দুর্নীতির দর্শন ও উপলব্ধি

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ফরিদুল আলম | 2023-08-27 07:02:04

টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার দুর্নীতি এবং মাদক নির্মূলে তার অনড় অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। দেশে দুর্নীতি বেড়েছে- ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনকে যথেষ্ট তথ্যনির্ভর নয় বিবেচনায় প্রত্যাখ্যান করলেও দুর্নীতি যে আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্রের এগিয়ে যাবার পথে এই মূহূর্তে বড় হুমকি, সেটা নিশ্চয়ই সরকার অস্বীকার করছে না। আর সেজন্য বোধহয় সরকার প্রধান তার ভিশন ২০২১ এবং ২০৪১ বাস্তবায়নের পথে এটিকে বড় বাঁধা হিসেবে বিবেচনা করছেন। একইসঙ্গে মাদক, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদের মতো বিষয়গুলোও একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে সম্পৃক্ত।

আমরা নতুন সরকারের যাত্রার শুরুতেই মুগ্ধ হয়ে কিছু বিষয় লক্ষ্য করেছি। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- মাঠ পর্যায়ের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নেই এবং জনবিচ্ছিন্ন এমন কাউকে এবারের সরকারের মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া হয়নি। আগের মন্ত্রিসভার চেয়ে এবারের মন্ত্রিসভার সদস্যদের সরকারি কাজে অভিজ্ঞতা কম থাকলেও তাদের ক্লিন ইমেজকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছে। শপথ নেওয়ার পর তাই মন্ত্রিসভার সদস্যদের সরকারি সম্পদের ব্যবহারে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে দেখা গেছে। জাতির জনকের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা, টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারত, জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কাজে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের একক গাড়ীর পরিবর্তে বাস ব্যবহার করতে দেখা গেছে, যা নিঃসন্দেহে প্রসংসনীয়।

এর বাইরে কিছু মন্ত্রী এককভাবে কিছু দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, যেমন একজনকে দেখা গেছে সরকারি গাড়ীর পরিবর্তে মোটরসাইকেলে করে অফিসে যেতে, আরেকজন জানিয়েছেন তিনি সরকারি দায়িত্ব পালনের বাইরে এবং সরকারি ছুটির দিন সরকারি গাড়ীর পরিবর্তে নিজের গাড়ী ব্যবহার করেন। এই সব বিষয় একদিকে যেমন একটি সুন্দর আগামীর স্বপ্ন আমাদের চোখে তুলে ধরে, আবার কিছু শঙ্কারও জন্ম দেয় যে এসব কি শুধু লোক দেখানো সস্তা প্রচারের জন্য নাকি প্রধানমন্ত্রী নির্দেশিত একটি সুখীসমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে তাদের আন্তরিকতার প্রকাশ। এসব কিছুর পরও আমরা ইতিবাচক থাকতে চাই এবং বিশ্বাস করতে চাই যে, একটি সুন্দর সূচনা অব্যাহত থাকবে।

সম্প্রতি প্রকাশিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্ট্রন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণাসূচক প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়েছে যে, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে দেশে দুর্নীতি বেড়েছে এবং ৩ ধাপ অবনমন হয়ে বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের ১৩ তম শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্থ দেশে পরিণত হয়েছে। সরকার অস্বীকার করলেও এবং এই প্রতিবেদনের সত্যতা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকলেও তারা দুর্নীতির যে দু’টি মূল কারণ উল্লেখ করেছে সেটা নিয়ে নিশ্চয়ই কারও মধ্যে সন্দেহ থাকার কথা নয়। কারণ দু’টি হচ্ছে, এক, সরকারি কাজে আর্থিক দুর্নীতি এবং দুই, ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে দুর্নীতি। আমরা দুর্নীতির আরও অনেক ছোটখাট নজির দেখলেও উল্লিখিত কারণগুলো নিয়ে সবাই কমবেশি ভুক্তভোগী এটা বলার অপেক্ষে রাখে না।

বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন এবং প্রতিরোধে একটি স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন রয়েছে। তবে এই স্বাধীনতা কেবলমাত্র ‘কাগুজে স্বাধীনতা’ নাকি বাস্তবে কমিশন তার কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে গিয়ে স্বাধীনভাবে তাদের স্বাধীনতার চর্চা করতে পেরেছে সেটা নিয়ে রয়েছে বিস্তর প্রশ্ন। একজন সাবেক এসিসি চেয়ারম্যান তার দায়িত্ব পালনকালে ক্ষোভ থেকে একে ‘দন্তবিহীন বাঘ’ বলে বর্ণনা করেছিলেন।

সেই থেকে এখন পর্যন্ত কমিশন তাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠলেও এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কিছু দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের সরকারি কাজে দুর্নীতি কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। বিভিন্ন সময়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কমিশন অফিসে তলব করা হলেও সরকারি দলের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত তাদের ক্ষেত্রে এবং বিরোধী দলের রাজনীতির সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত তাদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে আচরণের ভিন্নতা। এই ধরণের অসন্তোষ আমাদের সমাজে কম নয়। এর উর্ধ্বে উঠে দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে হলে দুদকের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি আর দুদকের কাছ থেকে দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করতে হলে সরকারকে এই মর্মে নিশ্চয়তা দিতে হবে যে দুদকসহ অপরাপর স্বাধীন কমিশনের কর্মকাণ্ডে সরকার কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করবে না।

টিআইবি প্রতিবেদন এবং দুদকের কর্মকাণ্ডের বাইরে গিয়ে আমরা যদি দুর্নীতিকে আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে বিশ্লেষণ করতে যাই তবে আমাদের সামনে সমাজের এক করুণ চিত্র উঠে আসবে। আমাদের সমাজ জীবনের প্রতিটি স্তরে আমরা দুর্নীতিকে এক অনিবার্য বাস্তবতা মেনে নিয়েই আমাদের প্রতিদিনের জীবন নির্বাহ করে যাচ্ছি। আমাদের সন্তানরা যেসব বিদ্যালয়ে পাঠগ্রহণ করছে, সেখান থেকে তারা তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষকদের যেভাবে দেখছে, তাদের কোমল মেজাজে তখন থেকেই বাসা বেঁধে বসে যে এটাই সমাজের বাস্তবতা। শিক্ষাজীবনের শেষ স্তর বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা ভিন্ন আঙ্গিকে একই চিত্র দেখে যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করে ততদিনে এটা স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিতে শিখে যায় যে কেবল মেধার বিচারে সরকারি চাকুরিপ্রাপ্তি সহজ বিষয় নয়, চাই অন্যকিছু, অর্থবিত্ত কিংবা প্রভাবের জোর।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী ক্ষোভের সঙ্গে জানতে চেয়েছেন যে সরকারি কর্মচারীদের বেতন দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি করার পরও কেন দুর্নীতি হবে? আমার বিশ্বাস তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে জানতে চাইলেও তিনি বেশ ভালোভাবেই জানেন যে পুরো বিষয়টিই এখন এমন একটি কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে, যা ভেঙে দেওয়া সহসা সম্ভব নয়। সরকারের সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্য দিয়ে একমাত্র এর প্রতিকার হতে পারে। আর সেজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সরকার প্রধানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আন্তরিকতার ক্রমাগত বহিঃপ্রকাশ।

রাজনৈতিক সদিচ্ছার কথা যদি ব্যাখ্যা করতে হয় তাহলে অপ্রিয় যে সত্যটি আমাদের উচ্চারণ করতে হয় তা হচ্ছে রাজনীতি এখন আর জনসেবার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি একটি ব্যবসাভিত্তিক পেশসায় পরিণত হয়েছে। বাধ্য হয়ে বলতে হচ্ছে ক্ষমতাসীন রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা বর্তমানে আমাদের সমাজে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত। যেকোনো সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে তাদের উপস্থিতি আমাদের বিশেষভাবে আহ্লাদিত করে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণে তাদের প্রভাব আজ এমনভাবে স্বীকৃত যে এটিকে এখন আর খুব একটা নেতিবাচকভাবে দেখা হয় না।

দুর্নীতির যে মূল দু’টি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, সেটা নির্মূল করা কোনোভাবেই সম্ভব নয় যদি আমরা রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নকে প্রতিহত না করি। আমরা প্রতিটি নির্বাচনী রাজনীতিতে যেভাবে টাকার দাপট লক্ষ্য করছি তা রীতিমত আমাদের ভাবিয়ে তোলে এই অর্থের উৎস কোথায়? আবার যারা এত অর্থের বিনিয়োগ করে তাদেরই বা স্বার্থ কি? এই সবকিছু আমাদের সামনে নির্মম সত্য হয়ে ধরা পড়ে যখন আমরা সরকারি চাকরি বা সেবা নিতে যাই। তাহলে কি এই দাঁড়ায় না যে রাজনীতিকে আমরা পেলেপুষে একে নিজেদের পায়ে কুঠারাঘাত করছি? যে রাজনীতির জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকার কথা, সেই রাজিনীতির কাছে উল্টো জনগণকে সমর্পিত হতে হচ্ছে।

রাজনৈতিক সদিচ্ছা হচ্ছে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন প্রতিরোধে একমাত্র কার্যকর ঔষধ আর সেটার জন্য ক্ষমতাসীন দলসহ সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করতে হবে। রাজনীতিকে ‘পেশা’র খোলস থেকে মুক্তি দিয়ে একে এর মুল চেতনায় ফিরিয়ে আনতে হবে।

একটি সমাজে দুর্নীতি সহসা তার ভিত গড়ে না, একথা যেমন সত্য, এর বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তা এবং একে মেনে নেবার প্রবণতা এর ডালপালা বিস্তারে প্রণোদনা যোগায়- এটা আরও বড় সত্য। তাহলে যা দাঁড়াচ্ছে তা হলো- শুধু সরকারের একক প্রচেষ্টা নয়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সকলের যার যার নিজস্ব জায়গা থেকে সম্মিলিত প্রয়াস ব্যতীত একে রোধ করা সম্ভব নয়। আমাদের এটাও মানতে হবে যে দুর্নীতি সহসারোধ করাও সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদী কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং এর যথাযথ বাস্তবায়ন।

ফরিদুল আলম: সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর