নতুন শিক্ষামন্ত্রী, পুরনো দায়বদ্ধতা ও জনগণের প্রত্যাশা

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান | 2023-08-21 02:45:41

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু করেছে বাংলাদেশের নতুন সরকার। বেগম রোকেয়ার বাংলাদেশের ‘অবরোধবাসিনী’ ও ‘অর্ধাঙ্গিনী’ ‘শিক্ষা-দীক্ষা ও ক্ষমতায়নে’ আজ বিশ্বে রোল মডেল। যার ফলশ্রুতিতে, বাংলাদেশ ইতিহাসে প্রথমবারের মত একজন উচ্চশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ নারী শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে ডা. দীপু মনিকে পেয়েছে। ইতিপূর্বে যিনি প্রথম নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে (২০০৯-২০১৩) দায়িত্ব পালন করেছেন এবং প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সাথে প্রায় চার দশকের সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত অমীমাংসিত বিষয়টি আর্ন্তজাতিক আদালতের মাধ্যমে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির ব্যাপারে বিচক্ষণতা ও পারদর্শিতা দেখিয়েছেন।

এ কথা প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া উত্তম যে টানা দুই মেয়াদে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এক অনন্য উচ্চতায় নেওয়ার জন্য শতভাগ ও আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন সহজ-সরল, প্রাজ্ঞ ও মিষ্টভাষী সদ্য সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। যে সমস্যাগুলো থেকে গেছে তা অন্য যে কোনো ব্যক্তি মন্ত্রী থাকলেও দূর করা সহজসাধ্য ছিল না। নতুন শিক্ষামন্ত্রী এবং তারুণ্যে উদ্দীপ্ত উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বিদ্যমান সমস্যাগুলো আগামী দিনগুলোতে সমাধান করার আপ্রাণ চেষ্টা করবেন, সেই প্রত্যাশা তাদের অতীত কর্মকাণ্ড থেকেই আমরা করতে পারি।

শিক্ষাখাতে বেশ কিছু জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় আজ সমস্যায় পরিণত হয়েছে এবং সময়মত সমাধান না হওয়ায় শিক্ষামন্ত্রণালয় ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট তা এক ধরণের ‘দায়বদ্ধতায়’ পরিণত হয়েছে। বিষয়গুলো নিচে তুলে ধরা হল:

এক.

বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা বাস্তবায়নের বিষয়টি নিয়ে প্রতি বছর আলোচনা শুরু হলেও শেষের দিকে এসে এটি আর সফল হয় না। ২০০৮ (তত্ত্বাবধায়ক সরকার), ২০০৯, ২০১০, ২০১১, ২০১২, এবং ২০১৩ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে উপাচার্যদের সঙ্গে বৈঠক করে। কিন্তু প্রতিবারই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব হওয়ার আশঙ্কায় ও বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনীহায় বিষয়টি আলোর মুখ দেখেনি। সর্বশেষ, ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে একটি সমূহ সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল। গত ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের সঙ্গে উপাচার্যদের বৈঠকে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের ভর্তিকালীন দুর্ভোগ কমাতে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত হওয়ায় দুইটি কমিটি গঠন করা হয়। দুই কমিটির সুপারিশ সমন্বয় করে ‘সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নীতিমালা সংক্রান্ত ধারণাপত্র' ১৫ এপ্রিল, ২০১৮-এর মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়ার কথা ছিল। অত্যন্ত সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত এই বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।

দুই.

উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়ন, প্রচলিত একাডেমিক ব্যবস্থার উৎকর্ষ সাধন এবং শিক্ষার আবহ আন্তর্জাতিক পরিসরে বিস্তৃতির লক্ষ্যে দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে গতিশীল, সময়োপযোগী, বিদ্যমান আইন পরিবর্তন-পরিবর্ধন, মানসম্মত একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)-কে রুপান্তর করে 'উচ্চশিক্ষা কমিশন' গঠনের অপরিহার্যতা এখন সময়ের দাবি।

সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রণয়নের জন্য ‘উচ্চশিক্ষা কমিশন আইন-২০১৮’ এর খসড়া মন্ত্রী পরিষদে উত্থাপনের জন্য যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে রেখেছে। যুগোপযোগী আইন সম্বলিত মেধাবী, দক্ষ, গবেষক, এবং সুশিক্ষিত জনবল দ্বারা ইউজিসিকে আমলাতন্ত্রের প্রভাবমুক্ত ‘উচ্চশিক্ষা কমিশনে’ রূপান্তরের বিষয়টি অধিক গুরুত্বের সাথে শিক্ষামন্ত্রণালয়কে দেখতে হবে।

তিন.

বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদোন্নয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন নীতিমালা প্রচলিত রয়েছে। বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশক্রমে ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে ইউজিসি একটি যুগোপযোগী অভিন্ন নীতিমালা প্রণয়নের লক্ষ্যে ৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে এবং ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭, কমিশনের ১৪৮তম সভায় সুপারিশকৃত নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত করে।

উল্লেখ্য যে, ১৯৯৩, ২০০২, ২০০৪ এবং ২০০৭ সালে (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এটি ধ্রুব সত্য যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শিক্ষক নিয়োগে সার্বজনীনভাবে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও পেশাদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে না পারায় এবং রাজনৈতিক চাপ ও স্বজনপ্রীতির কারণে প্রায়ই নিরপেক্ষতা ও মেধা উপেক্ষিত হয়েছে। তবে লক্ষ্য রাখা দরকার, প্রণয়নের জন্য প্রস্তুতকৃত অভিন্ন নীতিমালার নেতিবাচক কোনো প্রভাব কোনোভাবেই যেন শিক্ষা, গবেষণা, শিক্ষার্থী ও সর্বোপরি মানুষ গড়ার কারিগর অবহেলিত শিক্ষক সমাজের ওপর না পড়ে এবং পদোন্নয়নের বিষয়টি কোনোভাবেই যেন ‘ভূতাপেক্ষ’ (Retrospective) না হয়।

চার.

দেশের বৃহত্তম ও পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। সম্পূর্ণ বাংলাদেশ যার ক্যাম্পাস। ১৯৯২ সালে কার্যক্রম শুরু হওয়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে প্রায় ২২৫০টি অধিভুক্ত সরকারি-বেসরকারি কলেজে আনুমানিক ২১-২২ লাখ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য পড়াশুনা করছেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের মত সিলেবাস প্রণয়ন, প্রশ্নপত্র তৈরি, তারিখ নির্ধারণসহ পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা, ফলাফল প্রস্তুত ও প্রকাশ করা-এ ধরণের কাজের বাইরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রকৃত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মত দায়িত্ব নেওয়ার সময় এসেছে।

বর্তমান পদ্ধতি প্রচলনের পাশাপাশি প্রত্যেক বিভাগের তুলনামূলক অনুন্নত ও অনগ্রসর জেলার (উন্নত করার জন্য) বৃহত্তম কলেজকে ‘বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়’-এ আত্তীকরণ/রূপান্তর অথবা অস্থায়ী ক্যাম্পাস হিসেবে নিয়ে একজন উপ-উপাচার্যের মাধ্যমে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসেবে অগ্রযাত্রার শুভসূচনা করা যেতে পারে।

পাঁচ.

শিক্ষা ক্ষেত্রে বিগত মহাজোট সরকারের যুগান্তকারী ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের একটি হলো ‘বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ’ (এনটিআরসিএ) কর্তৃক বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজসমূহে) শিক্ষক নিয়োগ নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। কেননা ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের অর্থ হলো অর্থের কাছে মেধার, প্রভাব-প্রতিপত্তির কাছে দারিদ্রের ও লোভের কাছে সম্মানের পরাজিত হওয়া। নিয়োগের ক্ষেত্রে একজন ভুল শিক্ষক নির্বাচনের অর্থ হলো প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ বছরের জন্য হাজার হাজার শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবনকে অন্ধকারের মধ্যে ঠেলে দেওয়া। তবে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)-এর আদলে কেন্দ্রীয়ভাবে যুগোপযোগী ‘শিক্ষক নিয়োগ কমিশন’ গঠন ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে সেটাই হবে অতি উত্তম ব্যবস্থা। কোনভাবেই যেন শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি আর ম্যানেজিং কমিটির কাছে ফেরত না যায়।

ছয়.

মা-বাবার অপমান সহ্য করতে না পেরে গত ৩ ডিসেম্বর, ২০১৮ রাজধানীর শান্তিনগরে গলায় ফাঁস দিয়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের ছাত্রী ‘অরিত্রি’ আত্মহত্যা করেন। শাসনের একই নিয়ম সবার বেলায় ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্নভাবে প্রয়োগের সমাজতত্ত্ব ও কৌশলের বিষয়টি বুঝতে না পারায় অবেলায় ঝরে গেল অরিত্রি।

পাশাপাশি শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন ফি আদায়ের নামে এক ধরনের অবিচার ও কঠিন বাস্তবতা উন্মোচিত হয়েছে। ভর্তি ফরম ও গাইড বাণিজ্য, নতুন ও পুনঃভর্তি, ‘সিকিউরিটি মানি’, মাসিক বেতন, কোচিংয়ে বাধ্য করা, কোচিং ফি, প্রগতি বিবরণী, মার্কশিট, ছাড়পত্র, প্রত্যয়ন পত্র, খেলাধুলা, স্কাউট, গার্লস গাইড, দরিদ্র তহবিল, মিলাদ, সাময়িকী, পাঠাগার, সিলেবাস, প্রসপেকটাস, বিজ্ঞানাগার, কম্পিউটার, প্রযুক্তি ফি, স্কুল নির্ধারিত নোট বই, খাতা, ডায়েরি ও পরিচয়পত্র, পিকনিক, ঈদ পুনর্মিলনী, নববর্ষ ও উন্নয়ন ফি প্রভৃতি নামে এবং ‘বিবিধ’ বেনামে অর্থ আদায় খাতের শেষ নেই । রাষ্ট্রকে এই অবিচার দূর করার দায়ভার যথাযথভাবে পালন করতে হবে।

প্রশ্নপত্র ফাঁস নির্মুল, ‘পাশ চাই, ফেল নয়’ নির্ভর শিক্ষা, শুধুমাত্র পরীক্ষা ও মনোস্তাত্ত্বিক ভীতি দূর করার জন্য পিইসি এবং জেএসসি পরীক্ষা গ্রহণের অসহনীয় মানসিক চাপ প্রদান থেকে বিরত থাকার জন্য আমাদেরকে গভীরভাবে ভাবা দরকার।

গ্রামের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বিজ্ঞান শিক্ষা যাদুঘরে যাওয়ার মত অবস্থায় উপনীত হয়েছে; যেখানে মানসম্মত লাইব্রেরি ও বিজ্ঞানাগার নেই, ইংরেজি, বিজ্ঞান (পদার্থ, রসায়ন, জীব), উচ্চতর গণিত, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) এমনকি প্রমিত বাংলা ব্যাকরণ জানা ভালো শিক্ষক নেই।

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচ্চশিক্ষার মান উন্নতকরণ, বাণিজ্যিকীকরণের অপচেষ্টারোধ, কর্মকাণ্ড 'মনিটরিং' করা দরকার। কোনোরকম বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ (Foundation Training) ছাড়াই একজন শিক্ষক যোগদান মাত্রই শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করেন যে সুযোগ বর্তমানে রাজনীতির মধ্যে দেখা গেলেও বাংলাদেশে অন্য কোনো পেশায় অসম্ভব। শিক্ষাক্ষেত্রের পূর্বের সকল প্রতিবন্ধকতাকে ‘দায়বদ্ধতা’ হিসেবে নিয়ে আগামী দিনের পথচলা সুন্দর-মসৃণ ও উন্নয়নমূলক হোক সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।

মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান: পি.এইচ.ডি গবেষক, ঝেজিয়াং ইউনিভার্সিটি, চীন এবং শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর