অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে করার আছে অনেক কিছু

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান | 2023-08-28 10:06:41

বারবার জীবন্ত মানুষের আগুনে পুড়ে অঙ্গার হওয়া, কুণ্ডলী পাকানো কালো ধোঁয়া, প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত পানি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা না পাওয়া বা না থাকা এবং জীবন বাঁচানোর রুদ্ধশ্বাস প্রচেষ্টা আমাদেরকে ভাবিয়ে তুলছে। তবে, উৎসুক জনতা ভিড় সৃষ্টি করে নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধার কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা অপ্রত্যাশিত এবং অমানবিক। যদিও কিছু মানুষের (শিশুসহ) সহযোগিতা মানুষের হৃদয়ে মানবতাবোধ সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে। প্রতিদিন শত শত মানুষের আনাগোনা যে ভবনে সেখানে অগ্নি নিরাপত্তা ও জরুরি বহির্গমনের পথ ছিল না এটি মেনে নেওয়া কষ্টকর। রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করে লোভী, স্বার্থপর, নিষ্ঠুর কিছু মানুষের কারণে রাষ্ট্রকে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয় বারবার।

দুই.

২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলী ট্র্যাজেডিতে ১১৯ জন মানুষ আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণ করেন। শত শত মানুষ অগ্নিদগ্ধ হন। ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেওয়ায় গত ২০ ফেব্রুয়ারি একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে পুরান ঢাকার চকবাজারে। অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাতের ব্যাপারে বহুমত থাকলেও বিস্তৃতির ব্যাপারে প্লাস্টিক, সুগন্ধি, রং জাতীয় দ্রব্যসহ বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যাদির ভূমিকা সবাই স্বীকার করেছেন।

তিন.

অপরিকল্পিত নগরায়ন, ভবনগুলোতে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা, মেয়াদোত্তীর্ণ ও অকেজো অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, পাশকৃত নকশা অনুযায়ী ভবন তৈরি না করা, অনুমোদনহীন ভবন তৈরি করা, জরুরি বহির্গমনের পথ না থাকা, বিপজ্জনক বিদ্যুৎ শর্ট সার্কিটের ব্যাপারে সচেতন না থাকা বিষয়গুলো আমাদেরকে বিপদের কঠিনতম দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে।

অন্যদিকে, এক একটি গ্যাস সিলিণ্ডার যেন এক একটি বোমা। বাড়ি-গাড়িতে কত অনায়াসে এবং নিশ্চিন্তে গ্যাস সিলিণ্ডার আমরা ব্যবহার করি। কোনো সিলিণ্ডারের মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ একজন শিক্ষিত মানুষও বোঝেন কি না সন্দেহ। এমন সাংকেতিক ভাষায় লেখা থাকে কারো পক্ষে তা বোঝার উপায় নেই। আবার মানুষের চোখকে ধুলা দিতে পুরাতন সিলিণ্ডারে নতুন করে রং করার কর্মযজ্ঞতো আছেই।

এক শ্রেণির মানুষের যোগসাজশে এগুলো যে হয় তা সকলে বোঝে, কিন্তু কেন যেন কিছু হয় না তাদের। আবাসিক এলাকায় কারখানা স্থাপনের অনুমোদন যারা দিয়েছে তারা দায় এড়াতে পারে না। কিংবা যারা অনুমোদন ছাড়াই কারখানা চালায়, তারা কীভাবে এবং কাদেরকে খুশি করে চালায় এগুলো জানার দরকার রয়েছে।

চার.

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি আরো কিছু বিষয় বিবেচনায় নেওয়া দরকার। যেমন:

(১) রাজউক; ঢাকা সিটি কপোরেশন (উত্তর-দক্ষিণ); পুরকৌশল, স্থাপত্য ও দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ; সামাজিক গবেষক এবং পরিবেশবিদের সমন্বয়ে কয়েকটি কমিটি করে ঢাকাসহ সকল শহরের সব এলাকা পরিদর্শন এবং তাদের ‘স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘ’ মেয়াদী সুপারিশ অধিক গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।

(২) জনবসতি, বাণিজ্যিক ও অধিক সংবেদনশীল এলাকায় পানির আধারের সঙ্গে সংযুক্ত করে সমদূরত্বে লাল রঙ যুক্ত জরুরি পাইপলাইনের ব্যবস্থা করা দরকার, যেন প্রয়োজনের সময় পর্যাপ্ত পানি পাওয়া সম্ভব হয়। এলাকাভেদে পর্যাপ্ত পানি ধরে রাখার জন্য ব্যবস্থা রাখতে হবে। শহরের মধ্যে যে খাল বা পানির আধারগুলো আছে সেখানে নোংরা-ময়লা পানি যেন না জমে থাকে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বন্ধ হয়ে গেলে তা পুন:খনন করতে হবে। প্রত্যেক ভবনের নিচে ‘রিজার্ভ ট্যাংক’ তৈরি করে আবশ্যকভাবে পানি ধরে রাখতে হবে।

 

চীনের হাংঝৌ শহরে রাস্তার পাশে নির্দিষ্ট দূরত্বে (আনুমানিক ২০০ গজ) জরুরি পানি সরবরাহের পাইপ।

(৩) অধিক বিপদ ও দুর্যোগের সময় মানুষ উপর থেকে লাফ দেওয়ার সময় নিচে ধরা যায় এমন সংবেদনশীল সুতায় তৈরি বড় বড় জাল (নেট) তৈরি করে প্রত্যেক এলাকার মসজিদসহ অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ক্লাবে সংরক্ষণ করা দরকার যেন বিপদের সময় ব্যবহার করা যায়।

(৪) ‘আবাসিক এলাকায় কোনো কারখানা নয়’ বিষয়টি সামনে রেখে অতি দ্রুত রাসায়নিক কারখানা ও দ্রব্যাদি স্থানান্তরে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করলে সুফল আসতে পারে।

(৫) পুড়ে যাওয়া এবং অধিক পুরাতন ভবনগুলো পরীক্ষাপূর্বক অচিরেই ভেঙে ফেলা জরুরি।

(৬) সরু রাস্তা বা গলি প্রশস্ত করতে হবে। যেন কমপক্ষে এ্যাম্বুলেন্স এবং ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতে পারে।

(৭) পুরান ঢাকার এলাকাগুলোকে সেক্টরের মত ভাগ করে উন্নয়নে নজর দেওয়া যেতে পারে।

(৮) পর্যাপ্ত পানি, আলো-বাতাসের ব্যবস্থা থাকার মত পরিবেশ গড়ে তোলায় বিশেষ নজর দিতে হবে।

(৯) খাল, পুকুর, খেলার মাঠ, পার্ক কিংবা ফাঁকা জায়গাগুলো সংরক্ষণ করতে হবে এবং না থাকলে এগুলো তৈরিতে বিশেষ নজর দিতে হবে।

(১০) নগরায়নে পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য যা আমরা একেবারেই গুরুত্ব দেইনা। পরিকল্পনা ছাড়া নগরায়ন ঘটতে দেওয়া উচিত নয়।

(১১) শহরের সকল এলাকায় বিদ্যুতের লাইন মাটির নিচ দিয়ে নিতে হবে। ক্রমান্বয়ে গ্রামেও মাটির নিচ দিয়ে লাইন নিতে হবে।

(১২) ফায়ার সার্ভিসের একটি ‘টিম’ সার্বক্ষণিক প্রস্তুত অবস্থায় নিয়মিত পরিদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে যেন তারা ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও এলাকা চিহ্নিত করতে পারে।

(১৩) বাংলাদেশ সেনা, নৌ ও বিমান, পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব ও আনসারে নিজ বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা স্বতন্ত্রভাবে অত্যন্ত দক্ষ ও আধুনিক ‘ফায়ার সার্ভিস’ ও ‘রেসকিউ টিম’ গড়ে তুলতে হবে।

(১৪) গ্যাস সিলিণ্ডার ব্যবহারের বিকল্প ভাবতে হবে। পাশাপাশি গ্যাস সিলিণ্ডারে মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ এমনভাবে লেখার ব্যবস্থা করতে হবে যেন যে কেউ দেখা মাত্রই বুঝতে পারে।

(১৫) ওয়াসা, তিতাস, সিটি কর্পোরেশন, বিটিআরসি, সওজ, পিডিবিসহ সকলের মধ্যে রাস্তা খনন-মেরামত, বিদ্যুত-গ্যাস লাইন সংযোগ ও প্রতিস্থাপনে সমন্বয় থাকা জরুরি।

(১৬) নিরাপদ ও আধুনিক জরুরি বর্হিগমন পথ থাকা আবশ্যক।

অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান, ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ ও ভবিষ্যতে অগ্নিকাণ্ড রোধে কমিটি করা হয়। কিন্তু কমিটির সুপারিশ আর বাস্তবায়ন হয় না বা হলেও ধীরগতির কারণে অনেক সময় একই ঘটনার পুনারবৃত্তি ঘটে। অনেকের কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যে রাষ্ট্রকে সমালোচনার মুখে ফেলে দেয়, সরকারকে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারকে বুঝতে হবে কাদের জন্য রাষ্ট্র ও সরকার বিব্রত হয়। কারা সরকারি নিয়ম ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করে ফায়দা লুটে দেশকে ও সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত প্রত্যেকটি কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সরকারকে কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে। তা না হলে সমালোচনার মুখে পড়তে হবে বারবার।

মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান: পি.এইচ.ডি গবেষক, জেঝিয়াং ইউনিভার্সিটি, চীন এবং শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর