ঊন মানুষ!

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

তুষার আবদুল্লাহ | 2023-08-26 18:15:37

আমরা কে শ্বেত পূজারী নই? নিত্য প্রাত্যহিক জীবনে ফর্সার পেছনে আমাদের ছুটে চলা। সাদা’র প্রতি যে শুধু রং হিসেবেই আমাদের দুর্বলতা তাই নয়। আমরা ফর্সার অধীনে থাকাতে, তাদের সঙ্গে লেপ্টে থাকতে অহংবোধ করি। এই মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান শুধু বাংলাদেশসহ ককেশীয়, দ্রাবিড় অঞ্চলের মানুষদেরই নয়, ভূ-গোলকের যারা যখন শ্বেত আধিপত্যের দাস ছিল, তখন থেকেই রাজার রং পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তাদের মধ্যে তৈরি হয়।

আফ্রিকার অধিবাসীদের রং আমাদের মতো তামাটে নয়, কালো রং ফর্সাকারী ক্রিম মেখেও তাদের ত্বকে ফর্সার আবহ আনা সম্ভব হবে না। তবু তাদের আকাঙ্ক্ষা যদি শ্বেত প্রভুদের রঙে রাঙা হওয়া যায়! তা হয়ে ওঠা হয় না। তামাটে-কালো রংকে ফর্সা বানানোর এতো যে ভেষজ এবং রাসায়নিক মাখন এবং গুঁড়ো, উৎপাদন ও বিপণনকারীরা কি তা খামোখাই বাজারে এনে ঢালছে, শুধুই কি বিজ্ঞাপনের মোহ? মোটেও তাই নয়।

এই যে শ্বেতরা লাখ লাখ কালো কালো দাস হত্যা করল, আফ্রিকার খনিজ এলাকায় এখনো চলছে আধিপত্য, সম্পদ সরিয়ে নেয়ার জন্য যুদ্ধ সাজিয়ে রাখা, আমাদের মতো দেশ গুলো শুষে নিয়ে যাওয়া, তারপরও আমরা সকাল সন্ধ্যে তো তাদের বীরগাঁথা শোনাই আমাদের সন্তানদের। তাদের শ্বেত ঘনিষ্ঠ হবার, প্রভুর কৃপা পাওয়ার সহজপাঠ ইংরেজি মাধ্যমে নিমজ্জিত করলাম আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে। অর্থাৎ একথা প্রমাণিত যে আমাদের নিজস্ব মগজে আমরা পূর্ণ মানুষ হতে পারিনি। গোটা মানুষ তারাই যারা শ্বেত। আমরা ঊণমানুষ।

মগজে নিজেরাই যখন ঊন মানুষ হয়ে আছি, সেখানে শ্বেত প্রভুরা উদ্বিগ্ন কেন? ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী এখন আর উড়োজাহাজের শ্লোগানে নেই। সত্যিই প্রযুক্তি পৃথিবীকে এক উঠোনে এনে ফেলেছে। এক উঠোনের বাজারে চলছে ভাগাভাগির খেলা। সেখানে আলসে শ্বেতাঙ্গরা পিছিয়ে পড়েছিল। বঞ্চিত, ক্ষুধার্ত দাসদের সঙ্গে তারা পেরে উঠছিল না। আড়মোড়া ভেঙ্গে দেখতে পায় বাজার আর খাবারের থালায় শরণার্থী মানুষেরা ভিড় করেছে। ধীরে ধীরে দখলে নিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর ক্ষমতা তামাটে, কালোরা দখলে নিচ্ছে আলগোছে। তখন কি আর বসে থাকা যায়। তারা ফিরতে শুরু করলো আদি রূপে। ধর্মের নামে রঙের দোষে যে হত্যার ইতিহাস তাদের আছে, সেখানেই ফিরতে শুরু করে তারা। হিটলারের উত্তরসূরি কি কোন কালে অনুপস্থিত ছিল? ছিল কেউ দৃশ্যমান, কেউ আড়ালে।

শ্বেত সম্রাট ট্রাম্প আড়ালে থাকতে চাননি। তিনি ড্রামের বাড়ি দিলেন প্রকাশ্যে। শ্বেতরা এক হও। চলো ফিরিয়ে আনি আমাদের একজোটের আধিপত্য। প্রতিহিংসার লড়াই কখনো থামেনি। এই ড্রাম বাদ্য শুধু তুঙ্গে তুলে দিলো আরকি। কোন কোন সুপ্ত আগ্নেয়গিরিকে জাগিয়ে দিলো। প্রতিহিংসার বিপরীতে প্রতিশোধ, প্রতিরোধও চলছে। জ্বালানি হিসেবে কাজ করছে বর্ণ ও ধর্ম বিদ্বেষ।

এই প্রতিহিংসারও নানা রূপ। এই রূপ গুলো গণমাধ্যমে আসছে নিজ নিজ মতলব মতো। শ্বেতদের আধিপত্য থাকা গণমাধ্যমকে আমরা পূঁজো করতে ভালোবাসি। তাই নিশ্চিন্তে তাদের প্রপাগান্ডা বিশ্বাস করে যাই। সুতরাং তারা গণহত্যাকে যেচোখে দেখাতে চায় আমরা সেই ভাবেই দেখি। প্রশ্ন, সন্দেহ তৈরি হলেও আমরা তাকে নিজের মগজে রেখে দেই। শ্বেতের সঙ্গে আড়ি নেবার ইচ্ছে নেই। সম্পর্কটা বরং আরো গাঢ় হোক, তাই তার প্রচারিত বানীতেই আমাদের অন্ধ সম্মতি। ফলে আমাদের ভূ-খণ্ডসহ বিশ্ব জুড়ে মুসলমানদের সন্ত্রাসী এবং জঙ্গী প্রমাণে তারা সফল। আর আমরা তাদের হত্যাকারীদের মানসিক বিকারগ্রস্থ বলে, দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছি।

আসলে সমস্যাটি হলো আমাদের মগজে যতক্ষণ প্রভুত্ববাদের জলছাপ থেকে যাবে, ‘দাস’ অবস্থান থেকে চিন্তায় আমাদের উত্তরণ ঘটবে না, ততদিন আমাদের গোটা মানুষ হওয়া হয়ে উঠবে না। ‘ফর্সা’র খাদেম হওয়াই আমাদের জন্মলাভের উপলক্ষ্য।

তুষার আবদুল্লাহ: বার্তা প্রধান, সময় টেলিভিশন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর