শুধু সাংবাদিকরাই খারাপ?

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

চিররঞ্জন সরকার | 2023-08-11 01:32:16

নানা সীমাবদ্ধতার পরও আমাদের দেশে এখনও সাংবাদিকদের ‘জাতির বিবেক’ মনে করা হয়। এক সময় অবশ্য ছিলও তাই। তারাই এই পেশায় যান যারা এই পেশাটাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন, যারা অনেক কিছুই জানেন, বোঝেন। যারা অন্যায়ের সঙ্গে আপোস করেন না, করতে পারেন না। যারা নৈতিক দিক দিয়ে অনেক উপরে অবস্থান করেন।

আমাদের দেশের ঘুনেধরা রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সাংবাদিকরাই ছিলেন সাধারণের কাছের মানুষ। কিন্তু সেই সব মানসিকতার ‘সাংবাদিকতা’র দিন গত হয়েছে অনেক আগেই। এখন সমাজের সার্বিক অবক্ষয় অন্য অনেক মহৎ পেশার সঙ্গে সাংবাদিকতাকেও কলুষিত করেছে। সাংবাদিকতা পেশাও স্বার্থ ও সুবিধাবাদিতার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।

তারপরও নানাভাবে বঞ্চিত-ক্ষুব্ধ মানুষ এখনও সাংবাদিকদের কাছে অনেক কিছু প্রত্যাশা করে। তাই সাংবাদিকদের প্রত্যাশিত ভূমিকায় না দেখতে পেলে কিংবা তাদের সামান্য বিচ্যুতিই অনেককে বেশি রকম পীড়া দেয়, মর্মাহত করে। বস্তুনিষ্ঠতার ধার না ধেরে সাংবাদিকদের ‘দলবাজি’ করতে দেখলে তাই অনেকেই আহত বোধ করেন। ক্ষুব্ধ হন।

তবে শুধু সাংবাদিকদের দোষ দেওয়া, তাদের মুণ্ডুপাত করার মধ্যে একটা ‘একদেশদর্শী’ মনোভাব রয়েছে। এতে মনে হয়, সমাজে শুধু সাংবাদিকরাই খারাপ, আর কারও কোনো দোষ নেই। আসলে ভালো-খারাপ সবখানে, সব পেশাতেই আছে। আমরা যারা সমাজে নিজেদের সচেতন কিংবা ‘মহানাগরিক’ মনে করি, আমাদের নিজেদের মধ্যেও কি কোনো বিভ্রান্তি নেই?

আমরা চট করেই কারও ওপর খুব বেশি ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ি। আবার খুব তুচ্ছ কারণে অনেক সময অনেকের ওপর বেশি রকম অনুরক্তও হই। আমরাও যথেষ্ট স্থিতধী হতে পারিনি। আমাদের নিজেদের আত্মোপলেব্ধির উন্মেষও আজ খুব বেশি জরুরি।

হিন্দু ধর্মশাস্ত্র বেদান্তে ‘অধ্যাস’ বলে একটা কথা আছে। অধ্যাস হচ্ছে-যেটা যা নয়, তাকে তা-ই বলে দেখা। সাপ আছে মনের মধ্যে, তাকে আপনি আরোপ করছেন দড়ির ওপর। রজ্জুতে সর্পভ্রম। ‘সত্য’ বলে যা ধরে নিই, তা যে আসলে যে ভ্রম, তা টের পাওয়াটাই হল চ্যালেঞ্জ।

বেদান্ত বলে, যা চেতন, তাকে অচেতন, জড়স্বভাব বলে মনে করাই অনাদিকালের মায়া। আর আমাদের দেশে হচ্ছে ঠিক উল্টো। সচেতন নাগরিককে চেতনাহীন, বোধবুদ্ধিহীন, জড়বস্তু করে তোলার একটা প্রক্রিয়া চলছে। বিতর্ক-আলোচনা, গণতন্ত্রে নাগরিকের যা গোড়ার কর্তব্য, তাতে রয়েছে প্রবল অনীহা। যা নিপাট ফ্যাসিজম, তাকে ‘আত্মবিশ্বাস’ ও ‘গণতন্ত্র’ বলে চালানো হয়। সাপকে দড়ি বলে ভুল করার মতো!

বেদান্তে মুক্তির কথাও অবশ্য রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, যে সোনার হার খুঁজে বেড়াচ্ছে, সে যখন হঠাৎ খেয়াল করে- আরে, হার তো আমার গলাতেই ছিল, তেমনই আত্মোপলব্ধির বোধ। গণতন্ত্রেও মানুষ একদিন খেয়াল করে, ক্ষমতা আছে তার ভেতরেই, নেতাদের হাতে নয়।

গণতন্ত্রে সে উপলব্ধির সাধনাই রাজনীতি। কোনও রাজনৈতিক দল যদি সে রাজনীতি না করে, তবে নাগরিক সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংস্থা, মিডিয়ার উপর সে দায়টা একটু বেশি করে বর্তায়, এই যা। তাই হয়তো আমাদের দেশে মিডিয়ার উপর প্রত্যাশার চাপটা একটু বেশি।

আমাদের জন্য সবচেয়ে উদ্বেগের ব্যাপার হলো, এক ধরনের অসহিষ্ণু মনোভাব ও ঔদ্ধত্য গ্রাস করেছে পুরো সমাজে। যে যেখানে যতটুকু ক্ষমতাধর, তার মধ্যেই একটা ‘মুই কি হনুরে’ মনোভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। আর ক্ষমতাসীনদের কথা তো বলাই বাহুল্য। ক্ষমতাবানদের মধ্যে কারও কোনো বক্তব্য শোনার কোনো তাগিদ নেই।

কোনো একটি বিশেষ ইস্যুতে কারও বক্তব্য পছন্দ না-ই হতে পারে, অত্যন্ত আপত্তিকরও মনে হতে পারে, সেই আপত্তি জানিয়ে প্রতিবাদীরা প্রতিবাদ করতেই পারেন, এমনকি ইচ্ছে হলে তা নিয়ে কেউ আদালতে নালিশও করতে পারেন, আমাদের দেশে বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে মামলা করবার অভ্যাস বহুলপ্রচলিত।

গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত, ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণুতা। সেই মত যত আপত্তিকরই হোক, তা শুনতে হবে, তাকে যুক্তি ও তথ্য দিয়েই খণ্ডন করতে হবে। ক্ষমতা দিয়ে দমন করা চলবে না। এখানেই রাষ্ট্রের বিশেষ দায়িত্ব। রাষ্ট্রের হাতে দমনের ক্ষমতা আছে বলেই গণতন্ত্র তার আচরণে দ্বিগুণ সহিষ্ণুতা দাবি করে। বস্তুত, ভিন্নমত শুনবার ও তার সঙ্গে যুক্তিনির্ভর বিতর্কে প্রবৃত্ত হবার আগ্রহই রাষ্ট্রকে শক্তি দেয়।

যেকোনো জাতীয় ইস্যুতে যুক্তিতর্ক হতে হবে। সেটাই কাঙ্ক্ষিত। কেউ ভিন্নমত পোষণ করতেই পারেন। সেই যুক্তিটাও জানা দরকার। বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ সবখানেই আছেন। শাসকদের উচিত খোলামেলা আলাপ-আলোচনার আয়োজন করা। প্রতিপক্ষ বা সংক্ষুব্ধদের কাছ থেকে উঠে আসা প্রশ্নগুলো মীমাংসার উদ্যোগ গ্রহণ করা।

বার্ট্রান্ড রাসেল থেকে রবীন্দ্রনাথ, উদার-চিন্তার বহু অগ্রপথিক অসিষ্ণুতার বিপদ সম্বন্ধে বারংবার সচেতন ও সতর্ক করেছেন, সে জন্য গঞ্জনা, লাঞ্ছনা ও নিপীড়নও ভোগ করেছেন। কিন্তু তাতে ব্যাধির নিরাময় হয়নি, প্রশমন ঘটেছে তাও বলা চলে না। হিটলারের মনস্তত্ব নিয়ে লেখা একটি বইতে এক মার্কিন মনস্তাত্বিক লিখেছিলেন, হিটলারের প্রধান সমস্যা তার মধ্যে হাস্যরস ছিল না। চার্লি চ্যাপলিনের গোঁফ দেখেও তিনি রেগে গিয়েছিলেন। তার মনে হয়েছিল, চার্লি তাকে ব্যঙ্গ করার জন্য এটি করেছেন। ‘গ্রেট ডিকটেটর’ ছবিটি তিনি নিজের দেশে নিষিদ্ধ করেছিলেন।

যদিও চার্লি ও হিটলার ছিলেন সমসাময়িক। ব্যঙ্গচিত্র আঁকার দায়ে আমাদের দেশেও খড়গ নেমে আসার ঘটনা বিরল নয়। দার্শনিক প্লেটোও অবশ্য ব্যঙ্গচিত্র সহ্য করতে পারতেন না। তিনি ব্যঙ্গচিত্রকে ব্ল্যাক ম্যাজিক বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। রাজনেতার অহংবোধও সুপ্রাচীন।

ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরি যখন রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে ১৫৩৪ সালে পাল্টা চার্চ অফ ইংল্যান্ড তৈরি করলেন, তখনই এস্টাব্লিশমেন্টের ধারণাটিও এল। এই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা থেকে সরে যাওয়া আজ সংবাদমাধ্যমের পক্ষে অসম্ভব। শুধু নীতির জন্য নয়। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী যোগান রক্ষা করার জন্যও।

আরেকটি গুরুতর সমস্যা হচ্ছে, রাজনৈতিক নেতারা চান নিঃশর্ত আনুগত্য। যদি তুমি আমাকে ভালোবাসো, আমাকে সমর্থন করো, তা হলে আমার মতাবলম্বী হতে হবে। বঙ্কিমচন্দ্রের এক অসাধারণ প্রবন্ধ রয়েছে যার নাম ‘ভালোবাসার অত্যাচার’। সেখানে তিনি বলেছেন যে, লোকের বিশ্বাস যারা শত্রু তারাই শুধু আমাদের ওপর অত্যাচার করে। আসলে তা নয়। ভালোবাসার অত্যাচারও ভয়াবহ। ‘তুমি আমাকে ভালোবাসো। অতএব আমার অনুরোধ রাখিতে হইবে। তোমার ইষ্ট হউক, অনিষ্ট হউক, আমার মতাবলম্বী হইতে হইবে।’

তবে সংবাদ মাধ্যমের দায়িত্ব কিন্তু অনেক বেশি। দলবাজি, মতলবি সাংবাদিকতা, গণহিস্টিরিয়া তৈরি করার একটা প্রবণতা যে এই প্রতিযোগিতামূলক সাংবাদিকতায় নেই সেটাও সত্য নয়। আবার সেটাও নতুন নয়। ‘টু ফেস ডেঞ্জার উইথআউট হিস্টিরিয়া’ গ্রন্থে ফরাসী দার্শনিক বার্ট্রাণ্ড রাসেল লিখেছিলেন, ‘হাতি খুব শান্ত ও বিচক্ষণ প্রাণী’।

কিন্তু মধ্য আফ্রিকায় কিছু হাতির পাল যখন সর্বপ্রথম আকাশে এরোপ্লেন উড়তে দেখে, তখন তাদের ভিতর ভীষণ চাঞ্চল্য দেখা দেয়। ওদের চোদ্দো পুরুষে কেউ কখনও এমন আজব শব্দ করা একটা পাখিকে উড়তে দেখেনি। দলের সব হাতি ভয় পেয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি শুরু করে দেয়।

কিন্তু এরোপ্লেনটি দিগন্তে মিলিয়ে যেতে সবাই আবার শান্ত হয়ে লাইন করে হাঁটতে শুরু করল। কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি। কোনো ষড়যন্ত্রের উপাখ্যান রচনা হয়নি। কোনো বিচার বিভাগীয় তদন্তেরও দাবি ওঠেনি।

কারণ, রাসেল লিখেছেন, ‘সেই হাতির পালে কোনো সাংবাদিক ছিলেন না!’

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট

এ সম্পর্কিত আরও খবর