বই পোড়ানোর চেয়েও বড় অপরাধ বই না পড়া

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মাছুম বিল্লাহ | 2023-08-31 02:06:55

২০১৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আমাদের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ঘোষিত হয়েছে ‘জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস’। নি:সন্দেহে এটি একটি ভালো উদ্যোগ। এবার জাতীয় গ্রন্থাগার দিবসের শ্লোগান হচ্ছে ‘গ্রন্থাগারে বই পড়ি, আলোকিত মানুষগড়ি’। প্রথম বছরের শ্লোগান ছিল ‘বই পড়ি, স্বদেশ গড়ি’। বই আমাদের কেন পড়তে হবে? বই না পড়লে চাকরি বাকরি পাওয়া যাবে না, কর্মসংস্থান হবেনা? বিষয়টি তা নয়।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অবশ্যই জরুরি ও অপরিহার্য। সেটি করতে হবে এবং ভালো করেই করতে হবে। কিন্তু তার সাথে সাথে যে পাঠ আমাদের জ্ঞান সীমানা সম্প্রসারণ করতে, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে জানতে, বিশ্বজগতের সৃষ্টি রহস্য, বিশ্বের ইতিহাস, জ্ঞান বিজ্ঞানের অগ্রগতি, বিশ্বের সেরা চিন্তাবিদদের চিন্তা-ভাবনা, জীবন-দর্শন, রাজনীতি-অর্থনীতি-দর্শন ইত্যাদি জানতে সহায়তা করে সেই পাঠের সাথে আমাদের যুক্ত থাকতেই হবে। এটিই প্রকৃত জ্ঞানার্জন, প্রকৃত পড়া।

বই আমাদের মনের পুষ্টি জোগায়, মনকে উদার ও মানবিক করে তোলে, জীবনের শ্বাশত সৌন্দর্য উপলব্দি করতে এবং মানুষকে ভালবাসতে শেখায়। মার্কিন লেখক ব্রাডবেরি বলেছেন, ’একটি সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে তোমাকে বই পোড়াতে হবে না। স্রেফ মানুষের বই পড়া বন্ধ করতে পারলেই হলো। তার মানে হলো আমরা যদি বই না পড়ি তাহলে আমাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি আপনা-আপনিই ধ্বংস হয়ে যাবে, কোনো যুদ্ধবিগ্রহের দরকার হবে না।

নোবেল বিজয়ী রুশ কবি ও লেখক জোসেফ ব্রডস্কিও বলেছেন প্রায় একই রকম কথা। তিনি বলেন, ‘বই পোড়ানোর চেয়েও বড় অপরাধ আছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে বই না পড়া।’ মার্কিন দাসপ্রথাবিরোধী আন্দোলনের নেতা ফ্রেডরিক ডগলাস বলেছেন, ‘একবার তুমি পড়তে শেখো, তুমি চিরকালের জন্য স্বাধীন।’বিশ্ববিজয়ী বীর নেপোলিয়ন বলেছিলেন, ’অন্তত ষাট হাজার বই সাথে না থাকলে জীবন অচল।’ জন মেকলে বলেছেন, ’ প্রচুর বই নিয়ে গরিব হয়ে চিলেকোঠায় বসবাস করব, তবু এমন রাজা হতে চাই না যে বই পড়ে না।’ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, ’জীবনে মাত্র তিনটি জিনিসের প্রয়োজন-বই, বই এবং বই।’

বই না পড়ার কারণে আমাদের তরুণরা যুক্তি ও কুযুক্তির তফাত বুঝতে পারে না। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আমাদের শিক্ষার্থীদের যুক্তিহীন, একগুঁয়ে ও স্বার্থপর মানুষ তৈরি করবে, তাই এর পাশাপাশি অবশ্যই বিভিন্ন লেখকদের উচচতর চিন্তা-ভাবনার নির্যাস প্রসূত বই আমাদের পড়তে হবে, অনুজদের পড়াতে হবে, জাতীয়ভাবে অভ্যাস গড়াতে হবে যাতে তারা বই পড়ে।

সরকারি বেসরকারি গ্রন্থাগার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান গ্রন্থাগার, এনজিও পরিচালিত গ্রন্থাগার ইত্যাদির মধ্যে একটি কার্যকর এবং ফলদায়ক সমন্বয়ের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ফেব্রুয়ারি মাসের ৫ তারিখ জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস ঘোষণা করা হয়েছে। এরুপ সমন্বয়ের ফলে বাংলাদেশের গ্রন্থাগার সেবার মান ও কার্যকারিতা দুই-ই আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে হলে গ্রন্থাগারগুলোকে টিকিয়ে রাখতে হবে। গ্রন্থাগার হচ্ছে সভ্যতার বাহন। ১৯৫৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল। তাই এ দিনটিকে ’জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস, হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

অসংখ্য ভাবনা এবং নবতর ধারণার মধ্য দিয়ে গ্রন্থাগারগুলোর কার্যক্রম এখন সম্মুখের দিকে নিরন্তর ধাবিত হবে বলে প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের। দেশে সরকারি পর্যায়ে বিভাগীয়, জেলা ও দুটি উপজেলাসহ মোট ৭১টি গণগ্রন্থাগার পরিচালিত হচ্ছে। বেসরকারি পর্যায়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ৯০ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রীকে বই পড়াচ্ছে। চার হাজার স্কুলে যেখানে কোনো লাইব্রেরি ছিল না, লাইব্রেরি করেছে বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্র। এ ছাড়াও আরও দুই হাজার বিদ্যালয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র লাইব্রেরি স্থাপন করেছে। ব্রাক শিক্ষা কর্মসূচি প্রায় তিন হাজার গণকেন্দ্র ও পাঁচহাজার কিশোর-কিশোরী ক্লাবের মাধ্যমে লাইব্রেরি কার্যক্রম পরিচালনা করে প্রায় চৌদ্দ লক্ষ পাঠক-পাঠিকা তৈরি করেছে দেশব্যাপী।
এসব কেন্দ্রগুলোতে বছরব্যাপী বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। জ্ঞান ও তথ্য জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ কাউন্সিল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সাথে যৌথভাবে পরিচালনা করছে ’লাইব্রেরিজ আনলিমিটেড’কর্মসূচি।

প্রথম জাতীয় গ্রন্থাগর দিবসে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, ”গ্রন্থাগার হলো সভ্যতার দর্পণ। মানবজাতির শিক্ষা, রুচিবোধ ও সংস্কৃতির কালানুক্রমিক পরিবর্তনের সাথে গ্রন্থাগারের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। সে কারণে গ্রন্থগার হচ্ছে অতীত ও বর্তমান শিক্ষা-সংস্কৃতির সেতুবন্ধন।” মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ”গ্রন্থাগার হল জ্ঞানের ভাণ্ডা। জ্ঞানার্জন, গবেষণা, চেতনা ও মূল্যবোধের বিকাশ, সংস্কৃতিচর্চ ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষকে আলোকিত করে তোলা এবং পাঠাভ্যাস নিশ্চিতকরণে গ্রন্থাগারের ভূমিকা অপরিসীম।”

এ কথাগুলো সার্বজনীন এবং সব সময়েরই। মনের স্নিগ্ধরূপ গঠনে গ্রন্থের একটি বিরাট প্রভাব বিদ্যমান। মনের তৃপ্তি ও দীপ্তি গ্রন্থপাঠের মাধ্যমেই সম্ভব। গ্রন্থ মানুষকে দেয় জীবনীশক্তি। গ্রন্থ নির্বাচনে পাঠককে গ্রন্থাগারে ও দোকানে গিয়ে পরিশ্রম করতে হয়। জ্ঞানের জায়গায় যদি তথ্য প্রতাপ তৈরি করে তাহলে সভ্যতার সংকট তৈরি হতে পারে।
তবে, কাগজের বই পড়ার যে আনন্দ তা অন্য কোনো মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব নয়। এটিই আসল সত্য কথা। বাংলাদেশের মানুষের গভীর আবেগ, ভালবাসা ও গ্রন্থপ্রীতি যুক্ত হয়ে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ধীরে ধীরে বাঙালীর সাংস্কৃতিক জাগরণ আর রুচি নির্মানের এক অনন্য প্রতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করেছে।

মেলায় অঢেল বই প্রকাশিত হলেও মানসম্পন্ন বইয়ের যে অভাব রয়েছে, পাঠকদের সে বিষয়ে সচেতন হতে হবে। একইভাবে দেশের গ্রন্থাগারগুলোতেও মানসম্পন্ন বইয়ের সমাবেশ ঘটাতে হবে। একখানা বই শত শত বছর টিকে থাকে, যদি তেমন বই হয়। অনেক নতুন বই বাজারে আসে, কোনোটির মান ভাল, আবার কিছু বই হয়তো সে রকম মানসম্পন্ন নয় কিন্তু বিজ্ঞাপনের ভারে পাঠকদের কাছে পৌঁছে যায়। তবে ভাল বই কীভাবে পাঠকদের কাছে পৌছানো যায় তার ব্যবস্থা প্রকাশক সংস্থাগুলোসহ জাতীয় গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষককেও নিতে হবে।

বইয়ের প্রতি তরুণদের আগ্রহ যদি বেশি থাকে তাহলে প্রকাশকেরা নিম্নমানের বই প্রকাশে তেমন উৎসাহিত হবেন না। কাজেই পাঠকদেরও রয়েছে এখানে বিরাট দায়িত্ব। পাঠকরা যাতে শুধু বইয়ের বিজ্ঞাপন দেখে এবং শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠিত লেখকদের বই-ই না পড়েন সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রতিষ্ঠিত লেখক হলেই যে, তারা সব সময় একই মানের বই বের করতে পারবেন তা কিন্তু ঠিক নয়। তারা প্রকাশকদের চাপাচাপিতে অনেক সময় দ্রুত বই বের করেন আর প্রকাশকরাও তাদের নাম দিয়ে মোটামুটি বাণিজ্য করার চেষ্টা করেন। কাজেই বইয়ের মান বিচারের মূল দায়িত্ব পাঠকদের।

উন্নত দেশগুলোতে গন্থাগারের উপযোগিতা শ্বাস-প্রশ্বাসে ব্যবহৃত অক্সিজেনের মতো। সেখানকার জ্ঞানমনস্ক মানুষেরা দিনের শত কর্মব্যস্ততার মাঝেও গ্রন্থাগারে যাওযার জন্য একটু সময় বের করে নেয়। আমাদের দেশে সর্বসাধারণের দ্বারা গ্রন্থাগারের ব্যবহার আরও ব্যাপকতর ও জোরদার করার জন্য সরকার বিভিন্ন কর্মসুচির বাস্তবায়ন করছে।

বর্তমান সময়ে যুবসমাজকে ঘিরে আমরা যে সম্ভবনার আশা করছি এবং পাশাপাশি শঙ্কার মধ্যে আছি সেটি থেকে পরিত্রাণের একটি উপায় হতে পারে বই পড়া এবং সাংষ্কৃতিক কর্মকান্ডে যুব সমাজের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা। যুব সমাজকে নৈতিক অবক্ষয় থেকে রক্ষা করার জন্য বই পড়ার সংস্কৃতি চালু এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এই জন্য প্রয়োজন গ্রন্থাগারগুলোতে পাঠকের বয়স অনুযায়ী বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি করা, চিত্তবিনোদেনর ব্যবস্থা করা ও বই পড়ার প্রতি মানুষ আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্য পাঠক ফোরাম, বই প্রদর্শণীর আয়োজন করা। আমরা আশা করি, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে জাতীয় গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ গোট দেশে বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রের মতো জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করবে।

প্রতিটি সচেতন পরিবারেরই উচিত একটি পারিবারিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা। শিশুদের বই পড়ায় উদ্বুদ্ধ করা। ছোট হলেও প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার চালু করা উচিত। প্রতিটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারা আছে কিনা, থাকলে চালু আছে কিনা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা তা পড়েন কিনা ইত্যাদি বিষয়গুলোর খোঁজখবর রাখতে হবে সংশ্লিষ্টদের।

দু:খের বিষয়- অনেক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক এবং অনেক অভিভাবক বলে থাকেন, ” বাইরের বই পড়ে সময় নষ্ট করার সময় নেই আমাদের শিক্ষার্থীদের।” প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতিতে কী শিখছে আমাদের শিক্ষার্থীরা আমরা সবাই তা প্রত্যক্ষ করছি গভীর উদ্বেগের সাথে। কলেজ পর্যায়েও বই পড়া, প্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগার স্থাপন ও সচল রাখার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের যদি আমরা সঠিক জ্ঞানের রাজ্যে নিয়ে যেতে পারি, বই পড়ার মধ্যে ডুবিয়ে রাখতে পারি তাহলে তাদের আত্মা পরিশুদ্ধ হবে, তারা জঙ্গীবাদে জড়াবে না, ইভটিজিং করবে না, মাদকাসক্ত হবে না, হাতে হকিষ্টিক আর পিস্তল নিয়ে প্রতিপক্ষকে তাড়া করবে না। বই পড়লে তারা আলোয় উদ্ভাসিত হবে, অন্যায় করবে না। তাদের মনের দিগন্ত প্রসারিত হবে। তাদের পরিচয় করিয়ে দিতে হবে বিশিষ্ট লেখকদের ও মহামানবদের সাথে। আর সেটি সম্ভব তাদেরকে বই পড়ানোর মাধ্যমে।

মাছুম বিল্লাহ: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক। বর্তমানে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিকে কর্মরত।

এ সম্পর্কিত আরও খবর