শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বদলে যাচ্ছে দক্ষিণ এশীয় দৃশ্যপট

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 18:19:54

ভারত ও পাকিস্তান ভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়ার ধারণা আমূল বদলে যাচ্ছে। প্রচলিত কাঠামো ছাড়িয়ে উপমহাদেশের পূর্বমুখী একটি অবয়ব তৈরি হচ্ছে ক্রমশ। উপমহাদেশের পালাবদল ও রূপান্তর ধারায় বাংলাদেশের উত্থান হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার ভরকেন্দ্র রূপে, যা হতে পেরেছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়নের পাশাপাশি বদলে যাচ্ছে দক্ষিণ এশীয় দৃশ্যপট।

আধুনিক রাজনৈতিক পণ্ডিতরা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক নেতৃত্বের সফলতা ও সাম্প্রতিক নির্বাচনী বিজয় প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন ‘রাজা মানদেলা’ (Rajamandala) প্রত্যয়, সংস্কৃত যে শব্দটির অর্থ হলো ‘সার্কেল’ বা ‘বৃত্ত’। ধ্রুপদী ভারতীয় পণ্ডিত কৌটিল্য তার বিশ্বখ্যাত ‘অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থে দুই সহস্র বছর পূর্বে (খ্রিস্ট.পূ. ৪র্থ শতকে) ধারণাটি সর্ব প্রথম তুলে ধরেন। যা বোঝায় রাজাকে কেন্দ্র করে বন্ধু ও শত্রু দেশের বৃত্ত। প্রতীকী অর্থে এতে এমন একটি সৌরজগতের চিত্র দেওয়া হয়েছে, যাতে রাজাকে কেন্দ্র করে শত্রু ও মিত্র রাষ্ট্রগুলো আবর্তিত হচ্ছে। এবং রাজা সেগুলোকে বশীভূত করে নিয়ে নিজের আয়ত্ত্ব ও নিয়ন্ত্রণে রাখছেন। শেখ হাসিনা সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে শত্রুতা ও মিত্রতার মাঝখানে এমনই সাফল্য অর্জন করেছেন এবং তার শাসনকালে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষমতা ও শক্তির একটি নতুন ভরকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। 

আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, সদ্য সমাপ্ত নির্বাচন শেখ হাসিনার অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের চলমান অগ্রগতিকেও একটি টেকসই ভিত্তি দিয়েছে। টানা তিন বার সহ চার বারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শেখ হাসিনা দক্ষিণ এশিয়া ও বিশ্বের মধ্যে যেমন বিরল সম্মান পেয়েছেন, তেমনিভাবে বাংলাদেশও পৌঁছে যাচ্ছে উন্নততর একটি লাগসই অবস্থানে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নির্বাচনী বিজয়ের ডামাঢোল আর বিরোধীদের বিচ্ছিন্ন অভিযোগের ফাঁকে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ এশিয়ার কাঠামোগত রূপান্তর ও এর দীর্ঘমেয়াদী প্রতিফলের বিষয়টি সাধারণ মানুষের চোখের আড়ালে থেকে যাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের নির্বাচনের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে দেশটির বিরাট বিকাশ ও সম্ভাবনার মধ্যেই লুক্কায়িত রয়েছে।

এটা ঠিক যে, ব্যক্তি হিসাবে টানা তিন বার বিজয়ী হওয়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বের মুকুটে সাফল্যের অনেকগুলো পালক যুক্ত করেছে। বর্তমান হ্যাট্রিকের সঙ্গে আগের ১৯৯৬-২০০১ সালের শাসন মিলিয়ে তিনি শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নন, বিশ্বের মধ্যেই দীর্ঘতম শাসন নেতৃত্বের রেকর্ড গড়েছেন। অনেক নেতাই নিজ নিজ দেশে দীর্ঘকাল শাসনে ছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনার মতো এতো দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থেকে আঞ্চলিক রাজনীতির প্রচলিত কাঠামো ভেঙে নিজের দেশকে সামনে নিয়ে আসার সফলতা অনেকেই দেখাতে পারেন নি। শেখ হাসিনার শাসনের বিগত যুগে দেশের অর্থনীতির নাটকীয় উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশকে স্থিতিশীলতা ও ধারাবাহিকতার সঙ্গে সঙ্গে শাসনের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার সক্ষমতা নিজের দেশকে ছাড়িয়ে আঞ্চলিক রূপান্তরকেও তার নিজের পক্ষে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে।

পরিসংখ্যান ও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বলা হচ্ছে যে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুততম গতিতে বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। দেশটির মাথাপিছু আয় দশ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের সামনের দিকে চলে আসা এখন শুধু সময়ের বিষয় মাত্র। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির বছর ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ থেকে ১০-এর ঘরে নিয়ে আসার চ্যালেঞ্জ সফল করার পথে চলেই শেখ হাসিনা ক্রমে ক্রমে দেশের অর্জনকে বিকশিত করছেন।

 ‘বাংলাদেশের এই ইতিবাচক অর্থনৈতিক পরিবর্তন দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের জন্য কি বার্তা বহন করছে?’ এমন প্রশ্ন নিয়েও বিশ্লেষক আর গবেষকরা কাজ করে পেয়েছেন বেশ কিছু উত্তর। প্রথমত বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রা দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক পদক্রমকে ভেঙে দিয়েছে। ইতিমধ্যেই পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন ১৮০০ ডলার, যা  পাকিস্তানের ১৬০০ ডলার মাথাপিছু আয় বা পারকেপিটা ইনকামের চেয়ে বেশি। সামনের বছরেই বাংলাদেশের ২৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের জিডিটি পাকিস্তানের ৩১০ বিলিয়ন ডলারের জিডিপিকে অতিক্রম করবে বলেও বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন। এটা বলা হচ্ছে, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্তানের অর্থনীতির ভঙ্গুর দশার বিপরীতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের ক্রম বিকাশমান অর্থনৈতিক সূচক ও মানদণ্ড দেখে। কারণ শেখ হাসিনা ঋণ ও সাহায্য নির্ভর অর্থনীতিকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ভিত্তিক অর্থনীতিতে বদলে দিয়েছেন এবং এর সুফল জাতীয় অথনীতিতে পেতে শুরু করেছেন।

বাংলাদেশের এই অর্জনকে মডেল হিসাবে গ্রহণের জন্য পাকিস্তানের ভেতর থেকেও দাবি উঠেছে। ট্র্যাডিশনাল মনোবৃত্তি ভেঙে রাজনৈতিক উচ্চাশা ও ধর্মীয় উদারতা এবং আধুনিকতার পথে ‘বাংলাদেশ মডেল’ গ্রহণ করা মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ও সামরিকতন্ত্র প্রভাবিত পাকিস্তানে পক্ষে কতটুকু সম্ভব হবে, তা নিয়েও আশঙ্কা রয়েছে। কারণ রাজনৈতিক ও সুশাসনের সমস্যা পাকিস্তানের অর্থনীতিকে পেছনে টানছে, যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হচ্ছে না বলেই সব দিক থেকে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে দিচ্ছে।

তদুপরি বাংলাদেশের উত্থান দক্ষিণ এশিয়ার ভারসাম্যকে নিজের দিকে টেনে আনছে এবং উপমহাদেশের অর্থনৈতিক ভরকেন্দ্রকে পূর্ব দিকে নিজের আরো অনেক কাছে নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি শুধু এদেশকেই নয়, ভারতের উত্তরপূর্ব রাজ্যসমূহ, নেপাল, ভূটানসহ সমগ্র উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলকেই গুণগতভাবে প্রভাবিত করেছে। বাংলাদেশের কারণে উপমহাদেশের প্রায়-অবহেলিত উত্তর ও পূর্বাঞ্চল চলে এসেছে উন্নয়ন ও অগ্রগতির পাদপ্রদীপের আলোতে।

দক্ষিণ এশিয়ার ভৌগোলিক মানচিত্রের দিকে তাকালে একটি অদ্ভুত বিষয় লক্ষ্য করা যায়। তা হলো পশ্চিম দিকে পাকিস্তান আর পূর্ব দিকে বাংলাদেশ হলো উপমহাদেশের দুটি সেতু। সেতুরাষ্ট্রের মতো দেশ দুটি উপমহাদেশকে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। কিন্তু পাকিস্তান তার প্রবেশ পথটিকে বিঘ্নিত করেছে পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে সন্ত্রাস ও আন্তঃসীমান্ত সমস্যা ও জঙ্গিবাদ বিস্তারের মাধ্যমে। আফগান, তালেবান সন্ত্রাসী তৎপরতাকে পাকিস্তান জিইয়ে রাখছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ সীমান্তের দিক থেকে এমন সমস্যায় আক্রান্ত হয়েও শান্তি এবং স্থিতিশীলতার আঞ্চলিক সহযোগিতার পথ বেছে নিয়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যাকে মানবিক দিক থেকে বিবেচনা করে বাংলাদেশ এটিকে রক্তক্ষয়ী পথে যেতে দেয় নি।

শান্তি, স্থিতিশীলতা ও পারস্পরিক সহযোগিতার আর্দশ বাংলাদেশের মব্জাগত ঐতিহ্য, যা প্রস্ফূটিত হয়েছিল বহু বছর আগে ঢাকায় দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা সংস্থা ‘সার্ক’ গঠনের মাধ্যমে। ‘সার্ক’ অনেক ইতিবাচক কাজ করলেও ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সহযোগিতা গড়ার নেতিবাচক প্রবণতার কারণে পিছিয়ে থাকছে। তবে ‘সার্ক’-এর কাঠামোয় অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বিকাশের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের অনীহা ‘শাপে বর’ এনে দিয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভূটানকে নিয়ে পূর্বাঞ্চলীয় সাব-রিজিওনাল ফোরাম গড়ে উঠতে পেরেছে। পাশাপাশি পাঁচটি দক্ষিণ এশীয় (বাংলাদেশ, ভূটান, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা) এবং দুটি দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশ (মায়ানমান, থাইল্যান্ড) নিয়ে ট্রান্স-রিজিওনাল সহযোগিতা ফোরাম বিমসটেক নবশক্তি লাভ করেছে।

চীনের ইউনান প্রদেশ থেকে বাংলাদেশ, ভারতের পূর্বাঞ্চল ও  মায়ানমারের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা সংহতি বলয়ের (বিসিআইএম) সাফল্য নিয়ে বাংলাদেশ কিছুটা সমালোচনাপ্রবণ। কারণ, চীন-পাকিস্তানের অর্থনৈতিক করিডোরের ক্ষেত্রে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় নি। ফলে 'বিসিআইএম করিডোর' নিয়ে পূর্ণ আশাবাদী হওয়ার সুযোগ কম। কারণ, এখানে রোহিঙ্গা সমস্যা আঞ্চলিক সহযোগিতার ভবিষ্যত সাফল্যের উপর কালো ছায়া ফেলেছে। এমন সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ মায়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করে সমস্যাগুলো সমাধানের পথ দেখাচ্ছে এবং তিনটি আঞ্চলিক পরাশক্তি, যথা, ভারত, চীন ও আসিয়ানকে টেনে এনে আঞ্চলিক শান্তি, সমৃদ্ধি ও সহযোগিতার ক্ষেত্র উন্মোচনের প্রণোদনা জাগাচ্ছে।

শেখ হাসিনার শাসনে বাংলাদেশের আরেক বড় সাফল্য হলো ভারত ও মায়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র সীমানার সমস্যা শান্তিপূর্ণভাবে নিপত্তি করা। এতে বাংলাদেশের জন্য সমুদ্র দিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের পথ প্রশস্ত হয়েছে। শান্তিপূর্ণ বঙ্গোপসাগর দিয়ে বাংলাদেশের সামনে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিগন্ত খুলে গেছে। বাংলাদেশ চলে এসেছে আঞ্চলিক যোগাযোগের লাইমলাইটে।

বহুকাল ধরে ঐতিহ্যগতভাবে দক্ষিণ এশিয়ার ভূগোলকে বিশ্ব দেখেছে ভারত আর পাকিস্তানের অবস্থানের ভিত্তিতে। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্কে উঠা-নামার আলোকে প্রণীত হয়েছে বিশ্বের নানা দেশের দক্ষিণ এশীয় নীতি ও কর্মসূচি। যে দেখার ও পদক্ষেপ নেওয়ার মধ্যে দেশ দুটির মধ্যকার সন্দেহ ছিল, সংঘাত ও বৈরীতা ছিল। ভারত ও পাকিস্তানের মেরুকরণের ফলে পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্রের বিপদ সৃষ্টি হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায়। দক্ষিণ এশিয়ার এই নেগেটিভ ইমেজ ভাঙছে বাংলাদেশের উত্থানে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দক্ষিণ এশিয়ার পূর্বাঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছে নতুন ভরকেন্দ্র। বাংলাদেশের নির্বাচনে শেখ হাসিনার ধারাবাহিক নেতৃত্বের ইতিবাচক ফল বাংলাদেশ ছাড়িয়ে উপমহাদেশ ও বিশ্বকেও প্রভাবিত করার বিষয়গুলোই এখন সব কিছুকে ছাপিয়ে সামনে চলে আসছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর