সড়কে মৃত্যুর মিছিল ও পরিবহন সিন্ডিকেটের শৃঙ্খল

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান | 2023-08-29 20:28:29

গত ১৯ মার্চ ২০১৯ সকাল সাড়ে সাতটার দিকে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)-এর ছাত্র আবরার রাজধানী ঢাকার নর্দ্দায় যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে বাস চাপায় নিহত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে ওঠার জন্য জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় সুপ্রভাত পরিবহনের একটি বাসের অদক্ষ চালক তাকে চাপা দেয়। পুলিশের তথ্য মতে, শাহজাদপুরের বাঁশতলা এলাকায় এক পথচারী নারীকে ধাক্কা দিয়ে পালানোর সময় বাসটি এই দুর্ঘটনা ঘটায়।

এছাড়া গত ২৯ জুলাই ২০১৮ শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী দিয়া ও আর আগে গত ২১ জুলাই, ২০১৮ নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটির আহত ছাত্র পায়েলকেও পানিতে নির্মমভাবে ফেলে মৃত্যু নিশ্চিত করেছে পরিবহন শ্রমিক।

দুই

প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্সবিহীন মানুষের হাতে গাড়ি তুলে দেওয়া আর মানুষ খুন করার জন্য অস্ত্র তুলে দেওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। অথচ সেই কাজটিই অবলীলায় করে থাকে বেশ কিছু সিন্ডিকেটের সহায়তায় বিআরটিএ এবং পরিবহন মালিকেরা। দালাল, অসাধু কর্মকর্তা, সুবিধাভোগী সিন্ডিকেট মালিক-শ্রমিকের প্রভাব জেঁকে বসেছে বিআরটিএ’র ঘাড়ে।

৩০ জুন, ২০১৮ পর্যন্ত নিবন্ধিত ৩৪ লাখ ৯৮ হাজার ৬২০টি যানবাহনের বিপরীতে লাইসেন্সধারী চালক আছেন ১৮ লাখ ৬৯ হাজার ৮১৬ জন। যার অর্থ দাঁড়ায় দেশের ১৬ লাখেরও বেশি চালকের কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্সই নেই (৯ আগস্ট ২০১৮, ভোরের কাগজ)। এ দায়ভার কার?

একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না। সে কান্না একদিকে যেমন স্বজন হারানো পরিবারের তেমনি অন্যদিকে পরিবহন মালিকের। স্বাভাবিকভাবেই দুর্ঘটনার পর বিক্ষুব্ধ জনতা যানবাহনটিকে ভেঙে ফেলে, পুড়িয়ে দেয়। কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয় পরিবহন মালিকের, রাষ্ট্রের। পরিবহন মালিক মানেই উচ্চবিত্ত কোটিপতি নন। বেশি সুদে ঋণ করে। স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি-সম্পদ বিক্রি করে, স্ত্রী, পরিবারের স্বজনদের গহনা বিক্রি করে, বন্ধক রেখে কোটি টাকার পরিবহন রাস্তায় নামায় সংসার পরিচালনার জন্য।

অথচ প্রত্যেক দুর্ঘটনায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যানবাহনটি বড় ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মালিক সর্বস্বান্ত হন। সেই মালিকদের যেখানে অধিকমাত্রায় সচেতন থাকার কথা ছিল, তারাও যাচাই-বাছাই ছাড়াই অদক্ষ একজনের হাতে গাড়ি তুলে দিয়ে নিজের জন্য দুর্ভাগ্য ডেকে আনেন। সড়ক নিরাপদ হলে সবার আগে তো মালিক-শ্রমিকেরই লাভ। সেটা নতুন করে তাদেরকে ভাবতে হবে। অবাক করা বিষয় হলো, সারাদেশ জুড়ে পরিবহন সেক্টরের বহুমুখী ক্ষমতাশালী সিন্ডিকেটের কাছে রাষ্ট্রযন্ত্র যেন শৃঙ্খলিত বলে মনে হয়।

তিন

গত বছর নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের সময় ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির দুইটি সংবাদ সম্মেলন থেকে বেশ কিছু অসাধারণ বিষয় উঠে এসেছে। যেমন:

(১) ঢাকা শহরের পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে ৩০-৩৫ শতাংশ মাদকাসক্ত (যদিও বাস্তবে আরেও বেশি)।

(২) বাস ভাঙচুর করা ও সম্পূর্ণভাবে জ্বালিয়ে দেওয়ার ভয়ে নিরাপত্তাহীনতার কারণে মালিকরা গাড়ি নামাতে নিষেধ করেন।

(৩) বাস মালিকেরা পরিবহন শ্রমিকদের কাছে একরকম জিম্মি।

(৪) বেশ কিছু মালিক পরিবহন শ্রমিকদের চুক্তিতে বাস চালাতে দেওয়ায় বেশি মুনাফার জন্য বাসগুলো সড়কে রেষারেষির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় (০৪ আগস্ট ২০১৮, প্রথম আলো)।

(৫) সড়ক পরিবহন আইনকে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক কর্তৃক বাধ্যতামূলকভাবে মান্য করা ।

(৬) যে কোম্পানি চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালানো বন্ধ করবে না কিংবা আইন মানবে না সমিতির আওতায় হলে তার লাইসেন্স বাতিল করার জন্য সমিতি সুপারিশসহ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে।

(৭) প্রতিটি বাস টার্মিনালে গাড়ি ফিটনেস সনদ, চালকের লাইসেন্স সমিতি অব্যাহত অভিযানের মাধ্যমে চেক করবে এবং কাগজপত্রের ঘাটতি থাকলে তাকে চলতে দেওয়া হবে না।

(৮) চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালানো বন্ধ করতে সড়কের পাশে টিকিট কাউন্টারের ব্যবস্থা রাখার জন্য সিটি করপোরেশনকে আহ্বান জানাবে (৮ আগস্ট ২০১৮, ভোরের কাগজ।)।

এগুলোর কোনোটিরই তারা নিজেরা বাস্তবায়ন করেছে বলে মনে হয় না।

চার

এখানে বেশ কিছু বিষয় ভেবে দেখা দরকার। যেমন:

(ক) অনেক দুর্নাম নিয়ে পরিচালিত বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) কে সময়ের প্রয়োজনে গঠনমূলকভাবে আমূল পরিবর্তন করা এবং নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী সকল সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া জরুরি।

(খ) যানবাহনগুলোতে অতিরিক্ত যে ভাড়া আদায় করা হয় তা বন্ধ করার জন্য নির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা ও তার সঠিক বাস্তবায়ন হওয়া জরুরি।

(গ) গাড়ির চালক নির্বাচনে পরিবহন মালিককে অধিকমাত্রায় সচেতন হতে হবে।

(ঘ) বয়স্ক নাগরিক ও প্রতিবন্ধী জনগণকে সম্পূর্ণ ফ্রি এবং শিক্ষার্থীদের জন্য সারা বাংলাদেশে অর্ধেক ভাড়া নির্ধারণ করা জরুরি ।

(ঙ) পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি, পরিবহন মালিক ও শ্রমিকের সমন্বয়ে ‘বিশেষ ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ টিম’ ঢাকাসহ সকল বিভাগীয় শহর এবং হাইওয়েগুলোতে কাজ করলে অনেক উপকার হবে।

(চ) সড়কের পাশে পথচারীদের জন্য দখলমুক্ত, পার্কিংমুক্ত উন্মুক্ত ফুটপাত দরকার।

(ছ) সড়কের ব্রিজগুলোতে টোল আদায়ের বিকল্প সম্মানজনক পথ বের করা জরুরি।

(জ) পথে পথে পরিবহনে চাঁদাবাজি, যাত্রী হয়রানি বন্ধ করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

(ঝ) চালকসহ অন্যান্য শ্রমিকদের বেতন ভাতা বৃদ্ধি করাসহ পর্যাপ্ত বিশ্রামের মানবিক ব্যবস্থা করা এবং দূরপাল্লার যাত্রায় অবশ্যই দুইজন চালক রাখা দরকার।

চোখ বন্ধ করলে চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন, মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং সদ্য প্রয়াত ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক ছাড়া যানজট ও সড়ক পথের দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে আর তেমন কাউকে সরব হতে দেখা যায়নি কখনো। পারস্পরিক দোষারোপ না করে পরিবহন মালিক-শ্রমিক এবং যাত্রী হিসাবে জনগণকে নিজেদের ভুল-ক্রটি সম্পর্কে অবগত ও সচেতন হতে হবে।

অনেক সময় পরিবহন শ্রমিকও ‘ট্রাফিক সিগনাল’ এবং সড়ক আইন মান্য করে না । মান্য করলে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে পার হওয়ার সময় আবরারকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হত না। ভুক্তভোগী পরিবারকে দ্রুত ক্ষতিপূরণ দেওয়া; নিরাপদ সড়ক, পরিবহন ও যাত্রীসেবা নিশ্চিত করা; সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা এবং সকলকে তা বাধ্যতামূলকভাবে মান্য করা সময়ের দাবি।

মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান: পি.এইচ.ডি গবেষক, ঝেজিয়াং ইউনিভার্সিটি, চীন এবং শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর