রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো প্রশ্নে সৌদি আরবের ভূমিকা ও আমাদের প্রত্যাশা

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মুফতি এনায়েতুল্লাহ | 2023-08-26 23:53:15

দেনার দায়ে জর্জরিত পাকিস্তানের ডাকে সাড়া দিয়ে গোয়েদার সমুদ্রবন্দরে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে তেল শোধনাগার বানানোর কথা জানিয়েছে সৌদি আরব। এই বিনিয়োগের পরিমাণ দশ বিলিয়ন ডলার। রোববার (১৩ জানুয়ারি) পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের গোয়েদার বন্দরে দাঁড়িয়ে এই আর্থিক সাহায্যের কথা ঘোষণা করেন সৌদি আরবের জ্বালানি শক্তি মন্ত্রী খালিদ আল ফালি।

এর আগে ২০১৫ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার কোনো শরণার্থীকে নিজ দেশে আশ্রয় না দিলেও জার্মানিতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের জন্য ২০০টি মসজিদ নির্মাণ করে দিতে চেয়েছিল সৌদি আরব।

প্রতি হজে বিভিন্ন দেশ থেকে কয়েক হাজার মুসলমানকে বিনাখরচে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে হজ পালনের সুযোগ করে দেয় সৌদি সরকার। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশে মসজিদ নির্মাণ, কোরআন বিতরণ ও অসহায় মানুষের পাশে তাদের প্রায়ই দাঁড়াতে দেখা যায়। এমনকি ফিলিস্তিনের পাশে সৌদি আরব অকাতরে অর্থ নিয়ে পাশে দাঁড়ায়।

কিন্তু এই সৌদি আরবই আঞ্চলিকভাবে নেতৃত্বের আসনে বসতে দরিদ্র ইয়েমেনে আগ্রাসন চালিয়েছে, বিনা কারণে কাতারে অবরোধ জারি করে রেখেছে। ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে আপন চাচাতো ভাইদের বন্দী করে অর্থ আদায়, পথের কাঁটা ভেবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে পদচ্যুত করা তো নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। এসবকে দেশটির অভ্যন্তরীণ ইস্যু বলা হলেও ইস্তাম্বুলে সৌদি কনসুলেটের ভেতরে সাংবাদিক জামাল খাশোগির খুনের বিষয়টি কোন পর্যায়ে ধরতে হবে- সেটা নিয়ে বিস্তারিত না বললেও চলে।

সেই সৌদি আরব এবার তার দেশে আশ্রয় নেওয়া কিছু রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, দীর্ঘদিন সৌদি আরবে অবস্থানরত, ভিসা জটিলতার কারণে জেলে আটক এমন অন্তত ১৩ জন রোহিঙ্গাকে সৌদি কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছে। আরও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পাঠানোর প্রস্তুতি শেষ করেছে। সৌদি কর্তৃপক্ষের পাঠানো রোহিঙ্গাদের এই সংখ্যা যদিও খুব বেশি নয়, কিন্তু তাদের ফেরত পাঠিয়েছে সৌদি আরব, তাতেই আপত্তি।

কারণ বিশ্ববাসী জানে, রোহিঙ্গা মুসলমানরা বিশ্বের চরমতম জাতিগত নির্মূলের শিকার। প্রায় পাঁচ দশক ধরে তারা মিয়ানমার বাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে রোহিঙ্গা আশ্রিতদের সংখ্যা ১১লক্ষাধিক। সম্প্রতি সেখানকার রাষ্ট্রীয় বাহিনী নতুন করে আবার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে। এতে করে আশঙ্কা করা হচ্ছে, বাংলাদেশে শরণার্থীদের সংখ্যা আরো বাড়বে। প্রতিবেশী অন্যান্য দেশেও রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে আছে। এদের জাতিগত পরিচয় না থাকায় অবৈধপন্থায় বিভিন্ন দেশের পাসপোর্ট সংগ্রহ করে নানান দেশে যাতায়াত ও কর্মসংস্থান করছে।

ইউরোপের কয়েকটি দেশ মুসলমান অভিবাসীদের প্রশ্নে আইনগতভাবে নমনীয়, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। সিরিয়া, ইরাক ও লিবিয়া থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের জন্য জার্মান সরকারের উদার দৃষ্টিভঙ্গি ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক শরণার্থী ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রশংসা লাভ করেছে। বাংলাদেশের মতো জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ, দরিদ্র দেশও মানবিক কারণে এবং বিশ্বসম্প্রদায়ের আহবানে সাড়া দিয়ে ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীর বোঝা গ্রহণ করতে কুণ্ঠিত হয়নি।

অথচ অত্যাচারিত রোহিঙ্গাদের প্রতি সৌদি আরবের মতো দেশের অমানবিক আচরণ দু:খজনক। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত-নিপীড়িত এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি সৌদি আরবের এই আচরণ মুসলিম বিশ্বকে ব্যথিত করে। মুসলিম জাহানের পীঠস্থান, মুসলমানদের প্রধান দুই মসজিদের জিম্মাদার হিসেবে সৌদি আরবের কাছে বিশ্বের নিপীড়িত মুসলমানরা সদয় ও মানবিক আচরণ প্রত্যাশা করে।

রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সমস্যা একটি আন্তর্জাতিক মানবিক এজেন্ডা। মায়ানমার সরকার তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে, ভিটেমাটি ছাড়া করেছে, দেশ ত্যাগে বাধ্য করেছে। বিশ্বের অন্যতম নিপীড়িত জনগোষ্ঠী গণহত্যার শিকার হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান বহু বছর ধরে সৌদি আরবে আছে। যে সব রোহিঙ্গাকে ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে, তারাও কমপক্ষে ৬ বছর ধরে সেখানকার বন্দী শিবিরে অবস্থান করছিল বলে জানা যায়।

এসব রোহিঙ্গাকে বৈধ কাগজপত্র দিয়ে সৌদি আরবে থাকা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব সৌদি কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না। শুধুমাত্র পাসপোর্ট জটিলতার কারণে বছরের পর বছর ধরে কারারুদ্ধ রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর আগে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা বাংলাদেশ দূতাবাসকে অবহিত করা হয়েছিল কিনা তা স্পষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে সৌদি কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালির পাশাপাশি বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার বিষয়টিও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

রোহিঙ্গা নাগরিকরা মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের দ্বারা যে নৃশংস নিপীড়নের শিকার হচ্ছে তার বিপরীতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের ভূমিকা খুবই অপ্রতুল। অনেক বড় ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশ তার মানবিক দায়িত্ব পালন করলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা এখনও কার্যত আশ্বাসের মাঝেই সীমাবদ্ধ। রোহিঙ্গা সংকট প্রশ্নে সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশ সৌদি আরবের কাছে আরও ঘনিষ্ঠ, উদার ও দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রত্যাশা করে। সে ভূমিকা পালনের বদলে আশ্রয়হীন রোহিঙ্গাদের সৌদি কারাগার থেকে বাংলাদেশে পাঠানোর হঠকারী সিদ্ধান্ত অনাকাঙ্খিত ও দু:খজনক।

রোহিঙ্গা সংকট ইস্যুতে জাতিসংঘসহ বিশ্বসম্প্রদায়ের উদ্যোগগুলো মিয়ানমারের সহযোগিতার অভাবে একের পর এক ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় সৌদি আরবসহ ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর পক্ষ থেকে আরও দৃঢ়, জোরালো উদ্যোগ প্রয়োজন। এটা একটি জাতিকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই জরুরি।

মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ একদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তির নাটক করছে, অন্যদিকে প্রত্যাবাসন ঠেকাতে নানা অজুহাত দাঁড় করাচ্ছে। সব আন্তর্জাতিক আহবান ও কনভেনশন উপেক্ষা করে মিয়ানমার সরকার আবারও রাখাইনে সেনা অভিযান পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছে। এ থেকেই রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারের অবস্থান বোঝা যায়।

এগারো লক্ষাধিক রোহিঙ্গা অভিবাসীর বোঝা স্থায়ীভাবে বহনের শক্তি বাংলাদেশের নেই। এই সংকটের ভূ-রাজনৈতিক আশু সমাধান প্রয়োজন। নাগরিকত্বের প্রশ্ন, মানবিক মর্যাদা ও জীবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তাসহ রাখাইনে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ভরণ-পোষণের ব্যয় মেটাতে পশ্চিমাবিশ্ব ও মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলোর কাছে আরও উদারদৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাশিত।

বছরের পর বছর ধরে সৌদি আরবে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত সৌদি কর্তৃপক্ষ কীভাবে নিল তা আমাদের বোধগম্য নয়। যেকোনো বিচারে এটি বাংলাদেশের জন্য অসম্মানজনক ও বিব্রতকর। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সৌদি-বাংলাদেশের ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্ক এবং রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক দিক বিবেচনায় এ ক্ষেত্রে একটি গ্রহণযোগ্য ও সম্মানজনক সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে।

একজন মুসলমান হিসেবে আমরা জানি, ইসলামের শিক্ষা হলো- ঐক্যবদ্ধ থাকা, এতিমদের যত্ন নেওয়া, গৃহহারাদের আশ্রয় দেওয়া, দরিদ্রদের খাবার দেওয়া। সেখানে সৌদি আরব কর্তৃপক্ষ যেখানে নিজেকে পবিত্র দুই মসজিদের সেবক বলে দাবি করে, তাদের থেকে এমন অমানবিক ভূমিকা কোনোভাবেই কাম্য নয়। নিকট অতীতকালে অনেক মুসলিম দেশের সংকটে সৌদি আরবকে সেভাবে কোনো ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি। অথচ সারাবিশ্বের মুসলমানদের হৃদয়ে রয়েছে সৌদি আরবের নাম। সৌদি আরবকে আমরা সম্মানের চোখে দেখি, হৃদয়ে স্থান দেই, মর্যাদার আসনে বসাই। কিন্তু সৌদি আরব কর্তৃপক্ষ কি কখনও সেভাবে দেখেছে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহকে, বিশ্ববাসীকে?

তাই সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিশ্ব মুসলমানদের ঐক্যের প্রতীক সৌদি কর্তৃপক্ষ নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াবে, তাদের আশ্রয় দেবে তথা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এটাই প্রত্যাশা।

মুফতি এনায়েতুল্লাহ: বিভাগীয় সম্পাদক, ইসলাম, বার্তা২৪.কম।

এ সম্পর্কিত আরও খবর