নির্বাচনের অর্থনীতি

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

এম. এ. মাসুম | 2023-08-25 02:00:49

দীর্ঘ বিরতির পর আবার নির্বাচনী আমেজে সরগরম হয়েছে সারাদেশ। কারণ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দল বর্জন করায় ভোটের অর্থনীতিতে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচন সবদল অংশগ্রহণ করায় নির্বাচনের দিন যতই এগিয়ে আসছে ততই স্ফীত হচ্ছে ভোটের অর্থনীতি।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যয় ছাড়িয়ে যাবে ৪ হাজার কোটি টাকা। প্রার্থীদের ন্যূনতম ব্যয়, ইভিএম প্রকল্পে বরাদ্দ, নির্বাচন কশিন ও আইন-শৃঙ্খলা সংস্থার ব্যয়, ভাতা ও আনুষঙ্গিক কাজে এ খরচ হবে।

জাতীয় নির্বাচনের ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। পাঁচ বছরে বিদ্যমান মূল্য স্ফীতির তুলনায় এ ব্যয় বেড়েছে প্রায় দেড় গুণ। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের বাজেট ছিল প্রায় ৫’শ কোটি টাকা। যদিও শেষ পর্যন্ত সব আসনে নির্বাচন না হওয়ায় ব্যয় হয় ২৮৩ কোটি টাকা। এবারের জন্য নির্বাচন কমিশন (ইসি) এখন পর্যন্ত ব্যয় ধরেছে ৭৩২ কোটি টাকা। তবে ইভিএম কেনার খরচ এ বাজেটের মধ্যে নেই।

এদিকে ইসি নির্বাচনের ব্যয় বাড়ালেও প্রার্থীদের ব্যয়সীমা একই রেখেছে। ২০১৪ সালের মতোই প্রার্থীর ব্যয়ের সীমা ২৫ লাখ টাকা। তবে ভোটারপ্রতি সর্বোচ্চ ব্যয় ৮ টাকার পরিবর্তে ১০ টাকা করা হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাস্তবে প্রার্থীরা অনেক বেশি টাকা খরচ করেন। জানা যায়, প্রত্যন্ত অঞ্চলের উপজেলাগুলোতে জাতীয় সংসদের প্রার্থীরা ১০ থেকে ২০ কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ থাকেন, জেলা সদরের প্রার্থীদের খরচ আরও বেশি, আর মহানগর এবং ঢাকা শহরের প্রার্থীদের কোনো কোনো ক্ষেত্রে শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এবারের নির্বাচনে ৩০০ আসনের জন্য প্রায় ১২ হাজারের কাছাকছি মনোনয়নপত্র বিক্রি করা হয়েছে যা দেশের ইতিহাসে সর্ব্বোচ্চ রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। ফরম কিনতে প্রার্থীদের প্রায় ৩৬ কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে। এদিকে মোট ৩,০৬৫ জন মনোনয়ন জমা দিয়েছেন তার মধ্যে ২,২৭৯ জনকে বৈধ প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। আরও বেশ কিছু প্রার্থী ইসিতে আপিল করেছেন মনোনয়ন বৈধ করার জন্য। যদি ৩,৩৫০ জন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তা হলে সরকারি হিসেবে প্রার্থীদের খরচ হবে ৮৩৮ কোটি টাকা আর। কিন্তু সাধারণ ভোটাররা মনে করেন বাস্তবে প্রার্থীদের মোট খরচ প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।

নির্বাচন কমিশন সূত্র জানা যায়, ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন পরিচালনা ব্যয় ছিল ৭ কোটি ৬২ রাখ ৯৬ হাজার ৩০১ টাকা। অন্যদিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যয় ছিল ২৯ কোটি ৪১ হাজার টাকা। অথচ ওই নির্বাচনের কয়েক মাস পর সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা ব্যয় যেখানে ছিল ১১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা সেখানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যয় ছিল ১৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন পরিচালনা ব্যয় ছিল ৩০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। অন্যদিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যয় ছিল ৪২ রকাটি ৮ লাখ টাকা। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিবৃাচন পরিচালনা ব্যয় ছিল ৬৭ কোটি ২১ লাখ টাকা। অন্যদিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যয় ছিল ৯৭ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।

২০১৮-১৯ অর্থ বছরের বাজেটে সরকার ১ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা নির্বাচন কমিশনের জন্য বরাদ্দ রেখেছেন বলে জানা যায়। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ছিল ৯৫৩ কোটি টাকা। দেখা যাচ্ছে, ২০১৮-১৯ সালের বরাদ্দ পূর্বের বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। মনে করা হচ্ছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখেই এ বছর বাজেট বরাদ্দ বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে। জানা যায়, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য নির্বাচন কমিশন ৭৩২ কোটি টাকা ব্যয় অনুমোদন দিয়েছে। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) প্রকল্পের আংশিক বাস্তবায়নে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে।

নির্বাচনকে ঘিরে অর্থনীতিতে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ধরনের অবস্থাই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এবার প্রায় ২ শতাধিক ব্যবসায়ী এদের মধ্যে দেশের শীর্ষ স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন। ফলে ব্যাপক টাকার প্রবাহ ঘটার সম্ভাবনা আছে। নির্বাচনকে ঘিরে যানবাহন, প্রিন্টিং, আপ্যায়ন, মাইকিং, সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহারে বিপুল অর্থ ব্যয় হবে। নির্বাচনে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হতে পারে। বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাগম এবং টাকার প্রবাহের ফলে গ্রামীণ দ্রব্য সামগ্রী ক্রয়-বিক্রয় বাড়বে। জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর ফলেও টাকার প্রবাহের গতি বাড়তে পারে। ইতোমধ্যেই ব্যানার-ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে শহর ও গ্রামের অনাচে-কানাচে। চায়ের দোকান, মুদি দোকান, বিলাশবহুল শপিং মল, হোটেল, রেস্তোরাঁয় চলছে নির্বাচনী আড্ডা ও প্রচার-প্রচারণা যার প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে।

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাবও পড়তে পারে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, নির্বাচনের কারণে বিদেশি ক্রেতারা রপ্তানী আদেশ কমিয়ে দিতে পারে। কারণ নির্বাচন ও এর পরবর্তী সময়ে সহিংসতার আশংকা থাকে। ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে এক ধরনের শংকা কাজ করে। যদিও পরিসংখ্যানে দেখা যায়, রফতানিতে অধিকাংশ পণ্য বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে ইতিবাচক প্রবাহ লক্ষ্য করা যায়। বিনিয়োগকারীরাও এ সমযে বিনিয়োগে এগিয়ে আসতে ঝুঁকি বোধ করেন। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা তাদের পূঁজির একটি বড় অংশ নির্বাচনে ব্যয় করলে ব্যবসায় তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এদিকে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছে যে, কারও যদি ১ টাকাও ঋণ খেলাপি থাকে তবে আসন্ন সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। অন্যদিকে বিল খেলাপিদের ক্ষেত্রে একই ধরনের ঘোষণা কার্যকরী হবে। গ্রাহকের ক্রেডিট কার্ড ও সাধারণ ঋণের ক্ষেত্রে এখন থেকে এক টাকা ঋণ খেলাপির বিষয়টিও অর্ন্তভুক্ত হবে। ফলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও টাকার প্রবাহ বেড়ে যেতে পারে। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ওপর বিনিয়োগের প্রভাব পড়বে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে উন্নয়ন সহযোগী ও দেশি-বিদেশি বিনিয়েগে আসবে না। অথচ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা কর্মসংস্থানের জন্য প্রচুর বিনিয়োগের প্রয়োজন।

জানা যায়, ইতোমধ্যেই বৈদেশিক সহায়তার অর্থ ছাড় হ্রাস পেয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে সংশোধিত এডিপিতে মোটা অংকের বৈদেশিক সহায়তা বরাদ্দ কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। বিশ্ব ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, এখানে দু’টি ফ্যাক্টর রয়েছে। একটি হচ্ছে নির্বাচন ঘিরে কোনো ধরনের অশান্তির সৃষ্ঠি হয় কিনা ও হলে কি মাত্রায় হতে পারে তার উপর প্রকল্প বাস্তবায়নের অবস্থা নির্ভর করছে। অন্যটি হচ্ছে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে যারা আছেন তাদের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কতটা যুক্ত করা হয়। কারণ প্রকল্প কাজে যুক্ত করলে তারা প্রকল্প বাস্তবায়নে মনোযোগ দিতে পারবেন না।

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহার কেমন হবে- এ নিয়ে সরব দেশের সব শ্রেণি পেশার মানুষ। ইশতেহার নিয়ে আলোচনা চলছে নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যেও। দরিদ্র মানুষের আয়ের তুলনায় নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামের সামঞ্জস্য না থাকায় বিপাকে পড়তে হচ্ছে তাদের। তাই আসন্ন নির্বাচনে এসব পণ্য দ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি চায় তারা। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বেকারত্ব একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের ভারসাম্য উন্নয়নের স্বার্থে সরকারি বেসরকারি নিয়োগের পরিধি বাড়াতে হবে এবং এক্ষেত্রে আরো স্বচ্ছতা চায় তরুণ প্রজন্ম। তাদের মতে, সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে সমান সুযোগ দেশের ভারসাম্য উন্নয়নে অবদান রাখবে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে ২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত গত ১০ বছরে সরকারি-বেসরকারি ১৪টি ব্যাংকের মাধ্যমে দেশের ব্যাংক খাত থেকে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। ব্যাংক খাত রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার পাশাপাশি অনিয়ম ও দুর্নীতি রোধ করে জরুরি ভিত্তিতে এ খাত রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনী ইশতেহারে ব্যাংক খাতের বিষয় উল্লেখ করাসহ সরকার গঠনের পর ব্যাংকিং খাতের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো কী ভূমিকা রাখবে তা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরার আহ্বান জানায় সংস্থাটি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তরের দিক সম্পর্কে নির্বাচনী ইশতেহারে সুস্পষ্ট প্রতিফলন থাকা উচিত। এলডিসি উত্তরণে উন্নয়ন রাষ্ট্র থেকে উদ্যোক্ত রাষ্ট্রে যেতে হবে। আর উদ্যোক্তা তৈরির জন্য সরকারি নীতিগত সহায়তা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। তাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনই সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক উদ্যোগ নিতে হবে।

গণতন্ত্র একটি দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের অন্যতম হাতিয়ার। গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশের অবনতি হয়েছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী দ্যা ইকোনমিষ্ট- এর ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) সূচকে দেখা যায় ২০১৭ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯২তম। আগের বছর ২০১৬ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৮৪তম অবস্থানে। অর্থাৎ এক বছরে সূচকে আট ধাপ নেমে গেছে। গত এক দশকের মধ্যে এই সূচকে এটাই বাংলাদেশের সর্বনিম্ন অবস্থান। বিশ্বের ১৬৫টি দেশের এবং দু’টি ভুখণ্ড নিয়ে এ তালিকা প্রস্তুত করা হয়।

গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশকে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটাতে হবে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহনমূলক, শান্তিপূর্ন, অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে, একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হবে এবং গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে যা আগামীতে একটি আর্থ-সামাজিকভাবে সুখী ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়তে সহায়ক হবে এটাই সকলের প্রত্যাশা।

এম. এ. মাসুম: ব্যাংকার ও কলামিস্ট।

এ সম্পর্কিত আরও খবর