ভৈরব উপজেলার গুরুত্ব ও উন্নয়ন প্রত্যাশা

, যুক্তিতর্ক

এম এ বাকী বিল্লাহ | 2023-09-01 23:21:03

বাংলাদেশের ৪৯৫টি উপজেলার মধ্যে ভৌগোলিক বিবেচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে ভৈরব উপজেলা, যা জেলায় রূপান্তিত করার দাবি স্থানীয় ও জাতীয় প্রয়োজনে বিবেচনাযোগ্য। রাজধানী ঢাকা হতে সড়ক ও রেলপথে সিলেট, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ এই তিন বিভাগের সাথে যোগাযোগের এক গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হচ্ছে এই ভৈরব। মধ্য-বাংলাদেশের তিনটি বিভাগ ও দেশের দুটি প্রধান নদীর সঙ্গমস্থল ভৈরব রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় পালন করতে পারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

যদিও আঠারো শতকের রেনেলের মানচিত্রে ভৈরবের কোন অস্তিত্ব ছিল না। তথাপি, প্রাপ্ত ইতিহাস থেকেোধদদ জানা যায়, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পলিবিধৌত বদ্বীপ এককালে উলুকানদি নামে পরিচিত ছিল।

মুক্তাগাছার জমিদার ভৈরব রায় তার জমিদারী সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে নতুন জেগে উঠা এই এলাকায় মানব বসতি গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে জমিদারের নামানুসারেই এই অঞ্চলের নামকরণ ভৈরব বাজার করা হয় বলে প্রচলিত রয়েছে।

মেঘনা নদীর তীরে অবস্থিত ভৈরব উপজেলার ১২১.৭৩ বর্গকিলোমিটার আয়তন জুড়ে রয়েছে সাতটি ইউনিয়ন ও একটি প্রথম শ্রেণি পর্যায়ের পৌরসভা। বন্দরনগরী ভৈরবের বেশিরভাগ মানুষ হচ্ছেন ব্যবসায়ী। দেশের কয়েকটি পাইকারি কয়লা বিক্রয়কেন্দ্রের মধ্যে ভৈরব একটি। জুতা উৎপাদনের ক্ষেত্রে পুরান ঢাকার পর-ই ভৈরবের অবস্থান। বন্দরনগরী ভৈরবের রাতের মাছের আড়ত বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ মাছের আড়ৎ হিসেবে পরিচিত।

এছাড়াও বিংশ শতাব্দীর একজন সাম্যবাদী ধারার লেখক ও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকারী বিপ্লবী রেবতী মোহন বর্মন, বাংলাদেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি আলহাজ্ব মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি কমান্ডার আব্দুর রউফ-সহ এইরকম খ্যাতনামা অনেকের জন্ম এই ভৈরব উপজেলায়।

এতদসত্ত্বেও শিল্প-সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নে ভৈরব উপজেলা যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছে। শিল্প-সংস্কৃতিতে শহরে কিছুটা উন্নতি দেখা গেলেও গ্রামাঞ্চলে তা একেবারেই নেই বলা যায়। আবার অর্থনৈতিকভাবে যতটা অগ্রগতি থাকার কথা, বাস্তবতায় তা থেকে রয়েছে অনেক পিছিয়ে এই উপজেলা। রাজনীতিতে সেই চিত্র ভিন্ন নয়। পুরো উপজেলায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক চর্চা বিদ্যমান। কাজেই ভৈরব উপজেলার সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন সুদৃঢ় জনঐক্য, সুচিন্তিত পদক্ষেপ, সমন্বিত পরিকল্পনা ও তার সঠিক বাস্তবায়ন করা।

ভৈরব মানে শুধু ভৈরব শহর বা ভৈরব পৌরসভাকে বোঝায় না। ভৈরব মানে পুরো ভৈরব উপজেলা এবং ভৈরব জনপদ মানে আশেপাশে অবস্থিত কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর ও কুলিয়ারচর, নরসিংদীর রায়পুরা ও বেলাবোর কিয়দাংশ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের একাংশ। কাজেই ভৈরবের সাত ইউনিয়নের উন্নয়ন ব্যতীত ভৈরবকে কাঙ্ক্ষিত উন্নতির সোপানে পৌছানো কখনো সম্ভব নয়। আবার ভৈরবকে কেন্দ্রে রেখে আঞ্চলিক উন্নয়ন সাধিত না হলে জাতীয় উন্নয়নে গতিবেগ আনয়ন করাও অসম্ভব। সেক্ষেত্রে পুরো ভৈরব উপজেলা বা প্রস্তাবিত জেলার অগ্রগতির লক্ষ্যে কিছু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বা সম্ভাবনা উত্থাপন করার চেষ্টা করছি, যা স্থানীয়, আঞ্চলিক ও জাতীয় উন্নয়নে নবযুগের সূচনা ঘটাবে।

প্রথমত, ভৈরব পৌরসভাকে পরিকল্পিত শহর হিসেবে গড়ে তুলতে তার রাস্তা-ঘাট পুনঃসংস্কার করে আধুনিকায়ন করতে হবে৷ দুর্জয় মোড়ের বাস টিকেট কাউন্টারগুলোকে সরিয়ে নির্দিষ্ট দূরত্বে স্থাপন করে দুর্জয় মোড়কে করতে হবে যানযট মুক্ত। একইসাথে অবাধে চলাচল ও জানমালের নিরাপত্তার তাগিদে ছিনতাই মুক্ত ভৈরব গড়তে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত জরুরি। ভৈরবের সঙ্গে আশেপাশের অঞ্চলের নিবিড় যোগাযোগের বন্ধন বিঘ্নমুক্ত করতে হবে। কারণ, মসৃণ যোগাযোগ হলো উন্নয়নের প্রধান পূর্বশর্ত।

দ্বিতীয়ত, পৌরসভার সাথে সাত ইউনিয়নের যোগাযোগের আন্তঃসড়কগুলো পুনঃসংস্কার এবং সেসাথে পৌরসভা ও ইউনিয়নের আন্তঃযোগাযোগের প্রত্যেকটি রাস্তার প্রশস্থতা বৃদ্ধি করতে হবে। এর মাধ্যমে আশেপাশে জেলাগুলোর সংলগ্ন অঞ্চলও যোগাযোগের নেটওয়ার্কের আওতায় চলে আসবে।

তৃতীয়ত, ভৈরব ফেরিঘাট হতে কোদাল কাটি, ছাতিয়ানতলা, লুন্দিয়া, খলাপাড়া হয়ে মেন্দিপুর পর্যন্ত সুপ্রশস্থ রাস্তা কাম বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা যেতে পারে৷ এতে করে মেঘনা নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে বিশাল শিল্পাঞ্চল। যার ফলে শিল্প ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে নিঃসন্দেহে। সিলেট, কুমিল্লা, ঢাকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণ সঞ্চারিত হবে এর মাধ্যমে এবং রাজধানী ঢাকার উপর সীমাহীন চাপও কমবে এর ফলে। নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুরের মতো ভৈরব বন্দরকে উন্নত করা হলে দেশের আর্থিক কাঠামো বিকেন্দ্রীকরণ হয়ে আরো গতিশীল হবে।

চতুর্থত, রাজনৈতিক উন্নয়নে গণতান্ত্রিক চর্চার সুষ্ঠু বিকাশের তাগিদে কলেজ ভিত্তিক ছাত্র সংসদ নির্বাচন চালু করা যেতে পারে। একইসাথে গণতান্ত্রিক বিকাশ ও রাজনৈতিক উন্নয়নের জন্য ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক চর্চা তথা তোষামোদি রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিহার করতে হবে। ভৈরবে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি প্রকৌশল ও চিকিৎসা শিক্ষার উচ্চতর প্রতিষ্ঠান করা হলে বৃহত্তর ঢাকা, কুমিল্লা, সিলেট, ময়মনসিংহের একটি বিরাট অঞ্চল আলোকিত হয়ে সুদক্ষ মানবসম্পদের বিকাশক্ষেত্রে পরিণত হবে।

পঞ্চমত, শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে এখনো ভৈরব তথা মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্রের উভয় তীরের গ্রামগুলোতে গ্রাম বা গোষ্ঠী ভিত্তিক সংঘর্ষ লক্ষ্য করা যায়, যা খুনাখুনি পর্যন্ত গিয়ে পৌছায়। তাই সেসকল এলাকায় শিক্ষার প্রসার, সাংস্কৃতিক মানোন্নয়ন, খেলাধুলার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নির্মাণ ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য করণীয় নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করা জরুরি।

এছাড়াও বন্ধরনগরীকে ভৈরবকে দেশের একটি অর্থনৈতিক জোন (EPZ) হিসেবে গড়ে তোলা যায়। যোগাযোগ সুব্যবস্থা ও জনমুখী এই ভৈরবে একটি সরকারি বা বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপন করা যেতে পারে। এমনকি ভৌগোলিক বিবেচনায় এইখানে একটি আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম করা যায় অনায়াসে। যাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে অসংখ্য হোটেল-মোটেল ও পর্যটন সংস্থা। ভাটীবাংলার দ্বার রূপে ভৈরব খুলে দিতে পারে আর্থিক ও পর্যটনের অবারিত সুযোগ। এতে করে,শুধু ভৈরবের নয়, চার বিভাগের সংযোগস্থলে শিল্প-সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সামাজিক গতিশীলতায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে নিঃসন্দেহে।

ভৌগোলিক অবস্থানের সুবাদে চাইলেই এই উপজেলাকে বাংলাদেশের একটি জেলা, অন্যতম একটি অর্থনৈতিক জোন ও পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। কাজেই যারা ভৈরবের অভিভাবক বা নেতৃত্বের শীর্ষে রয়েছেন, প্রয়োজন তাদের আন্তরিক সদিচ্ছা এবং ভৈরবপ্রীতি। পাশাপাশি জাতীয় নীতিনির্ধারকদেরও এক্ষেত্রে মনোযোগী হওয়া আবশ্যক। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ভৈরব হতে পারে বাংলাদেশের সিঙ্গাপুর এবং দেশের অন্যতম মডেল উপজেলা। যে মডেলের সম্ভাব্যতা নিয়ে স্থানীয় উচ্চশিক্ষিত তরুণ জনশক্তি গবেষণামূলক কাজ করছে, যা ক্রমেই ভৈরবের উন্নয়ন প্রচেষ্টা নামে জনমতের অংশে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতিবিদ এবং প্রশাসনের পক্ষে এসব উদ্যোগের প্রতি ইতিবাচক মনোযোগ দেওয়া হলে ও সমন্বয় করা হলে ভৈরব তথা বাংলাদেশের উন্নয়ন ধারায় যুগান্তকারী রূপান্তর সাধিত হবে।

এম এ বাকী বিল্লাহ, সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ, ভৈরব এবং স্নাতকোত্তর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর