটনাবলিকে তামাশা হিসেবে দেখে এই বিকারহীন সমাজের মানুষ। অপরাধ ও আক্রমণগুলোকে আগাম প্রতিরোধ করার জন্য সামান্য চেষ্টাও করে না।

যে প্রতিষ্ঠানে লাঞ্ছিত হয়েও নুসরাত পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল, সেখানে তার নিরাপত্তা ছিল না। মামলা করেও তিনি বাঁচতে পারেননি। বরং অভিযুক্তরাই তার ওপর চড়াও হওয়ার দাপট দেখিয়েছে।

তারপর আগুনে আক্রান্ত হয়ে শরীরের ৭৫-৮৫ শতাংশ পুড়িয়ে দেওয়ার পরেও সাহসী-বীর মেয়েটি ন্যায়বিচারের লড়াই চালিয়ে গেছেন। যন্ত্রণায় কাতর হয়েও চিৎকার করে বলেছেন, 'শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমি এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করমু।’

এমতাবস্থায় অপরাধীদের আশ্রয় দেওয়া ওসিকে শুধুমাত্র প্রত্যাহার করাই যথেষ্ট ছিল? অপরাধীদের পক্ষে কমিটি বানিয়ে মিছিল করে উল্টা চাপ সৃষ্টি করার সময় নিশ্চুপ বসে থাকা সমাজ ও মানুষের 'উপযুক্ত দায়িত্ব' ছিল? প্রশাসন, নেতৃবৃন্দ, শিক্ষক, সাংবাদিক,শিল্পী, বুদ্ধিজীবী সমাজ এবং সাধারণ মানুষ একটি আক্রান্ত নারীর আহাজারি ও ন্যায়বিচারের আর্তনাদের বিরুদ্ধে অপরাধীচক্রের আস্ফালন, দম্ভ, দাপট ও তাণ্ডবতা দেখে যাওয়া 'নৈতিক কর্তব্য' ছিল?

রাষ্ট্রসমাজ ও মানুষের সামনে একটি তরুণীকে নিপীড়ননিগৃহীত করে অবশেষে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলার দায় কার? অপরাধীর তো বটেই। আর আমরা যারা যাবতীয় পাষণ্ডতা চেয়ে চেয়ে দেখলাম এবং দেখেও প্রতিবিধানের কোনো পদক্ষেপ নিলাম নাতাদের দায় নেই

একটি দীর্ঘমেয়াদী ও নীরবে চলমান হত্যাকাণ্ডের এই ঘটনায় আমরাও নিজের বিবেকের কাছে অপরাধী হয়ে রইলাম। নুসরাত ও এমন বহু নিহতের মৃতদেহগুলো আমাদের অক্ষমতাকে ক্ষমা করবে না। আমাদের অক্ষমতাতেই ক্রমে ক্রমে বাড়ছে নুসরাত, তনুদের লাশের মিছিল।

ড. মাহফুজ পারভেজ: কন্ট্রিবিউটিং এডিটরবার্তা২৪.কম

এ সম্পর্কিত আরও খবর