শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি সাংবাদিক এবিএম মূসাকে

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

কামরুল ইসলাম চৌধুরী | 2023-09-01 02:27:19

আজ ৯ এপ্রিল কিংবদন্তি সাংবাদিক এবিএম মূসার পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৪ সালের এই দিনে আমাদের সকলের প্রিয় মূসা ভাই চলে যান না ফেরার দেশে। বয়স হয়েছিল তখন তার ৮৩ বছর।

আমাদের সাংবাদিকতার জগতে এবিএম মূসা এক বিশাল মহীরূহের নাম। জীবন শুরু করেছিলেন দৈনিক ইনসাফে শিক্ষানবিশি করে। সেখান থেকে পাকিস্তান অবজার্ভার। তারপর সংবাদ, তারপর আবার অবজার্ভার হয় তার ঠিকানা। অবজার্ভারেই জীবনের বেশি সময় দিয়েছেন। মেধা দিয়েছেন, শ্রম দিয়েছেন, সাফল্যের বরমাল্যও পেয়েছেন সেখানে। আজও অনেকে তাঁকে মনে রেখেছেন অবজার্ভারের বার্তা সম্পাদক হিসেবে, যে ভূমিকায় তিনি সামরিক শাসনের দুই পর্ব পার করেছেন।

কত ঝুঁকি নিয়েছেন, নিয়মভঙ্গ না করে, সামরিক শাসনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে সরকারের অভিপ্রায়ের উল্টো কাজটি করেছেন, ভয় পাননি। তিনি জানতেন, সাংবাদিকদের অধিকাংশ তার সঙ্গে আছেন, জনগণ আছে তার পাশে। সত্যি বলতে কি তিনি ছিলেন সামরিক শাসকদের জন্য ত্রাস। স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু  উপেক্ষা করে কিভাবে অসম সাহসিকতার সঙ্গে রিপোর্ট করা যায় সেই ব্যাপারে তার জুড়ি নেই। দৈনিক সংবাদ-এ তার সহকর্মী হিসেবে স্বচক্ষে তা দেখেছি। তিনি ছিলেন আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস।

মূসা ভাই সাংবাদিকতা করেছেন বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই। জীবনসায়াহ্নেও সম্পাদনা করেছেন বাংলা কাগজ। প্রায় শেষকাল পর্যন্ত কলাম লিখেছেন বাংলা কাগজে। কত সাংবাদিকের গুরু তিনি। বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থারও ছিলেন প্রধান সম্পাদক। দেশের বাইরের বেতার ও পত্রিকার সংবাদদাতা ছিলেন তিনি-বেশ কয়েক বার।

সাংবাদিক এবিএম মূসা

সাংবাদিকতার বাইরে ক্রীড়াজগতের সঙ্গে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠতা ছিল তার। বিশিষ্ট ক্রীড়াসংগঠক ছিলেন তিনি। সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা হিসেবে যেমন সাংবাদিকদের স্বার্থরক্ষায় আন্দোলন করেছেন, ক্রীড়া সংগঠক রূপে তেমনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থরক্ষায় সংগ্রাম করেছেন। খেলার মাঠেও রাজনীতি টেনে আনতে বাধ্য করেছিলেন পাকিস্তানের শাসককুল তাদের অপরিণামদর্শী ভূমিকার ফলে। মূসা ভাই যেমন বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধ্বংজা ধরেছিলেন তার পত্রিকার পাতায়, তেমনি বাঙালির ন্যায্য প্রাপ্য আদায় করে নিতে চেয়েছেন ক্রীড়াঙ্গণেও।

রাজনীতি তাই এবিএম মূসার জন্যে নতুন কিছু ছিল না। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে  তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন জাতীয় সংসদ সদস্য। কিন্তু সে সংসদ তো মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। মূসা ভাইও পারেননি তেমনি ভূমিকা পালন করতে। কালো ঝড় এসে সব তছনছ করে দিয়ে গেল। মূসা ভাই পালালেন কর্মক্ষেত্র ছেড়ে শুধু নয়, দেশ ছেড়েই। যোগ দেন জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির ব্যাংকক কার্যালয়ে।

এসব বৃত্তান্ত তার স্মৃতিকথা `আমার বেলা যে যায়’ গ্রন্থে তারই কথা বিবৃত হয়েছে। তার নিকটজনেরা এ বিষয়ে আরও অনেক জানেন। তার স্মৃতিকথা যেখানে শেষ হয়েছে, তারপর তিনি অনেকদিন বেঁচে ছিলেন। বরঞ্চ স্মৃতিকথাই প্রকাশ পেল তার মরণোত্তর প্রকাশনা হিসেবে। তিনি ছিলেন কিংবদন্তি, নিজেই এক প্রতিষ্ঠান।

দীর্ঘ ৮৩ বছরের জীবনের সিংহভাগ, ৬০ বছরেরও বেশি সময় নিবেদিত প্রাণ ছিলেন সাংবাদিকতায়। অন্য পেশার প্রলোভন তাকে টানেনি কখনো। জীবনসায়াহ্নে এসেও রোগ-ব্যাধি, ক্লেশ, প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে সমকালীন রাজনীতির বিচার বিশ্লেষণ করেছেন টিভি টক শোতে। উচ্চারণ করেছেন অপ্রিয় সত্য, জাতিকে দিয়েছেন দিকনির্দেশনা।

সহজ, সরল, সত্যসন্ধ, মিশুক স্বভাবের মানুষটি তার কিশোর বয়সে ভাষা আন্দোলনে যেমন অংশ নিয়েছেন, তেমনি মহান মুক্তিযুদ্ধে নিশ্চূপ, নির্লিপ্ত থাকেননি। চাকরি ছেড়ে তিনি যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে, ছিলেন রণাঙ্গণ-সংবাদদাতা। প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে গেরিলা জনযুদ্ধের খবর সংগ্রহের পর পৌছে দিয়েছেন বিদেশি একাধিক গণমাধ্যমে। পারদর্শী ছিলেন ইংরেজি-বাংলা উভয় ভাষাতেই। কর্মনিষ্ঠ, বর্ণাঢ্য চরিত্রের এই মানুষটি তিন প্রজন্মের মানুষের প্রিয় ‘মূসা ভাই’।

সহজাত প্রতিভা, নিষ্ঠা, অধ্যবসায়, শ্রম, দূরদৃষ্টি, সাহসিকতা ছিল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। বিলেতে সাংবাদিকতা বিষয়ক প্রশিক্ষণে ঋদ্ধ হয়ে স্বদেশের সাংবাদিকতায় নতুন ধারা, মাত্রা ও আধুনিকতার সংযোজন করেন। গতানুগতিক সাংবাদিকতাকে নিয়ে যেতে সমর্থ হন অনন্য উচ্চতায়। গভীর দেশপ্রেম, অগ্রসর চিন্তা, গণমানুষের কল্যাণ ও প্রগতিশীলতাকে জীবনভর অঙ্গীকার করেছেন।

তদানীন্তন পাকিস্তান অবজার্ভার-এর ডাকসাইটে বার্তা সম্পাদক এবিএম মূসা ছিলেন অনেক সফল রিপোর্টার ও সাংবাদিকের দীক্ষাগুরু। বিটিভি’র প্রথম এমডি, মর্নিং নিউজ, নিউজ ডে ও যুগান্তর-এর সম্পাদক ছিলেন। বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা। তার অমর স্মৃতির প্রতি জানাই অতল শ্রদ্ধা।

কামরুল ইসলাম চৌধুরী: সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব এবং চেয়ারম্যান বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম।

এ সম্পর্কিত আরও খবর