শিক্ষার আত্মহত্যা ও আমাদের ভবিষ্যৎ

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

দিল্লুর রহমান | 2023-09-01 04:14:30

১...

রবীন্দ্রনাথের "তোতাকাহিনী" গল্পে পাখিটির উচিৎ শিক্ষা হয়েছিল। আমাদেরও এখন উচিৎ শিক্ষাই হচ্ছে! কেমন শিক্ষা? রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- 'আমাদের জীবিকা নির্বাহের সাথে এই শিক্ষার কোনো সম্পর্ক নাই। আমরা যে সমাজে বাস করি তার উন্নত কোনো চিত্র আমাদের পাঠ্যপুস্তকে নাই। দেশের মাটি ও জল এই শিক্ষায় অনুপস্থিত। বর্তমান যা আছে তা মূলত ঔপনিবেশিক শিক্ষা।'

ব্রিটিশরা তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থে এবং অনুগত কর্মচারী তৈরির লক্ষ্যে এই শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের দেশে চালু করে গেছে। ফলে স্বনির্ভর হওয়ার বদলে আমরা হয়েছি পরনির্ভর। ঔপনিবেশিক সেই দাসত্ব থেকে আজও আমাদের মুক্তিতো মেলেনি বরং শিক্ষাব্যবস্থার ঔপনিবেশিক কর্পোরেট চরিত্র প্রতিনিয়তই দানবীয় আকার ধারণ করছে। ফলে শিক্ষাব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে উন্নয়নের মানচিত্র আঁকা জলশূন্য কলসের নামান্তর।

কোনো রাষ্ট্রের জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, মানব সম্পর্ক তথা সামগ্রিক উন্নয়নের উৎকর্ষতা নির্ভর করে তার শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। তারা কী শিখছে, কোন পদ্ধতিতে শিখছে, সেই শিক্ষার সঙ্গে জীবন-জীবিকা, প্রাণ-প্রকৃতির মিল কতটুকু এই সমস্ত বিষয়ই শিক্ষা ও বাস্তব জীবনের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপন করে। তখনই শিক্ষা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয় এবং গোটা জাতি পরিণত হয় এক জাতিতে। জীবনের রীতিনীতির সাথে মিল না থাকায় শিক্ষা হয়ে ওঠে চরম বিরক্তির কারণ যার চূড়ান্ত পরিণতি এখন ছাত্রদের আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করছে বলা যায়।

২...

প্রতিটি অঞ্চলের আলাদা ভৌগলিক ও সামাজিক বৈশিষ্ট্য যেমন আছে তেমনি আছে তার অর্থনৈতিক উৎপাদন ব্যবস্থার ভিন্নতা। সেখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়ন্ত্রিত হয় ঐ অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী। ফলে ইউরোপ-আমেরিকার ভূগোল, সমাজ ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের সাথে বাংলার যেমন মিলে না তেমনি বাংলার এক অঞ্চলের সাথে অন্য অঞ্চলের উৎপাদন ব্যবস্থা ও জীবন মানের ভিন্নতাও লক্ষ্য করা যায়।

শুধু সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে গোটা পৃথিবীর মোট জিডিপির ৩০ ভাগ আসত ভারতবর্ষ থেকে। তখন বাংলাই ছিল সর্বোচ্চ মাথাপিছু আয়ের দেশ। এর কারণ বাংলার বস্ত্রশিল্প ও কৃষি। আর কৃষিক্ষেত্রে আশীর্বাদ হচ্ছে এখানকার অসংখ্য নদ-নদীবাহিত পলি।

এখানকার এক গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র প্রতিবছর যে ১৬৭ কোটি টন পলি বহন করে ইউরোপ আমেরিকার সব নদী মিলে তা করে না। শুধু তাই নয় চট্টগ্রাম থেকে চিলমারী ছিল আন্তর্জাতিক নৌ-বাণিজ্যের রুট এবং জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য বিখ্যাত। এই জাহাজ নির্মাণের নেপথ্যে ছিল সম্পূর্ণ স্থানীয় কারিগররা যাদের আমরা অশিক্ষিত বলি। কোনো প্রকার কলের যন্ত্র ছাড়াই দেশীয় হাতুড়ি, বাটালি ও করাতের তৈরি এইসব জাহাজ এত উন্নত ছিল যে মধ্য যুগের রোমান ও তুরস্কের সম্রাটগণ চট্টগ্রাম থেকে তৈরি জাহাজ কিনতেন। এই হচ্ছে আমাদের অর্থনীতিতে সমৃদ্ধির ইতিহাস। তখন আমাদের কর্মক্ষেত্রের কোনো অভাবও ছিল না, তরুণদের এতটা হতাশাও ছিল না। সব অভাবের আমদানি ১৭৫৭ এর পর থেকেই।

যেহেতু মেধা অর্জন, দক্ষতা বৃদ্ধি ও উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে অংশীদার হওয়ার জন্যই শিক্ষার প্রয়োজন এবং হাজার বছর ধরে অন্তত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের মধ্যভাগ পর্যন্ত সেই সক্ষমতা আমরা দেখিয়েছি সুতরাং আমাদেরও একটা নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থা আছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের ইতিহাস শুরু হওয়ার আগে জীবন-জীবিকার সাথে সম্পর্কযুক্ত সেই শিক্ষাই আমরা নিয়েছি। যার দরুন বাংলার সমৃদ্ধি গোটা পৃথিবীর নজর কেড়েছিল। যার প্রমাণ তাবৎ দুনিয়ার বণিকদের আনাগোনা। এই শিক্ষা আমাদের দেশজ শিক্ষা। যেমন চট্টগ্রাম-চিলমারীর জাহাজ নির্মাণ কারিগরদের শিক্ষা।

ব্রিটিশরা এই দেশে তাদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য হিসেবে দেশীয় অনুগত আমলা তৈরির উদ্দেশ্যেই-প্রাচীন, অকার্যকর, অনর্থনৈতিক অভিযোগ তুলে উন্নত শিক্ষার ধারণা চাপিয়ে এই দেশজ শিক্ষা ও উৎপাদন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়। অথচ এই দেশীয় ব্যবস্থাই আমাদের হাজার বছর ধরে টিকিয়ে রেখেছে। আজকে যাকে আমরা আধুনিকতা বলি তার জন্মতো ২৫০ বছর মাত্র! তারা উচ্চশিক্ষার নামে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে; যেখানে শিক্ষা দেয়া হত ইংরেজি মাধ্যমে। যা পড়ানো হত সেই বিষয়বস্তুও ইউরোপ থেকে আমদানি করা। এমনকি ইংল্যান্ডে ইংরেজি সাহিত্য পড়ানোর আগে ভারতবর্ষেই পড়ানো শুরু হয়েছিল। এভাবেই দেশের ভাষা ও মানুষের সাথে শিক্ষার বিচ্ছেদ ঘটলো আধুনিক নাম ধারণ করে।

তৎকালীন রসায়নবিদ রাজশেখর বসু স্বীকার করেছেন, 'তখন উচ্চ শিক্ষা বলতে কেবল ইংরেজি সাহিত্য ও ইতিহাসকেই বুঝানো হত।' ব্রিটিশরা দাফতরিক ও আদালতেও ইংরেজি ভাষার প্রচলন করল তাদের শাসনকার্যের সুবিধার জন্য। বিজ্ঞান শিক্ষার বদলে ইউরোপীয় শিক্ষা-সংস্কৃতি চালু করে মূলত তাদের অনুগত কর্মচারী তৈরি করাই ছিল ব্রিটিশদের কথিত উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য। আর এ কাজে ব্রিটিশদের সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগরের মতো আমাদের রেনেসাঁস পুরুষরা।

৩...

আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাও ওই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শিক্ষার উত্তরাধিকার। যা পড়া মুখস্থ করা, পাশ করা আর সরকারি চাকরি করার প্রবণতাই তৈরি করছে শুধু। স্বনির্ভর-স্বাবলম্বী হওয়া গবেষণার দ্বারা নতুন জ্ঞান উৎপাদন করা, দেশের বিভিন্ন সমস্যা খুঁজে তার সমাধান দিতে পারছে না এই শিক্ষিত শ্রেণি। বরং চাকরি পাওয়াই এখন পরম আরাধনার বিষয়। এটিও মূলত ওই ঔপনিবেশিক শিক্ষারই ফল।

প্রাবন্ধিক তপন রায় চৌধুরীর বর্ণনায় পাওয়া যায়, 'প্রাক-ঔপনিবেশিক বাঙালি নারীর প্রার্থনার বিষয় ছিল- প্রথম সন্তান হিসেবে যেন একটা সুস্থ-সবল ছেলে সন্তান হয়। অন্যদিকে ঔপনিবেশিক সমাজে এই প্রার্থনা পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়ায়- ছেলে যেন ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে সরকারি চাকরি পায়।' এই চাওয়া একেবারেই অযৌক্তিক নয়। কেননা এমএ, বিএ পাশ করেও যে কৃষি বা অন্যান্য গ্রামীণ পেশা অবলম্বন যায় এই শিক্ষাটুকু কোন শিক্ষালয় আমাদের দিচ্ছে না বরং এক ধরনের অহং তৈরি করছে।

ফলে চাকরির প্রবণতা যে হারে বাড়ছে গুণিতক হারে কমছে চাকির ক্ষেত্র। যা তরুণদের হতাশাগ্রস্ত করছে দিন-দিন। বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতাও। এমন অবস্থায় শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে প্রায়োগিক শিক্ষা, কৃষি, স্থানীয় বাজার, গ্রামীণ কারিগরি অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা না হলে সত্যিকার অর্থেই তরুণদের হতাশা থেকে বাঁচানো সম্ভব নয় এবং স্বনির্ভর জাতিগঠনও অসম্ভব।

প্রয়োজনে এলাকাভিত্তিক স্থানীক তথ্য অনুসন্ধান কেন্দ্র খুলতে হবে যেখানে ছাত্ররা কৃষকদের বৈজ্ঞানিক কৃষিসহ অন্যান্য বিষয়ে পাঠদান করবে এবং কর্পোরেট জ্ঞানের পরিবর্তে কৃষকদের পরম্পরাপ্রাপ্ত জ্ঞানও তারা শিখবে। তখন স্থানীয় সমস্যা স্থানেই সমাধান সম্ভব হবে। তা না হলে একদিকে প্রায় ৯৮ ভাগ ধনী নিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা আরেক প্রান্তে ৭০.৮৭ ভাগ দারিদ্র নিয়ে কুড়িগ্রাম জেলার মত বৈষম্যের ইতিহাস লেখা হতেই থাকবে।

অথচ ১৯১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী একটি নৌ-বন্দর ও দুইটি স্থলবন্দর নিয়ে অর্থনীতি সমৃদ্ধ এই কুড়িগ্রামেই অখণ্ড বাংলার সবচেয়ে বেশি অভিবাসীর আগমন ঘটেছিল। আমাদের ফিরতেই হবে সেই দেশজ শিক্ষায়!

৪...

ব্রিটিশরা আমাদের শুধু অর্থনৈতিকভাবেই শোষণ করেনি বরং তাদের প্রণীত শিক্ষার মাধ্যমে আমাদের মনোজগতকেও তাদের ধাঁচে গড়ে দিয়ে গেছে। ফলে তাদের শেখানো চিন্তার বাইরে আমরা কোনো মৌলিক চিন্তাও করতে পারছি না।

আমরা দেশজ শিক্ষা বাদ দিয়ে অন্ধভাবে তাদের অনুসরণই করে যাচ্ছি, সমস্যার উৎস খোঁজারও চেষ্টা করছি না। ব্রাজিলিয়ান শিক্ষাবিদ পাওলো ফ্রেইরে এই ধরনের শিক্ষাকে 'শিক্ষার ব্যাংকিং ধারণা' বলে অভিহিত করেছেন। এই ধরনের সৃজনক্ষমতাহীন শিক্ষায় ছাত্ররা আজ বাক্সে পরিণত হয়েছে যে বাক্স পূর্ণ করার দায়িত্ব শিক্ষকদের।

ফলে আমরা দিনে দিনে যান্ত্রিক হয়ে উঠছি, হারিয়ে ফেলছি মানবিকতা। তারুণ্যকে বাঁচাতে হলে এই ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে সম্পূর্ণ দেশজ শিক্ষাধারা প্রচলন করতে হবে। যা হবে মুখস্ত বিদ্যার বিপরীতে গবেষণা কেন্দ্রিক এবং দেশীয় উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত, স্থানীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত। তবেই 'শিক্ষা' নিশ্চিত করবে আমাদের কর্মক্ষেত্র, তৈরি হবে সোনার মানুষ। আর তখনই তরুণেরা বলে উঠবে, 'ও বাঙাল, কে যাবে বাঙলা ও তার গলি ছেড়ে!'

দিল্লুর রহমান: সদস্য রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি, কুড়িগ্রাম জেলা শাখা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর