পরিবেশবান্ধব ইটভাটার প্রয়োজনীয়তা

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

আলম শাইন | 2023-09-01 14:09:10

বায়ু দূষণের ফলে বনাঞ্চল ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে

বন-বনানী, বন্যপ্রাণী ও জলাশয়ের নির্মম পরিণতি দর্শন দীর্ঘ দিনের অভ্যাস। সময় সুযোগের অভাবে বেশি দূর এলাকায় যাওয়া না হলেও অন্তত রাজধানীর কাছেপিঠে ঘুরে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ঠকারীদের ধৃষ্টতা অবলোকন করতে হয়। লিখতে হয় বিনষ্ঠকারীদের শুভবোধের জন্য। তাতে করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় মানুষ কিছুটা উজ্জ্বীবিত হন বটে, আর নিজের ভেতরও কাজ করে একটা আত্মতৃপ্তিবোধ। সেই তাগিদবোধ থেকে এ লেখার অবতারণা। এ ছাড়াও সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের সংবাদ পাঠে লেখার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।

ঢাকায় বায়ু দূষণের প্রধান উৎস ইটভাটা

সংবাদ পাঠে জানা গেছে, ঢাকা শহরের বায়ু দূষণের প্রধান উৎস ইটভাটা থেকে নির্গত কার্বন মনোক্সাইড ও অক্সাইউ অব সালফার। যা নির্গত হওয়ার ফলে রাজধানীর প্রায় ৫৮ শতাংশ বায়ু দূষণ ঘটছে। বাদবাকি বস্তুকনা ও জৈব যৌগ, জ্বালানি দহন ও শিল্প-কারখানার দূষিত ধোঁয়ার মাধ্যমে ঘটছে। বিশেষকরে ইটভাটা থেকে নির্গত কার্বন মনোক্সাইডের প্রভাবে ঢাকা এবং আশপাশের  বনাঞ্চল ও জীববৈচিত্র মারাত্মক ক্ষতির সম্মুক্ষীণ হয়েছে।

কালো ধোঁয়া ও কার্বন মনোক্সাইডের প্রভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে বৃষ্টিপাত

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ইট ভাটার প্রভাবে আশপাশে তুলনামূলকভাবে বৃষ্টিপাতও কমে গেছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে চিমনি দিয়ে নির্গত কালো ধোঁয়া প্রবাহিত হওয়া। কালো ধোঁয়া এবং অধিক কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসের প্রভাবে আকাশে কোনো ধরনের মেঘ পুঞ্জিভূত হতে পারে না, বরং আকাশের মেঘটাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বৃষ্টিপাতে বিগ্ন ঘটায়।

ইটভাটার সারি শুধু ঢাকা জেলার সাভার, কেরানীগঞ্জ নয় এ সারি দেখা যায়, গাজীপুর নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জসহ দেশের অন্যান্য জেলাগুলোতেও। তবে রাজধানীর আশপাশের জেলা-উপজেলাগুলোতে তুলনামূলকভাবে বেশি নজরে পড়ে। ফলে বলা যায় ইটভাটার বিষবাস্প এখন রাজধানীতেও প্রবেশ করছে প্রচুর পরিমানে। ইটভাটা থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ার প্রভাবে পরিবেশের যে বিপর্যয় ঘটছে এবং সনাতনী পদ্ধতি অবলম্বনের কারণে ভাটার মালিকেরা যে হারে আর্থিক ক্ষতির সন্মুক্ষীণ হচ্ছেন তার হিসাব তাদের জানা নেই। জানলে বোধকরি ইটভাটাকে ‘ইট কারখানায়’ রূপান্তরিত করতে উদ্বুদ্ধ হতেন।

ভাটাগুলোতে বছরে কয়লা পোড়ানো হয় এক মিলিয়ন টনেরও বেশি। এ থেকে প্রতিবছর কার্বন মনোঅক্সাইড নির্গত হয় প্রায় ৬ কোটি ৪০ লাখ টন।

জরিপে জানা গেছে, সমগ্রদেশে ইটভাটার সংখ্যা প্রায় হাজার চারেক। ভাটাগুলোতে বছরে কয়লা  পোড়ানো হয় এক মিলিয়ন টনেরও বেশি। আর এ থেকে প্রতিবছর কার্বন মনোঅক্সাইড নির্গত হয় প্রায় ৬ কোটি ৪০ লাখ টন। এ ছাড়াও ইটভাটা থেকে নির্গত হয় বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর ধোঁয়া। যা থেকে গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়া ঘটে ব্যাপকভাবে। ইটভাটার মালিকরা যদি একটু সতর্ক বা সচেতন হতেন, তাহলে এ ক্ষতিকর দিক থেকে দেশ, জাতি কিংবা পরিবেশকে বাঁচাতে পারেন অবলীলায়। সাশ্রয় করতে পারেন নিজেদের অর্থনৈতিক দিকটাও। এর থেকে উত্তরণের উপায় হচ্ছে ইটভাটাগুলোকে ইট কারখানায় রূপান্তরিত করা।

এ ধরনের উন্নত প্রযুক্তির কারখানার নাম ‘ইকো ব্রিকফিল্ড’। এটি চালু করেছে ‘কিলন এনার্জি অল্টারনেটিভ’(সিইএ) নামের একটি বেসরকারি সংস্থা। ইট তৈরির কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে ‘হফম্যান কিন’নামক এক ধরনের উন্নত প্রযুক্তি। এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি তৈরি করেছে চীনের জিয়াং রিসার্চ অ্যান্ড ডিভাইস ইনস্টিটিউট অব ওরাল অ্যান্ড ম্যাটেরিয়ালস।

‘ইকো ব্রিকফিল্ড’ ও ধোঁয়াবিহীন ইট তৈরির ফলে মাটি সাশ্রয় হয় ৭০ ভাগ, খরচও কম।

জানা যায়, ধোঁয়াবিহীন ইট তৈরির প্রকল্পটি ইতিমধ্যে সাভারের ধামরাই উপজেলায় চালু হয়েছে। ইটভাটার মালিকদের উৎসাহিত করতে প্রকল্পটি হাতে নেয় ‘সিইএ’। এভাবে ইট তৈরিতে ধোঁয়ার সৃষ্টি না হওয়ায় কার্বনের ঝুঁকি নেই বললেই চলে। যে সামান্য  ধোঁয়ার সৃষ্টি হয় তা সংরক্ষণ করে আবার ব্যবহার করা যায় ড্রায়িং চেম্বারে। ইকো-ব্রিকফিল্ডের বেশ কয়টি আকর্ষণীয় দিক রয়েছে। যেমন মাটি সাশ্রয় হয় ৭০ ভাগ। ইট তৈরির উপযুক্ত মাটির সঙ্গে ৩০ ভাগ কয়লার গুঁড়া মিশিয়ে মন্ড তৈরি করে মেশিনের সাহায্যে টুকরো করা হয়। ওই টুকরোগুলো সরাসরি ড্রায়িং চেম্বারে ঢুকিয়ে দিলেই মাত্র ৯ ঘন্টার মধ্যেই ইট তৈরি হয়ে যায়। এতে কাঁচা ইট তৈরির ঝামেলা নেই মোটেই।

অন্যদিকে পুরনো পদ্ধতিতে ইট পোড়াতে সময় লাগে প্রায় ১৫দিন। শ্রমিকের প্রয়োজন পড়ে প্রচুর। তাতে অর্থ অপচয় হয় যেমনি, তেমনি দীর্ঘ সময় ধরে চিমনি দিয়ে নির্গত হতে থাকে কালোধোঁয়া। এর প্রভাবে পরিবেশের যে কী পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে তা অনুমেয়। বিশেষ করে সনাতনী পদ্ধতিতে ইট তৈরি করলে প্রতিটি ইটের পেছন খরচ হয় গড়ে সাত টাকা, আর ইকো-ব্রিকফিল্ডের মাধ্যমে খরচ পড়ে পাঁচ টাকা।

সুখবর হচ্ছে, ধোঁয়াবিহীন ইট তৈরিতে এগিয়ে এসেছে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএন ডিপি)। এর জন্য তারা হাতে নিয়েছে ‘হাইব্রিড হফম্যান কিন’প্রযুক্তি। এতে খরচ পড়বে মাত্র সাড়ে তিন টাকা। সংস্থাটি বাংলাদেশে পরীক্ষামূলকভাবে ১৫টি ‘এনার্জি ইফিশিয়েন্সি কিলন্স’স্থাপন করবে। আগামী পাঁচ বছর ধরে তারা এ পরীক্ষামূলক কাজটি করবে। জানা গেছে এ প্রযুক্তির মাধ্যমে এরইমধ্যে সাভার ও গাজীপুরের কয়েকটি কারখানা চালু করা হয়েছে। পদ্ধতিটি অব্যাহত থাকলে সনাতনী ইটভাটা ইটের কারখানায় রূপান্তরিত হবে।

গ্রীণ হাউস গ্যাস এবং বায়ু দূষণের কারণে উন্নত বিশ্বে এখন আর ইটের ব্যবহার করছে না। তারা বালু-সিমেন্ট ও পাথরের টুকরোর মিশ্রণকে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে ব্লক-কাদা মাটির সঙ্গে রাসায়নিক পদার্থ যোগ করে ইট তৈরি করছে। যা ওজনেও হালকা।

পরিবেশ অধিদপ্তর এ ব্যাপারে আধুনিক প্রযুক্তির হাইব্রিড হফম্যান কিল্ন, জিগজ্যাগ কিল্ন ও ভাটিক্যাল শ্যাফ্ট কিল্ন এবং অন্যান্য উন্নত প্রযুক্তির ইটভাটা তৈরি করতে মালিকদেরকে উৎসাহিত করেছে। তারা যদি এ সব উন্নত প্রযুক্তি গ্রহণ করেন তাহলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হবে অনেকটাই এবং লাভবান হবেন ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই। পাশাপাশি উপকৃত হবে দেশও জাতি। বেঁচে যাবে অসংখ্য গাছ-গাছালিও।

আলম শাইন: কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও বন্যপ্রাণী বিশারদ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর