কওমি সনদের স্বীকৃতি, বছরের অন্যতম প্রাপ্তি

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মুফতি এনায়েতুল্লাহ | 2023-08-24 11:25:51

নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার সাক্ষী হয়ে কালের গর্ভে হারিয়ে গেল ২০১৮। আবির্ভূত হলো নতুন বছর ২০১৯। ইংরেজি নববর্ষকে আমরা স্বাগত জানাই। মানুষ তো আশায় ঘর বাঁধে, তাই আমরাও নতুন বছরে আশাবাদী হতে চাই, ব্যর্থতার গ্লানিকে পেছনে ফেলে নতুন অভিযাত্রায় সামনে পথ চলতে চাই।

এই নতুন বছরের পাটাতনে দাঁড়িয়ে যদি পেছনের বছরের দিকে তাকাই, তাহলে কিছু অর্জন দারুণ আশার সঞ্চার ঘটায়। আর কিছু বিষয় হৃদয়ে রক্ষক্ষরণ ঘটায়। তারপরও বলা চলে, সবকিছু ছাপিয়ে বছরটি আলেম-উলামাদের জন্য ছিল বেশপ্রাপ্তির। কারণ ২০১৮ সালে কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসকে স্নাতকোত্তর সমমানের স্বীকৃতি আইনি বৈধতা পেয়েছে। এ বছর (১৯ সেপ্টেম্বর) ‘আল-হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’-এর অধীন ‘কওমি মাদরাসাসমূহের দাওরায়ে হাদিসের (তাকমিল) সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান প্রদান বিল-২০১৮’ জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে।

২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল কওমি মাদরাসার সনদের সরকারি স্বীকৃতির ঘোষণা ও ২০১৭ সালের ১৩ এপ্রিল এ সংক্রান্ত সরকারি গেজেট প্রকাশের ১৭ মাস পর ২০১৮ সালের শেষদিকে নির্বাচনের আগ মুহূর্তে কওমি সনদের বিল সংসদে পাশকে অনেকেই সরকারের নির্বাচনী কৌশল বলা চেষ্টা করেছেন।

যদিও কওমি মাদরাসার সনদকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নতুন নয়। ২০০৬ সালে খালেদা জিয়া তার সরকারের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি প্রদানের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই ঘোষণা এসেছিলো ওই সরকারের মেয়াদের প্রায় শেষ পর্যায়ে এবং সে বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হলেও তা বাস্তবায়নের কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের সময় বা সুযোগ জোট সরকার পায়নি। ক্ষমতার হাত বদলের কারণে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের সম্ভাবনা তিরোহিত হয়।

জোট সরকারের সিদ্ধান্তের বারো বছর পর আওয়ামী লীগ সর্বস্তরের কওমি আলেমদের আস্থায় এনে স্বীকৃতির ঘোষণা দিয়েছে এবং তা বাস্তবায়নের জন্যে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। বরং আলেম-উলামাদের মতামতের ভিত্তিতে দেওয়া হয়েছে। কারণ আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালে সরকার গঠনের পর থেকে সনদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সেটি ২০১০ সালে গ্রহণ করা শিক্ষানীতিতেও স্থান পায়। ২০১৩ সালে কওমি সনদের স্বীকৃতি বাস্তবায়নে আল্লামা আহমদ শফির নেতৃত্বে কওমি কমিশন গঠন করে সরকার। কিন্তু নানা কারণে সেই প্রক্রিয়া আর আগায়নি।

২০১৪ সালে দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠনের আবারও বিষয়টি আলোচনায় আসে। শুরু হয় সনদ প্রদানের প্রক্রিয়। এই সময়টুকুতে সরকারের ভূমিকা, কওমি মাদরাসা সংশ্লিষ্টদের মনোভাব বিশেষত মাদরাসা শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নানা বিশ্লেষণ ও মন্তব্য শোনা গেছে। সরকারবিরোধী মহল থেকে কওমি সনদের স্বীকৃতিকে রাজনৈতিক অবস্থান আখ্যা দেওয়ার চেষ্টাও কম হয়নি। দেওয়া হয়েছে বন্ধুবেশে নানা পরামর্শ। আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে কওমি মাদারাসার অস্বিত্ব ও স্বকীয়তা নিয়েও। এসব কিছু ছাপিয়ে অবশেষে কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি হয়েছে। এটা ২০১৮ সালের অন্যতম এক প্রাপ্তি।

বাংলাদেশে প্রচলিত দু’ধরণের মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে কওমি মাদরাসা একটি। ১৯ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রতিষ্ঠিত দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসার অনুসরণে বাংলাদেশেও কওমি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন হয়। দীর্ঘকাল ধরে কওমি মাদরাসা সরকারের আর্থিক সহায়তা ছাড়া সাধারণ জনগণের সহায়তায় পরিচালিত হয়ে আসছে। সরকারের স্বীকৃতির ফলে কওমি মাদরাসার পরিচালনা পদ্ধতিতে কোনো পরিবর্তন ঘটবে না, স্বকীয়তায় কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না। সরকার শুধু তাদের শিক্ষার মানের সমমান ঘোষণা করেছে।

কওমি সনদের মান প্রদানের পদক্ষেপের জন্যে কওমি আলেমরা সরকার প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শোকরানা মাহফিলের মাধ্যমে তার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। নানা প্রেক্ষাপটে সরকারের সঙ্গে কওমি আলেমদের দূরত্ব ছিলো, কওমি সনদের স্বীকৃতি ও শোকরানা মাহফিলের মাধ্যমে তা কেটে যায়। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা সম্পর্ক তৈরি হয়।

আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলেম-উলামাদের সম্পর্ক নিয়ে নানা মিথ রয়েছে। অজানা কারণে আওয়ামী লীগকে ইসলামবিরোধী কিংবা আলেম-উলামা বৈরী দল মনে করা হয়। প্রচলিত এ ধারণা ভেঙে আলেম-উলামাদের সঙ্গে বেশ কয়েক বছর ধরে ক্ষমতাসীনদের সুসম্পর্ক বিরাজ করছে। ২০১৮ সালে এটা একটা বড়প্রাপ্তিই বটে। আমরা আশা করি, নতুন বছরেও সুসম্পর্কের এমন ধারা বজায় থাকবে।

লেখার শুরুতে বলেছিলাম, ২০১৮ সালের প্রাপ্তির সঙ্গে কিছু অপ্রাপ্তি ও হৃদয়ে রক্তক্ষরণের মতো ঘটনা ঘটেছে। তাবলিগ জামাতের অন্যতম মুরুব্বি দিল্লির মাওলানা সাদকে কেন্দ্র করে বিবদমান দ্বন্দ্বের কারণে বাংলাদেশে জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠেয় ৫৪তম বিশ্ব ইজতেমা স্থগিত করা হয়েছে। কাকরাইল মসজিদে তাবলিগের কাজ সীমিত করা হয়েছে। ডিসেম্বর মাসের শুরুতে তাবলিগের মাওলানা সাদপন্থীদের হামলায় বিশ্ব ইজতেমার মাঠে ১ জন নিহত ও শত শত মাদরাসার ছাত্র আহত হয়েছে। তাবলিগের সূচনাকাল থেকে শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করে আসা তাবলিগের কতিপয় সাথীর এমন কর্মকাণ্ডে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটেছে। সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ দারুণভাবে মর্মাহত হয়েছে। বিষয়টি তেমন সুখকর না হলে মনে ভেতরে রক্তক্ষরণ নিয়ে বছরটি শেষ করতে হয়েছে।

বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় মুসলিম দেশ ও মুসলমানদের স্বার্থ থেকে আন্তর্জাতিকভাবে বঞ্চিত করা হচ্ছে। আর বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে কওমি আলেমরা বঞ্চিত হয়ে আসছিলেন শিক্ষার সনদের সমমান না পেয়ে। এমন বাস্তবতায় কওমি সনদের স্বীকৃতির পরবর্তী সময়ে আলেমরা যদি ঐক্য-সংহতি, চেতনা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে বলীয়ান হয়ে নিজেদের সম্পদকে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়- তাহলে ২০১৮ সালের মতো আগত বছরটিও হবে প্রাপ্তির। যে প্রাপ্তি দ্বারা বিশ্ব সভ্যতায় অবদান রাখার মাধ্যমে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হতেও সক্ষম হবে কওমি আলেমরা। নতুন বছরে এ উপলব্ধি হৃদয়ে জাগ্রত হোক এ প্রত্যাশা রইল। সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা।

মুফতি এনায়েতুল্লাহ: বিভাগীয় সম্পাদক, ইসলাম, বার্তা২৪.কম

এ সম্পর্কিত আরও খবর