শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ, তাদেরকে উপেক্ষা করা যাবে না

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মাছুম বিল্লাহ | 2023-08-23 07:58:41

শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলে দেয়া বক্তব্যের জন্য দু:খ প্রকাশ করে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দেয়া বিবৃতি প্রত্যাখ্যান করে শিক্ষার্থীরা তার পদত্যাগের দাবিতে অনড় থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। অর্থাৎ অবস্থা আরও সমস্যার দিকে এগুচ্ছে। এর আগে ২৯ মার্চ সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকার লিয়াজো অফিসে সিন্ডিকেট সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। উপাচার্য ২৬মার্চের দেয়া বক্তব্যের বিষয়ে জানান, ওই শব্দ তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে বলেননি। যারা স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান বানচাল করতে চায় তাদের বলেছেন। তারপরও তিনি ওই শব্দের জন্য দু:খ প্রকাশ করেছেন। রাতে সিন্ডিকেট সভা শেষে গণমাধ্যমে পাঠানো একটি বিবৃতিতে দুঃখ প্রকাশ করেন উপাচার্য। আমরা লক্ষ্য করেছি তিনি প্রথম থেকেই বলে আসছিলেন যে, তার দু:খ প্রকাশ করার কোন প্রশ্নই ওঠে না কারণ তিনি ওই শব্দ ব্যবহার করেননি। শিক্ষার্থীরা যখন তাকে ক্ষমা চাইতে বলছিল তখন তিনি ছিলেন অনড়। তিনি যখন দু:খ প্রকাশ করেছেন সেটি ঘটেছে বিলম্বে আর তাই শিক্ষার্থীরা আরও একধাপ এগিয়ে বলছে তাকে পদত্যাগ করতে হবে। তারা এটিকে প্রতারণা হিসেবে দেখছে।

গণমাধ্যমে পাঠানো উপাচার্যের বার্তাটি হচ্ছে এরূপ ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিবেটিং সোসাইটি কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠানে আমার প্রদত্ত বক্তব্যের একটি বাক্যকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে কিছু ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। আমি এ বিষয়ে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই যে, 'আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে রাজাকার বলে সম্বোধন করিনি বরং যারা মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে বাধা সৃষ্টি করতে চায়, তাদেরকে এহেন কার্যক্রম রাজাকার সদৃশ মর্মে মন্তব্য করেছি। উক্ত শব্দটি আমি কোনভাবেই আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকে উদ্দেশ্য করে বলিনি। এরপরও যদি আমার উক্ত বক্তব্যে কোন শিক্ষার্থী মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে থাকে, তবে তার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দু:খ প্রকাশ করছি'।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে দশ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের লাগাতার আন্দোলনের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস পালন উপলক্ষে উদ্ভূত অনভিপ্রেত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিরাপত্তা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সার্বিক পরিস্থিতি সমুন্নত রাখার স্বার্থে উপাচার্যের ক্ষমতাবলে ২৮মার্চ থেকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ক্লাস, পরীক্ষাসহ যাবতীয় একাডেমিক কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল হলের আবাসিক ছাত্র-ছাত্রীদের ২৯ মার্চ বিকাল পাঁচটার মধ্যে হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়। এ নোটিশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে রাত দুটার দিকে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করে।

আমাদের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. আলাউদ্দিন আহমেদ স্যার আমাদের বলতেন এবং একদিন একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে সিভিল ক্যান্টনমেন্ট। এই ক্যান্টনমেন্টের অধিবাসীরা আইয়ুব খানকেও ভয় পায়নি। এদেরকে কোনভাবে ক্ষ্যপানো যাবে না। তাহলে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত ঘটে যেতে পারে।'

আসলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা যখন রেগে যায় বা ক্ষেপে যায় তখন তাদেরকে নিবৃত্ত করা সহজ নয়। তারা মুক্তবুদ্ধির মানুষ ও অন্যায়ের প্রতিবাদকারী একদল তরুণ। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে সাধারণত সেভাবে বিবেচনায় নেন না। ঘটনা যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তখন তারা একটি সহজ পথের আশ্রয় নেন। আর সেটি হচ্ছে, 'অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা।' এই পুরনো পদ্ধতি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে বেরিয়ে আসতে হবে। হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিলে ছাত্র-ছাত্রীদের যে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের সম্মুখীন হতে হয়, তা এদেশের শিক্ষক হিসেবে তাদের বোঝা উচিত। আমার মনে আছে এরশাদ আমলে বার বার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হতো।

ছাত্র-ছাত্রীদের যে চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হয় তা হয়তো সামরিক শাসকরা বুঝতেন না বা বুঝতে চাইতেন না। কিন্তু শিক্ষকদের তো বুঝা উচিত। হঠাৎ হল থেকে বের করে দেয়ায় আমরা তখন বিশ্ববিদ্যালয় পোস্ট অফিসের এক পিয়নের ম্যাচে গিয়ে রাত কাটিয়েছিলাম। তাও চারদিক পুলিশের গাড়ি টহল দিচ্ছিল। ভয়ে রাত কাটিয়েছিলাম। এই পরিস্থিতির জন্য তো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই দায়ী। তাছাড়া সকল একাডেমিক কর্মকাণ্ড বন্ধ, পরীক্ষা বন্ধ---এসব কারণে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন যে অযথা দীর্ঘায়ত হয়, বয়সের কারণে অনেকে চাকরিতে দরখাস্ত পর্যন্ত করতে পারে না, সে দায়ভার কে নেবে? তাদের শিক্ষাজীবন বিলম্বিত করার অধিকার শিক্ষকদের আছে কি?

শিক্ষার্থীদের সাথে যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সম্পর্ক ভাল না থাকে তাহলে কোনো অবস্থাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করে না। একইভাবে, একটি দেশের সেনাবাহিনী যত শক্তিশালীই হোক না কেন সেই দেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করে না যদি জনগণের সাথে সেনাবাহিনীর সুসম্পর্ক না থাকে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে পাকিস্তান। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থাকে সরকারি মদদপুষ্ট তাই তারা অনেক সময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে অনেক কথাই বলে ফেলেন যা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন তথা শিক্ষকদের বলা উচিত নয়।

তারা মনে করেন, সরকার তাদের শেল্টার দিবে, সরকারি ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের সমর্থন দিবে ও তাদের রক্ষা করবে। এই হিসেব সব সময় মেলেনা তা প্রশাসনের বুঝা উচিত। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক কথা, রাজনৈতিক উক্তি ও রাজনৈতিক শব্দ ব্যবহার করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হেনস্থা করা তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কোনোভাবেই সাজে না। একজন রাজনৈতিক নেতাকে বিভিন্ন ধরনের মানুষের সাথে মিশতে হয়, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কথা বলতে গিয়ে হয়তো দু’একটি অনাকাঙ্ক্ষিত কথা মুখ ফসকে বেরিয়ে যেতে পারে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এটি হবে কেন? তাহলে দেশ কী শিখবে, সর্বোচ্চ পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা কী শিখবে?

পরিস্থিতি যখন চরমে পৌঁছে তখন এ ধরনের প্রশাসনকে ওপর থেকেও সমর্থন দেয়া হয় না । ভিসি বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তখন নমনীয় হন। এটি মেধাবী শিক্ষার্থীদের তো বুঝতে বাকী থাকে না। অন্যান্য সংস্থা বা অফিসের মতো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সরাসরি জবাবদিহিতার মধ্যে নগ্নভাবে আনা হয় না; তাদের জ্ঞান ও বিবেকের কাছেই তারা দায়বদ্ধ থাকেন।

এখানে কি শুধু দেয়া আর নেয়ার সম্পর্ক? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মনে রাখা উচিত যে, তারা অবশ্যই তাদের শিক্ষার্থী এবং দেশবাসীর কাছে দায়বদ্ধ। তারা তাদের দায়িত্বকে অবহেলা করতে পারেন না।সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও চা-চক্রে শিক্ষার্থীরা কেন দাওয়াত পাবে না? তারা আছে বলেই তো বিশ্ববিদ্যালয় আছে। বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানে যদি বিশেষ কারণে নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থীদের প্রবেশাধিকার থাকে, সেখানে শিক্ষার্থী নেতাদের যাওয়ার কথা। এজন্যই প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-সংসদ থাকা উচিত। সেখানেও তো বিশাল রাজনীতি!

শিক্ষার্থী বন্ধুদের বলছি, শিক্ষকদের প্রকৃত অর্থে সম্মান করতে শিখতে হবে। তার প্রমাণ এখন থেকেই রাখতে হবে। বাংলাদেশের মতো দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা যে, কত কষ্টের তা তোমার পুরোটা না হলেও অনেকটা বুঝতে পার। তাই বলছি তোমারাও যখন শিক্ষক হবে তখন তোমাদের সাথেও তো তোমাদের শিক্ষার্থীরা একই ধরনের আচরণ প্রদর্শন করতে পারে। সেটি ভেবে তোমাদের উচিত শিক্ষকদের কথা মেনে চলা । ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ রেখে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া মানে তোমাদেরই ক্ষতি।শিক্ষকগণ বা তোমাদের শ্রদ্ধেয় ভিসি স্যার যদি কোনো কথা বলেই ফেলেন, তিনিও তো মানুষ, ভুল তাঁর হতেই পারে। তোমরা সেটি ভুলে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার সুযোগ করে দাও।তোমরা যদি মহানুভবতার পরিচয় দিতে পার, তার প্রতিদানও তোমরা পাবে। দেশবাসীও তোমাদের কাছে সে ধরনের কিছু আশা করেন।

মাছুম বিল্লাহ: শিক্ষা গবেষক ও বিশেষজ্ঞ; বর্তমানে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত সাবেক ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজ শিক্ষক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর