ফলস এলার্ম ও অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ মহড়া

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-09-01 06:15:01

বসন্তের ‘হানামি’বা চেরিফুল ফোঁটার মৌসুমে ছুটির দিনে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেশ মজা করা হয়েছিল। রাতে আরেক অনুষ্ঠানে যেতে হবে। সারাদিন লম্বা ড্রাইভ করে চেরি বাগান ঘুরে ঘুরে বহুদূরের ওপেন লেকে মাছ ধরে সবাই ক্লান্ত। মাছের বারবিকিউ রাতের খাবারের একটি মেন্যু। কিন্তু বাইরে হঠাৎ ঝির ঝির বৃষ্টি ও ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করলে ক্যাম্পাসের চেরিতলার স্পট পরিত্যাগ করে সবাই আমাদের ডর্মের দ্বিতীয় তলার হলঘরে গিয়ে উঠলাম। সেখানে ফ্রি চুলায় রান্নাসহ সব ব্যবস্থা ছিল।

সবাই খুব ব্যস্ত হয়ে রান্না-বান্নার কাজে মনোযোগ দিয়েছিল। বিদেশের ওসব পার্টিতে কারো বাবুগিরি করা চলে না। সবাই খুশীমনে সবকাজে অংশ নেয়ার নিয়ম। রান্না শেষে খাবার সাজানো হয়েছে। এমন সময় ডর্মের ‘ফায়ার এলার্ম’ বেজে উঠলো। বেশ কর্কশ স্বরে একবার, দুইবার নয়- তিনবার বাজতে লাগলো। উপরের তলায় কোথাও আগুন লেগেছে এই ভেবে সবাই অতি দ্রুত হলঘর থেকে বের হয়ে বাইরের পার্কিং লটে চলে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ পর জানা গেল আমাদের ভবনে আগুন লাগেনি। আমাদের মাছ বারবিকিউ করার চারকোলের অতিরিক্ত ধোঁয়ায় এক্সজস্টর চালু করে না দেয়ায় বদ্ধ কিচেনের ‘ফায়ার এক্সটিংগুইশার’ মেশিন আগুনের ধোঁয়া আঁচ করে গোটা ভবনে জরুরি এলার্ম বাজিয়ে সবাইকে আগুনের সতর্কবার্তা পৌঁছে দিয়েছে। সবাই জরুরি নির্গমণ পথ অনুসরণ করে নিরাপদে নিচে চলে গেছে।

তখন মনে হয়েছিল- কত সেন্সেটিভ ওদের ‘ফায়ার এক্সটিংগুইশার’মেশিন! একটু বেশিমাত্রার ধোঁয়ার সন্ধান পেলে আর রক্ষা নেই। সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে এলার্ম দিয়ে সবাইকে সতর্ক করে দেয়। এই মেশিন জাপানের সব ভবনের সবঘরেই লাগানো থাকে। শুধু দাউ দাউ আগুন নয়, ধোঁয়ার সূত্রপাত হলেই সেগুলো বেজে উঠে সবাইকে সতর্ক করে দেয়। যাহোক, যারা সেবছর নতুন গিয়েছিল আমাদের ক্যাম্পাসে তারা এলার্ম শুনে অনেকটা ভয় পেয়েছিল। আমরা যারা পুরনো বাসিন্দা ছিলাম তারা এরকম ফায়ার এলার্ম অনেকবার শুনেছি। যেগুলো ছিল সতর্কতামূলক মহড়া মাত্র। পরে সে রাতে আমাদের পার্টি ঠিকমতোই শেষ হয়েছিল।

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার গুলশানের এক আধুনিক বহুতল আবাসিক ভবনের ৭ম তলায় আগুনের সূত্রপাত হয়। সে আগুন উপরের দিকে ছড়িয়ে গেলে ১২ তলা থেকে দুজন লাফিয়ে নিচে পড়লে মারা যান। ঐ অগ্নিকাণ্ডে শিশুসহ ২২ জন আহত হয়।

জানা গেছে, সেই ভবনটিতে আধুনিক অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল। জরুরি নির্গমণ পথ ছিল। ‘ফায়ার এলার্ম’ দেবার মতো ওদের ‘ফায়ার এক্সটিংগুইশার’মেশিন প্রতিটি ফ্লোরে লাগানো ছিল। তবে অনেকে ফায়ার এলার্ম শোনেননি। যারা শুনেছিল তারা ভেবেছে সেটা ছিল ‘ফলস্ ফায়ার এলার্ম’! অথবা রাস্তা দিয়ে অ্যম্বুলেন্স জরুরি এলার্ম বাজিয়ে সব সময় যাতায়ত করে। সেরকম কিছু একটার শব্দ হতে পারে। তাই তারা এলার্মের গা করেননি। আর এরকম একটি আধুনিক ভবন যেখানে কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে অগ্ন্কিান্ডের সময় বাইরে না বেরিয়ে ঘরের ভিতর বসে থাকই ভাল!

অর্থ্যাৎ, আধুনিক যন্ত্রপাতি লাগানো হলেও সেগুলোর ব্যবহার বিধি সম্পর্কে সচেতনতামূলক জ্ঞান তাদের সবার মধ্যে ছিল না। তাইতো একজন বাবুর্চি ও একজন গৃহকর্মী জরুরি নির্গমণ পথ দিয়ে বের হবার চেষ্টা না করে আতঙ্কে ১২ তলার বেলকুনি থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ে মারা গেছেন।

আমাদের দেশে অগ্নিকাণ্ডের প্রতি মানুষের ভয় বেড়েছে। কিন্তু সচেতনতা বাড়েনি। পুরাতন বড় বড় ভবনে এত আধুনিক মানের ফায়ার ‘ফায়ার এলার্ম’ দেবার মতো যন্ত্রপাতি বসানো না হলেও অধূনা এব্যাপারে সচেতনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কারণ, বিল্ডিং কোডের মধ্যে ‘ফায়ার এলার্ম’ দেবার প্রয়োজনীয় যথপোযুক্ত ব্যবস্থা রাখার আইনী বিধান রয়েছে। এটা অমান্য করলে ভবন মালিকের শাস্তি অবধারিত।

তবে বিল্ডিং কোডের এথিকস্ মেনে আংশিক কাজ করে পুরো কাজের জন্য সনদ তুলে নিয়ে ঘরে রাখলেই মানুষ ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ঠেকানো কঠিন। তাই আন্তরিকতার সাথে প্রতিটি ভবনে বিল্ডিং কোডের এথিকস শতভাগ মেনে আধুনিক ফায়ার নিরাপত্তাব্যবস্থা চালু রাখা প্রয়োজন।

পাশাপাশি এলার্ম বাজলো আর আমি শুনেও ঘুমিয়ে থাকলাম সেট করা হলে বিপদ অনিবার্য। অনেক অলস ব্যক্তি জরুরি কাজের জন্য ঘড়িতে জেগে ওঠার সময় এলার্ম দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। এলার্ম ঠিকসময় বেজে উঠলে রাগ করে ঘড়িকে থাপ্পর দিয়ে এলার্ম বন্ধ করে দিয়ে পুনরায় ঘুমিয়ে যেতে দেখা যায়। এর পরিণতি সম্পর্কে তারা মোটেও ভাবেন না। এমন বদঅভ্যাস থাকলে ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে না ঘুমানোই শ্রেয়।

যেটা ঘটতে শোনা গেছে গুলশানের বাড়ির বাসিন্দাদের মুখ থেকে। তাদের কেউ কেউ বলেছেন, অগ্নিকাণ্ডের জরুরি ফায়ার এলার্ম শুনেছেন কিন্তু সেটাকে তারা ‘ফলস এলার্ম’ ভেবেছেন। তাই ভবনের বাইরে যেতে চাননি। এরূপ বিপদের সময় এটা শুধু নিতান্ত অবহেলাই নয়- চরম হেঁয়ালীপনার নামান্তর। এরকম হেঁয়ালীপনা নিজের ও পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।

তাই এই অবস্থা নিরসনের জন্য প্রয়োজন ঘন ঘন সতর্কতামূলক মহড়ার আয়োজন করা। আমাদের দেশে যে হারে সুউচ্চ ভবন তৈরি হচ্ছে এবং যেভাবে মানুষ বহুতল ভবনে বসবাস করতে আগ্রহী হয়ে পড়েছে সেই হারে ফায়ার নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিকশিত হয়নি।

আজকাল বহুতল ভবনে ফায়ার প্রতিরোধী স্প্রে, ফায়ার প্রতিরোধী গ্যাস সিলিন্ডার, পানির পাইপ, মুখোশ, পোশাক ইত্যাদি সংরক্ষণ করতে দেখা যায়। অনেক অফিসের বিভিন্ন তলার কোণায় কোণায় এসব নিরাপত্তা সরঞ্জাম সাজানো থাকে।

কিন্তু কথা হলো সেগুলো শুধু সাজিয়ে রাখার জিনিস নয়। কারণ, মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেলে বা বেশি পুরনো হয়ে গেলে সেগুলো অকার্যকরী হয়ে পড়ে। সেজন্য প্রতি তিন বা ছয় মাস পর পর সেসব জিনিষ ব্যবহার উপযোগী আছে কি-না তা পরীক্ষা করার জন্য জরুরি মহড়ার আয়োজন কার উচিত। বিপদের সময় সেগুলো ঠিকমতো সেবা দেয় না। আবার অনেকেই সেসব নিরাপত্তা সামগ্রীর ব্যবহার করতে জানেন না। এসব জিনিষের মেয়াদ পার হলে সেগুলো ফেলে দিয়ে নতুন নিরাপত্তা কিট্স কেনা উচিত।

এজন্য প্রতিটি ভবনে অফিসে, কারখানায় বাধ্যতামূলক বাজেট রাখার নির্দেশনা বস্তবায়ন করা উচিত। উঁচু অফিস, হোটেল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও বসত ঘরের প্রতিটি কক্ষে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে ‘ফায়ার এক্সটিংগুইশার’ মেশিন লাগানো বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। যারা একটু ধোঁয়া পেলেই জরুরি সংকেত দিবে।

এছাড়া হাসপাতাল, তেলের ডিপো, পাম্প, গুদাম, বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজার এমনকি পল্লী অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোতে নিয়মিত অগ্নিনির্বাপণ মহড়া গ্রহণ করে মানুষকে অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা থেকে সচেতন করার পদক্ষেপ হাতে নেয়া উচিত।

সেসব মহড়ায় বাড়ির বা অফিসের ছোট-বড় সবার অংশগ্রহণ আবশ্যিক করা উচিত। কারণ প্রশিক্ষণ নেয়া থাকলে বিপদের সময় একটি শিশুও অনেক মূল্যবান জান-মাল রক্ষায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

আমাদের দেশে প্রতিটি বিপর্যয় ঘটে যাবার পর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, বোর্ডসভা করা হয়। কিন্তু যেসব ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব সেগুলো নিয়ে পূর্বপরিকল্পনা মাফিক দায়িত্ব পালন বা কাজ সুসম্পন্ন করা হয় কি-না তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। তাই প্রতিটি কাজের জবাবদিহিতা বাড়ানো এবং অত্যাধুনিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করে অগ্নিকাণ্ডের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে জোরদার করতে ও পুরনো নিরাপত্তা সরঞ্জাম পরখ করতে ঘন ঘন অগ্নি-নির্বাপণ মহড়ার আয়োজন করা খুব জরুরি।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

এ সম্পর্কিত আরও খবর