‘প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে’ শ্রদ্ধা নিবেদন: যে প্রশ্ন, যে উত্তর

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ | 2023-09-01 09:16:59

সংসদীয় গণতন্ত্রে উত্তরণের পর আওয়ামী লীগ-বিএনপির হাতেই ক্ষমতা। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দু’দলের প্রধান হিসেবে একাধিকবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন, করছেন। বাংলাদেশের রাজনীতি যে পথে সেখানে এ দুই দলের প্রধানই যে প্রধানমন্ত্রী হতে থাকবেন, এই ভাবনা অস্বাভাবিক নয়। মাঝখানে ওয়ান-ইলেভেনের দুঃসহ বিরাজনীতিকরণের অপচেষ্টা ছিল, তবে এই মুহূর্তে স্বাভাবিক রাজনীতির মধ্যেই রয়েছে বাংলাদেশ।

পাকিস্তানের অন্যায়, অনিয়ম, অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরশাসন থেকে মুক্তির সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত হলেও বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাস সুদীর্ঘ নয়। পাকিস্তানের আদর্শিক অনুসারী সামরিক শাসকেরা বারবার দেশকে ক্ষতবিক্ষত করেছে সত্য, তবে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ফিরেছে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাতেই। দেশের গণতন্ত্র কতখানি গণতান্ত্রিক সেটা ভিন্ন আলোচনা, কিন্তু দেশ যে গণতন্ত্রের পথেই আছে সেটা সুখের বিষয়। স্বৈরশাসক এইচএম এরশাদের পতনের পর প্রথমে বেগম খালেদা জিয়া, পরে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়েছে। এরইমধ্যে আবার একাধিকবার ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে। এখন টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী।

দলীয় প্রধানের প্রতি, বিশেষ করে শেখ হাসিনার প্রতি আওয়ামী লীগ এবং বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি বিএনপি নেতাদের রয়েছে সন্দেহাতীত আনুগত্য। ওয়ান-ইলেভেনের ‘বিচ্ছিন্ন বিদ্রোহ’ বাদে এটা নিয়ে কারও প্রশ্ন নেই। ওই সময় আওয়ামী লীগ-বিএনপির কিছু নেতা দল-প্রধানের বিরুদ্ধে গেলেও খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। বিএনপির ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীদের’ কয়েকজন পৃথক দল গঠন করলেও, আওয়ামী লীগের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ নেতারা এতদূর যেতে পারেননি। বিএনপির একটা অংশ ‘কিংস পার্টি’-অনুরূপ দল গড়লেও সেটাও টেকেনি। এদিকে, আওয়ামী লীগের শীর্ষ ক’জন নেতার বিরুদ্ধে ‘মাইনাস’ ফর্মুলার অনুসারী হওয়ার আলোচনা থাকলেও দলটির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমানের সাংগঠনিক দক্ষতায় কিছুই আলোর মুখ দেখেনি। ওয়ান-ইলেভেনের মাইনাস-টু ফর্মুলা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দ্বারাই হয়েছিল। নির্বাচন করতে এসে ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের ওপর ‘সিন্দবাদের ভুতের’ মতো চেপে বসেছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তারা টিকতে পারেনি, তাদেরকেও সরে যেতে হয়েছে। যেভাবেই হোক দেশ ফিরেছে সেই গণতন্ত্রের পথে।

২০০৮ সালের নির্বাচনে ভূমিধ্বস বিজয়ের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দেশ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার চিরতরে বিদায় নিয়েছে। এখন সংবিধানে নেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন হয়েছে দলীয় সরকারের অধীনে; আওয়ামী লীগের অধীনে। ওই দুই নির্বাচন নিয়ে দেশে নানা আলোচনা-সমালোচনা-বিরোধিতা আছে, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি আছে সত্য, তবে এই দাবির পক্ষে নেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের এই রাজনৈতিক অবস্থানে আগামী নির্বাচনও যে দলীয় সরকারের অধীনে হতে যাচ্ছে সেটা বলাই যায়।

গণতন্ত্র ও আনুষঙ্গিক প্রসঙ্গের উল্লেখের কারণ মূলত যতই আলোচনা-সমালোচনা থাকুক আমরা গণতন্ত্রে রয়েছি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছি বলেই আমরা গণতন্ত্র ও বিধিবিধান অনুশীলন দেখতে আগ্রহী। রাষ্ট্রীভাবে রাষ্ট্রাচারের অনুশীলন দেখতে আগ্রহী।

সাতই মার্চ ঐতিহাসিক জাতীয় দিবস। এই দিবস ‘ক’ শ্রেণির জাতীয় দিবস। ২০২০ সালের ১৫ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাধারণ অধিশাখা থেকে মো. সাজ্জাদুল হাসান সাক্ষরিত এই পরিপত্রে এই দিবসটিকে জাতীয় দিবস হিসাবে পালনের কথা জানানো হয়। পরিপত্রে বলা হয়, “সরকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে প্রদত্ত ভাষণের দিনটিকে ‘ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ’ হিসাবে ঘোষণা এবং দিবসটি উদযাপনের লক্ষ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস উদযাপন/ পালন সংক্রান্ত পরিপত্রের ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত দিবস হিসাবে অন্তর্ভুক্তকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। তবে ‘ক’ ক্রমিকে অন্তর্ভুক্ত হলেও দিবসটির ক্ষেত্রে সাধারণ ছুটি প্রযোজ্য হবে না।” এতে আরও বলা হয়, “সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় দিবসটি উদযাপনের উদ্যোক্তা মন্ত্রণালয় হিসাবে দায়িত্ব পালন করবে। তবে, বিষয়ভিত্তিক বণ্টনের আওতায় প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা থাকার পরিপ্রেক্ষিতে দিবসটি উদযাপনে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে সরাসরিভাবে সম্পৃক্ত এবং দিবসটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও সচেতনতা আগামী প্রজন্মের মধ্যে যথাযথভাবে সঞ্চারণের লক্ষ্যে উক্ত কর্মকাণ্ডে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সংযুক্ত করতে হবে।” এরপর ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে ‘জাতীয় পতাকাবিধি ১৯৭২’ সংশোধনে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সরকারি সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। অর্থাৎ এই দিবসটিকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বের পর্যায়ে নেওয়া হয়েছে।

রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ৭ই মার্চ রাষ্ট্রীয়ভাবে এবারও দেশে উদযাপিত হয়েছে। তবে একটা বিষয়ে এসে খটকা লেগেছে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৌহিত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির শ্রদ্ধা নিবেদন। রাদওয়ান মুজিব কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা প্রদর্শন স্বাভাবিক, কিন্তু বলা হচ্ছে ‘প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে’ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন তিনি। জাতীয় বার্তা সংস্থা ‘বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা- বাসস’ ‘প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির শ্রদ্ধা’ শিরোনামের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, “ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে আজ সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। (ঢাকা, ৭ মার্চ, ২০২৩)”। বাসসের এই প্রতিবেদনের সূত্র ধরে দেশের সবক’টি গণমাধ্যম ‘প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে’ রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির শ্রদ্ধা নিবেদনের কথা জানায়। এদিকে বাসস যখন ‘প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে’ শ্রদ্ধা নিবেদনের কথা জানিয়েছে, তখন তথ্য অধিদপ্তরের (পিআইডি) প্রকাশিত ছবিতে ‘প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে’ রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির শ্রদ্ধা নিবেদনের তথ্যের উল্লেখ নেই।

এছাড়া দিবসটি উদযাপনের উদ্যোক্তা হিসেবে স্বীকৃত সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ‘ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ দিবস’ উদযাপনে স্টিয়ারিং কমিটির গত ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখের বৈঠকে ‘প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে’ তৃতীয় কারো শ্রদ্ধা নিবেদনের সিদ্ধান্ত হয়নি। বস্তুত ধানমন্ডির শ্রদ্ধা নিবেদনের বিষয়টি রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির বাইরেই রাখা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী উপস্থিতি কিংবা অংশগ্রহণ থাকতে পারে এমন এক অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত আছে ওই সভায়। সেটা হচ্ছে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ উদযাপন অনুষ্ঠান, যেখানে বলা হয় রাষ্ট্রীয়কাজে প্রধানমন্ত্রী দেশের বাইরে থাকায় তাঁর পরিবর্তে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন।

জাতীয় ঐতিহাসিক দিবসে ‘প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে’ রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির শ্রদ্ধা নিবেদনের যে তথ্য বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা-বাসসের সূত্র ধরে গণমাধ্যমগুলোতে এসেছে সেটা সত্য নয়। এটা বাসসের সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকের অতি-উৎসাহ থেকে লিখিত সংবাদ কিনা সন্দেহ, কারণ রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি সরকারের অংশ নন, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা নন, জাতীয় সংসদের সদস্যও নন, মন্ত্রিসভার সদস্য নন; বলা যায় প্রধানমন্ত্রীর বদলে কোন রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করতে পারেন এমন অবস্থানের নন। এই দিবসটি উদযাপনের উদ্যোক্তা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, এবং তারা এইধরনের কোন কর্মসূচি দেয়নি দিবসে। এখানে বাসস থেকে প্রধানমন্ত্রী ও রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিকে ঘিরে যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে সঠিক নয়।

সশরীর উপস্থিতি ছাড়াও রাষ্ট্রপতির পক্ষে, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদনও রাষ্ট্রাচারের অংশ। করোনাকালীন আমরা দেখেছি এমন অনেক কিছু। প্রতি ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রাচারের যথাযথ অনুশীলন আমরা দেখেছি। এবার রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকের ‘প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে’ জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের যে সংবাদ সেটা রাষ্ট্রাচারের অংশ নয় বলে আমরা মনে করি। রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার পুত্র হতে পারেন, কিংবা জাতির পিতার পরিবারের সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রীয় সুযোগসুবিধা ও নিরাপত্তা পেতে পারেন; কিন্তু তিনি ‘প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে’ দায়িত্ব পালনের যথাযথ ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান নন। তার শ্রদ্ধা নিবেদনের সময়ে মন্ত্রিসভার সদস্য, জাতীয় সংসদের সদস্য এবং আওয়ামী লীগের অনেক শীর্ষ নেতা উপস্থিত থাকতে পারেন, তবে এটা কোনোভাবেই রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি নয়। এখানে যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে এটা সরকারকে বিব্রত করছে নিশ্চিত। বিষয়টিকে তাই এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিলে বিভ্রান্তির অবসান হবে বলে আমরা মনে করি।

কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর