বিশুদ্ধ জল সংকট ও জল জালিয়াতি

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

আলম শাইন | 2023-08-31 22:31:40

অবধারিত সত্য কথাটি হচ্ছে বিশ্বের মোট আয়তনের তিন ভাগ জলরাশি হলেও বিশুদ্ধ জল সংকটে ভুগছেন ৮০টি দেশের প্রায় ১১০ কোটি মানুষ। এছাড়াও প্রতি বছর বিশ্বের প্রায় ১৮ লাখ শিশু প্রাণ হারাচ্ছে শুধুমাত্র দূষিত জল পান করে।

প্রতিদিনের জলপানের চাহিদা মেটাতে কিংবা বিশুদ্ধ জলপান থেকে বঞ্চিত হওয়ার নানাবিধ কারণ রয়েছে। তার মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, খরা, ভূ-গর্ভস্থ জলস্তর নেমে যাওয়া কিংবা আর্সেনিকের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াই প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।

জানা যায়, বৈশ্বিক উষ্ণতা আর মাত্র এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলেই বিশ্বের মোট ১৪৫ কোটি মানুষ সুপেয় জল সংকটের মুখোমুখি হবেন। তার মধ্যে এশিয়া মহাদেশে ১২০ কোটি এবং আফ্রিকা মহাদেশে ২৫ কোটি মানুষ এর আওতায় পড়বেন। এর থেকে বাদ যাবে না বাংলাদেশের মানুষও। বরং তূলনামূলক হিসেবে বাংলাদেশের হার বেশিই পড়বে।

বিশ্বে মোট মজুদ জলের পরিমাণ এক হাজার ট্রিলিয়ন মেট্রিক টন। এর মধ্যে সমুদ্রে সঞ্চিত লবনাক্ত জলের পরিমাণ ৯৭.২ শতাংশ। যা মোটেই পানযোগ্য নয়। অপরদিকে ২.১৫ শতাংশ জল জমাটবদ্ধ হয়ে আছে বরফাকারে। সেটিও পানযোগ্য নয়। বাকি .৬৫ শতাংশ জল সুপেয় হলেও প্রায় .৩৫ শতাংশ জল রয়েছে ভূ-গর্ভে। যা উত্তোলনের মাধ্যমে আমাদের দৈনন্দিন পানযোগ্য জল চাহিদা পূরণ করতে হয়। এটি আমাদের কাছে বিশুদ্ধ জল হিসেবে পরিচিত।

এই জলের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে প্রতিটি মানুষের জন্যে দৈনিক গড়ে ৩ লিটার হারে। ভূ-গর্ভস্থ জল ছাড়া নদ-নদী, খাল-বিল কিংবা পুকুর-জলাশয়ের জল সুপেয় হলেও তা বিশুদ্ধ নয়। তবে সেটিও আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য্য অংশ। বিশেষ করে গোসলাদি, রান্না-বান্না, জামা-কাপড় ধোয়ার কাজে এ জলের ব্যাপক প্রয়োজন পড়ে। তাতে করে একজন মানুষের সব মিলিয়ে গড়ে ৪৫-৫০ লিটার জলের প্রয়োজন হয়।

সমগ্র বিশ্বে জল সংকট চরম আকার ধারণ করার ফলে জাতিসংঘ এ ব্যাপারে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল মরিস স্ট্রং ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত এক বিশ্ব সন্মেলনে সুপেয় জল সংকটের কথা ব্যক্ত করে বলেছেন,‘একুশ শতকে যদি ৩য় বিশ্ব যুদ্ধ বেঁধে যায় তবে তার প্রধান ইস্যু হবে জল’। তার আশঙ্কা যে অমূলক নয় সেটার প্রমাণও আমরা ইতিমধ্যে পেয়ে গেছি। যেমন নীলনদের জল বন্টন নিয়ে বরুন্ডি, কঙ্গো, তানজানিয়া, ইথিওপিয়া, সুদান, মিসর, কেনিয়া, রুয়ান্ডা, উগান্ডা সহ আরো কয়েকটি দেশ দ্বদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এ ছাড়াও তানজানিয়া, ইথিওপিয়া, রুয়ান্ডা, উগান্ডা নীলনদের জল বন্টন নিয়ে ‘কো-অপারেটিভ ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট অন দ্যা নীল রিভার বেসিন’ নামক একটি চুক্তি সাক্ষরও করেছে। যার ফলে উক্ত এলাকায় এক ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে।

এ ধরনের আরেকটি দ্বন্দ্বের সংবাদ জানা যায় যুক্তরাষ্ট্র-কানাডার মধ্যে। কানাডার সাসকাচুয়ান প্রদেশে ৮২,৬৩১ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে রয়েছে সুপেয় জলধারা। সেই জলধারার দিকে নজর পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাদের সুপেয় জল চাহিদা মেটাতে কানাডা সরকারের কাছে জল আমদানী করতে চাইলে কানাডা সরকার তা নাকচ করে দিয়েছে। এ ব্যাপারে কানাডার জনগণও সরকারের সঙ্গে একাত্বতা প্রকাশ করেছেন। ফলে দু’দেশের মধ্যে এ নিয়ে কিছু টানাপোড়ন সৃষ্টি হয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে যৎসামান্য দূরত্বও।

সম্প্রতি তিস্তার জল নিয়ে মনোস্তাত্বিক দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে ভারত-বাংলাদেশও। ফারাক্কা বাঁধ নিয়েও ইতিপূর্বে যায়নি। যার রেশ এখনো রয়ে গেছে। সেই বাঁধের খেসারতও আমাদেরকে দিতে হচ্ছে। অপরদিকে আবার গোদের ওপর বিষফোঁড়ার উৎপত্তি হবে যদি টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ করা হয়। জানা যায়, এ বাঁধের দৈর্ঘ্য ১৫০০ ফুট এবং উচ্চতা ৫০০ ফুট। বিশাল এ বাঁধ নির্মাণ হলে বাংলাদেশের সিলেটসহ এক তৃতীয়াংশ এলাকা এবং ভারতের মিজোরামপুর, মনিপুর, অসামের নৌপরিবহণ, কৃষি, মৎস্য সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হবে। শুধু সিলেট ও মৌলিভীবাজারের ৩৫ হাজার ৩৪৩ হেক্টর জমি বিরান হয়ে যাবে। এ বাঁধের ফলে মরুকরণের পাশাপাশি সমুদ্রের লোনাজল ওপরের দিকে উঠে আসবে। এতে সুপেয় জল সংকট দেখা দেবে। যেমন দেখা দিয়েছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলার ফলে।

এখানে স্পষ্ট লক্ষনীয় যে বন্ধু প্রতিম দু’দেশের সম্পর্কের অবনতির অন্তরালে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে জল বন্টন। এতে প্রতিয়মান হয় আগামী শতকে সুপেয় জলই হবে বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রধান হাতিয়ার। সেই হাতিয়ারটিকে রক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে বাংলাদেশ সরকারকেও। সরকারকে এক্ষুণি আঁটঘাট বেঁধে নামতে হবে নদী খননের কাজে। নদী-নালা-খাল খননের মাধ্যমে হারানো নদীর নব্যতা ফিরিয়ে আনতেও সচেষ্ট হতে হবে। তাতে করে আমাদের সুপেয় জল চাহিদার ঘাটতি অনেকখানি কমে যাবে এবং তা সরংক্ষণও হবে। কারণ বাংলাদেশের ভূ-গর্ভস্থ জলস্তর অনেকখানি নিচে নেমে গেছে বেশি বেশি উত্তোলণের ফলে। যা বিশ্বের আর কোনো দেশে এমন নজির নেই। কাজেই আমাদেরকে সাবধান হতে হবে এক্ষুণিই।

এক সমীক্ষায় জানা যায়, বাংলাদেশে বিশুদ্ধ জল সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে ইতিমধ্যেই। প্রায় ৭ কোটি মানুষ বিশুদ্ধ জল সংকটে ভুগছেনও। তার মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ অতিমাত্রায় ভুগছেন। সেই সুযোগটি নিয়েছেন আমাদের দেশের জল ব্যবসায়ীরা। বিশুদ্ধ জলের বিজ্ঞাপন দিয়ে কিছু কিছু ব্যবসায়ীরা রীতিমত ট্যাপের জল বোতলে ঢুকিয়ে তা বাজারজাত করে চড়া দামে বিক্রি করছেন। ক্ষেত্র বিশেষ দেখা যায় দুধ এবং জল সমমূল্যে বিক্রি হতে। তারপরও সেই জল নিরাপদ নয়। নিরাপদ জল ভেবে ক্রেতারা তা পান করার ফলে জলবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এ হীনকর্মের জন্য ধিক্কার জানানোর পাশাপাশি আইনের আওতায় এনে এদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি কামনা করছি আমরা। তাহলে জল জালিয়াতির ঘটনা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পাবে জাতি।

আলম শাইন: কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও বন্যপ্রাণী বিশারদ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর