সোশ্যাল মিডিয়া প্রভাবিত মামলায় অস্বস্তিতে সরকার

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ | 2023-09-01 09:11:10

প্রথম আলো পত্রিকার সাভারে কর্মরত প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামস ও সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। কারাগারে আছেন পত্রিকাটির প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামস। মামলা হলেও গ্রেপ্তার হননি সম্পাদক মতিউর রহমান। এ নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড ঘটে গেছে। দৃশ্যমান অনেক কিছুই, এরবাইরে অদৃশ্য অনেক কিছুই হয়তো চলছে। টক অব দ্য কান্ট্রি এই মুহূর্তে এটা। দেশেই কি কেবল সীমাবদ্ধ এই আলোচনা? না, এর রেশ দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিনের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি সামনে আসছে।

প্রথম আলো ও শামসুজ্জামান শামসের ‘অপরাধ’ তারা স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে অপপ্রচার’ চালিয়েছে। ‘ভাত ও মাংসের স্বাধীনতা’ চেয়ে তারা অপরাধ করেছে। পত্রিকাটি স্বাধীনতা দিবসে প্রথম আলোয় “পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব”—এমন এক উদ্ধৃতি দিয়ে একটি সংবাদ ও ফটোকার্ড প্রকাশ করায় অনেকে সংক্ষুব্ধ হন। মামলাও হয় তার নামে। তবে মামলার আগে সাভারের আমবাগান এলাকায় ভাড়া বাসা থেকে শামসুজ্জামানকে সিআইডি আটক করে। গণমাধ্যমে বাদীর যে পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে তাতে দেখা যায় তার নাম সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া। তিনি ঢাকা উত্তর মহানগর যুবলীগের ১১নং ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক। আর প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে যিনি মামলা করেছেন পেশায় তিনি আইনজীবী, নাম আবদুল মালেক ওরফে মশিউর মালেক।

প্রথম আলো পত্রিকা ফটোকার্ডে যে ভুল করেছিল তাতে দেখা যায় জাকির হোসেন নামের একজন দিনমজুরে উদ্ধৃতি দিয়েছে তারা, কিন্তু ছবি দিয়েছে একটা শিশুর। বেসরকারি টেলিভিশন একাত্তর এরপর এক প্রতিবেদনে জানায়, শিশুটি দিনমজুর নয়, এবং তাকে নাকি ওই প্রতিবেদক দশ টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে ছবি তুলেছিলেন। প্রথম আলোর ফেসবুক পেজে প্রকাশের ১৭ মিনিটের মাথায় তারা পোস্টটি সরিয়ে নেয়, এবং অনলাইন ভার্সনে এক সংশোধনীতে জানায় ছবিটি ভুল। এখানেই তাদের ভুল ছিল। সংশোধনী দিয়ে এরপর তারা তাদের মূল প্রতিবেদন অবিকৃত রাখে।

ব্যস, আর যায় কোথায়! মহান স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে অপপ্রচার চালানো হয়েছে, স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে—এমন এক প্রচারণা জোরদার হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। পত্রিকাটি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অবমাননা করেছে প্রচার চালাতে শুরু করেন সরকার-সমর্থক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা। যার জের ধরে হুট করে রাতের আঁধারে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসকে। তুলে নিয়ে যাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে মামলা হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। এরপর তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।

এখানেই থামেনি অনলাইন ঝড়! সরকার-সমর্থক ফেসবুকারদের পক্ষ থেকে দাবি ওঠে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তারের। ২৯ মার্চ মধ্যরাতে রাজধানীর রমনা থানায় মামলা হয় মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে। এই মামলায় শামসুজ্জামান শামস, প্রথম আলোর সহযোগী ক্যামেরাপারসন ও অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করা হয়। এই মামলায়ও প্রভাব রেখেছে অনলাইনের দাবি!

বলা হচ্ছে, স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাকে খাটো করার অপচেষ্টা করেছে প্রথম আলো। অভিযোগ যদি সত্য হয়, তবে এটা তো রাষ্ট্রদ্রোহিতা! এক্ষেত্রে কেন রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ না এনে মামলা হলো অতি-বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে? 'স্বাধীনতা সুরক্ষায়' কেন আশ্রয় নিতে হবে দেশের সবচেয়ে বিতর্কিত আইনের? স্বাধীনতার সুরক্ষার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে কেন বাদী হয়নি রাষ্ট্র?

প্রকৃতই এখানে স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার যে ধোঁয়া তোলা হয়েছে সেটা পত্রিকাটির বিরুদ্ধে দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্ষোভের প্রকাশ। আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখেছি এই পত্রিকাটির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীর ক্ষোভ। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে দলটির অনেকেই প্রকাশ্যে বলে আসছেন। তাদের দৃষ্টিতে ‘যুক্তিসংগত’ কারণ হয়তো আছে, কিন্তু ক্ষোভ ও বিরোধিতা নতুন নয়। এবার যখন সামাজিক মাধ্যমে ফের সেই ক্ষোভ জাগল তখন সেই সুযোগটা নিতে চাইল সরকার। এতে লাভ হলো কার? এক-এগারোর ইতিহাস ও মুহাম্মদ ইউনুস নিয়ে সাম্প্রতিক অবস্থানের কারণে ভাবমূর্তি সংকটে থাকা পত্রিকাটি এতে কি লাভবান হলো না?

এই মুহূর্তে প্রথম আলো পত্রিকা সারাদেশে বিপুল সহানুভূতি পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়াতেও তারা আলোচিত। জাতিসংঘসহ বৈশ্বিক নানা সংস্থার প্রবল প্রশ্নের মুখে পড়েছে সরকার। বাধ্য হয়ে তাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলতে হচ্ছে ‘শিশু নির্যাতন ও শিশুর অপব্যবহারের কারণে’ শামসুজ্জামান শামসকে গ্রেপ্তার হয়েছেন; দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে প্রতিবেদন করার জন্য নয়। শনিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকেই জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাওয়া নিয়ে বাংলাদেশের অনেক সংবাদমাধ্যম নিয়মিত প্রতিবেদন করে আসছে। এ ধরনের খবরের জন্য কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। ওই সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে শিশু নির্যাতন ও শিশুকে অপব্যবহারের জন্য, তিনি একটি নয় বছরের শিশুকে ১০ টাকা দিয়েছিলেন এবং নিজের বক্তব্যকে শিশুর বক্তব্য হিসেবে প্রকাশ করেছেন।

সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তারজনিত অস্বস্তি এড়াতে সরকারকে এখন সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের বিবৃতিতে মুখ ঢাকতে হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদকে বিবৃতির খেলায় নামতে হয়েছে, বিশিষ্ট ব্যক্তি বিশেষণে অনেকের নামে যৌথ বিবৃতি আসছে গণমাধ্যমে। এরই মধ্যে আবার সাংবাদিকদের একটি সংগঠনের দুইদিনে দুইরকম বিবৃতিও দেখতে হয়েছে আমাদের। প্রথম আলোর ফটোকার্ড স্বাধীনতার অবমাননা, এমনটা প্রমাণে ব্যস্ত হতে দেখা যাচ্ছে মন্ত্রী-এমপিদের। আওয়ামী লীগের সহযোগী একটা সংগঠনকে রাজপথে কর্মসূচি পালন করতেও দেখা গেছে শনিবার। এগুলো দেখলেই বুঝা যায় কতটা অস্বস্তিতে রয়েছে সরকার।

সরকারের এই অস্বস্তি স্রেফ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে মামলার কারণেই। ভুল ছবির একটা ফটোকার্ডের প্রত্যাহার ও সংশোধনী যখন এসেছিল তখন এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা উচিত হয়নি। এই বাড়াবাড়িতে দেশে-বিদেশে সমালোচনাই জুটল সরকারের, এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও দুর্বল করল।

আমাদের জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিন স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনচিত্তে নিজের অবস্থা, নিজের অনুভূতি প্রকাশ করার জন্যেই বিশেষ এই দিন। এই অনুভূতি হাসির হতে পারে, কান্নার হতে পারে; এখানে বাঁধাধরা নিয়ম নেই। বন্ধনমুক্ত বলেই তো আমরা স্বাধীন। স্বাধীনতা দিবসে কেউ যদি সংবিধানস্বীকৃত মৌলিক অধিকার নিয়ে কথা বলতে না পারে, যদি বাধা আসে, দাবি ও আক্ষেপকে যদি অন্যায়ভাবে বিকৃত অর্থে প্রচার করা হয়, তবে এটাই মূলত স্বাধীনতাকে খাটো করা।

স্বাধীনতা মানে স্বাধীনতা, যেখানে আনন্দের সঙ্গে থাকতে পারে আক্ষেপের প্রকাশও! সামাজিক মাধ্যম আবেগে-ক্ষোভে কিংবা স্রোত দেখে পরিচালিত হয়, কিন্তু সরকার কেন হবে?

কবির য়াহমদ: কলাম লেখক, ইমেইল: kabiraahmed007@gmail.com

এ সম্পর্কিত আরও খবর