হিরোর প্রতিবাদী অভিযোগের স্মার্ট প্রতিকার কি?

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-08-30 13:31:58

উপনির্বাচনে হেরে গিয়ে হিরো আলম ফলাফল জালিয়াতির ব্যাপারে জোড়ালো প্রতিবাদ করেছেন। ভোট প্রদানকারীরা তাঁর পক্ষে এ ব্যাপারে সোচ্চার হয়ে সমর্থন ও সহযোগিতা দিচ্ছেন। গত ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনে বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনের উপনির্বাচনে একতারা প্রতীকের আলোচিত স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলম নির্বাচনের ফল পাল্টানোর অভিযোগ করেছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এই অভিযোগ খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশ দিয়েছেন। গত ২ ফ্রেরুয়ারি ২০২৩ সিইসি টেলিফোনে বগুড়া জেলা সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা এবং সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাকে এ নির্দেশ দেন। সেই দিনেই গণমাধ্যমকে একথা জানানো হয়।

এই আসনে উপনির্বাচনে ১০ কেন্দ্রে ফলাফল পাল্টানোর অভিযোগ তুলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলম গণমাধ্যমে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা নজরে আসার পর বেশ হৈ-চৈ পড়ে গিয়েছিল। এই আসনের উপনির্বাচনে মহাজোটের প্রার্থীর কাছে মাত্র ৮৩৪ ভোটের ব্যবধানে হেরে গিয়েছেন। কাহালু ও নন্দীগ্রাম উপজেলার মোট ১১২টি কেন্দ্রে মোট বৈধ ভোট পড়েছে ৭৮ হাজার ৫২৪টি। এর মধ্যে ২০ হাজার ৪০৫ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে জয়ী হয়েছেন মশাল প্রতীকধারী। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী একতারা প্রতীকধারী পেয়েছেন ১৯ হাজার ৫৭১ ভোট, তিনি এই ফলাফলের প্রতিবাদকারী হিরো আলম। তিনি সে রাতে নিজ বাড়িতে সংবাদ সম্মেলন করে ভোটের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘ভোট চুরি হয়নি, ফলাফল ছিনতাই হয়েছে।’ এজন্য ন্যায়বিচার পেতে তিনি উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথাও বলেন।

তিনি কষ্টের সুরে করেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে অনেক কষ্টে নিজেকে গড়ে তুলেছি। আমি একমাত্র প্রার্থী ৪-৫ জন কর্মী, একটি পিকআপ, দুটি মাইক নিয়ে দুটি আসনের মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়েছি। তাদের নানাভাবে সম্বোধন করেছি। ফলে জনগণ আমাকে ভালোবেসে ভোট দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের ভোটার হলেও অনেক বলেছেন, তারা ‘একতারা’ প্রতীকে ভোট দিয়েছেন। সবাই বলেছেন, আপনি পাশ করেছেন। ভোটাররাও ভোট দিয়েছেন, তাহলে ওই সব ভোট কোথায় গেলো? আওয়ামী লীগের লোকজনও তানসেনকে (বিজয়ী) ভোট দেয়নি। অথচ তাকেই বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে।’ .. “সারা বাংলাদেশ তাকিয়ে ছিল... আমার বিজয় ছিনতাই হয়েছে। উচ্চ আদালতে রিট করবো।”

জনাব হিরো আলম আরো বলেন, “নির্বাচনের পরিবেশ ভালো ছিল। তবে নন্দীগ্রামের ফলাফল ঘোষণা করার সময় তাঁর সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। ৪৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ৩৯টির ফলাফল ঘোষণা করা হয়। পরে বাকী ১০ কেন্দ্রের ফলাফল আলাদা ঘোষণা না করে মোট ফলাফল ঘোষণা করেছে। তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, কেন ওই ১০ কেন্দ্রের ফলাফল একসঙ্গে ঘোষণা করা হলো? এখানেই কারচুপি করা হয়েছে। সব বুথে এজেন্ট থাকলেও প্রিসাইডিং অফিসার তাদের ফলাফলের কপি দেয়নি।”

হিরো আলম আরো বলেন, “আমি অশিক্ষিত, আমি এমপি নির্বাচিত হলে আমাকে স্যার ডাকতে হবে। দেশের সম্মান যেত; তাই ওই সব সাহেবরা আমার ফলাফল পাল্টে দিয়েছেন। নির্বাচিত হলে ওই সাহেবদের দেখিয়ে দিতাম আমিও পারি।”

নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে আমাদের দেশে হেরে যাওয়া প্রার্থীরা নানা ভাবে নিজেদের মনের কষ্টকে কাটানোর জন্য নানা বক্তব্য দিয়ে থাকেন বলে একজন নির্বাচন কমিশনার গণমাধ্যমে আলাদা সময়ে বক্তব্য প্রদান করেছেন। এটা আমরাও জানি। কিন্তু অবস্থাভেদে নির্বাচনী এলাকার ভোটারগণও সেকথা অনুধাবন করে থাকেন। ভোটের পরিস্থিতি ভাল হলে সাধারণত: ঘটনার বাস্তবতায় এসব নিয়ে পরবর্তীতে তেমন কোন প্রতিবাদ দেখা যায় না। কিন্তু হিরো আলমের এই আসনের ভোটারগণ বলেছেন উল্টো কথা। তারা বলেছেন আমরা ভোট দিয়েছি যাকে তিনি নির্বাচিত হতে পারেননি। এমন আশ্বাসে তাদের নিজেদের পছন্দের প্রার্থী হতাশ। তাই সেই বিজিত প্রার্থী আদালতে যাবেন এর সুরাহা খুঁজতে।

জনাব হিরো আলমের করা এই অভিযোগ শুনতে শুধু খারাপই নয়- খুব গুরুত্বপূর্ণ ও নেতিবাচক অর্থ বহন করে। এটা সম্পূর্ণভাবে সংশ্লিষ্ট রিটানিং কর্মকতা ও দায়িত্বরত অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীগণের বিরুদ্ধে যায়, যারা সেদিন ভোট পরিচালনা করেছিলেন ও ফলাফল তৈরী ও প্রকাশ করেছিলেন। এছাড়া বড় রাজনৈতিক নেতারা হিরো আলমের এই অভিযোগ শোনার পরও তাকে সহায়তা করার জন্য এগিয়ে না এসে অনেকে তাচ্ছিল্য করেছেন যেগুলো অনেকটা অগণতান্ত্রিক আচরণ। এজন্য সিপিডি সেসব নেতাদের কঠিণ সমালোচনা করতে ছাড়েনি। অপরদিকে সুশীল সমাজের অনেকেই জনাব হিরো আলমকে প্রান্তিকজনের প্রতিনিধি ও ‘আইকন’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন।

জাতীয় সংসদে একই সময়ে ভিন্ন আরেকটি গুরুতর অভিযোগের কথা শোনা গেছে একজন আইন প্রণেতার বক্তব্য থেকে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একজন সংসদ সদস্য বলেছেন, “জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা অনেক এলাকায় রাজত্ব চালাচ্ছেন। এসব সরকারি কর্মকর্তাদের ভাবটা এমন যেন তাদের কথায় যুদ্ধ করে দেশটা স্বাধীন হয়েছে এবং জনপ্রতিনিধিরা অবাঞ্চিত ব্যক্তি। আমরা ইউএনও ও সরকারি কর্মকর্তাদের দয়ায় চলছি। বর্তমানে আমাদের এলাকায় যে সরকারি কর্মকর্তা আছেন ইউএনও, ডিসি, তারাই মনে হয় দেশটার মালিক। তারা যা করে সেটাই চলে।”উক্ত সাংসদ আরও বলেন, “আমরা কিছু চাইলে, কোন কাজ করতে বললে, কোন লোক পাঠালে আমাদের কথা শোনা হয় না। শুধু আমি না, এই সংসদে অনেকই আছেন যাদের এলাকায় সরকারি কর্মকর্তারা রাজত্ব চালাচ্ছেন। আমরা নামমাত্র নির্বাচিত হয়েছি। বাস্তবে প্রকৃত ক্ষমতার মালিক তারাই।”

এসব অভিযোগ হয়তো সংশ্লিষ্ট জনেরা মামুলী হিসেবে মনে করে মোটেও আমলে নিতে চাইবেন না। কেউ হয়তো হেসে উড়িয়ে দেবেন। নয়তো এর পাল্টা প্রতিবাদে নানা ডকুমেন্ট যোগাড় করে পার পেতে চেষ্টা করবেন। হয়তোবা এজন্য তারা কর্তৃপক্ষের বিশেষ আনুকূল্য পেয়ে পার পেয়ে যাবেন। সহজে পার পেয়ে যেতে পারেন এই সম্ভাবনার জন্য তারা হয়তো এরুপ নাজুক পরিস্থিতি হোক তা নিয়ে আগে মোটেও চিন্তা করেননি।

তবে একটি দেশের প্রধান বিরোধীদলের অংশগ্রহণ ছাড়া এসব উপ-নির্বাচনে কোন সাধারণ স্বতন্ত্র বিজিত প্রার্থী এমন কড়া প্রতিবাদ করতে পারে সেটাই এই মুহূর্তে মূখ্য বিষয় হিসেবে দেখা দিয়েছে। গতিশীল ও অবাধ অন্তর্জাল তথ্যপ্রাবাহ সঞ্চালনের এই যুগে গণমাধ্যমের কল্যানে কোন কিছুই মানুষের অজানা নয়। জনগণের সাথে সামান্য চালাকি আজকাল অতিদ্রুত অনুভব করা যায়, বোঝা যায়। জনাব হিরো আলমের অভিযোগের ভিত্তি ততটা নড়বড়ে নয় বলে মনে হয়। কারণ, একজন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে তিনি যে আশঙ্কার কথা প্রকাশ করেছেন তা আমলে নেবার গ্রহণযোগ্য যুক্তি রয়েছে।

সেটা হলো আমাদের দেশে ‘হোয়াইট কলার ক্রাইমের’ব্যাপক উপস্থিতি ও তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করার সরকারী -বেসরকারী ভুর ভুরি নজির। যা প্রায় প্রতিদিন কোন না কোন পত্রিকার শিরোনাম হয়ে থাকে। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় ক্ষুদ্র সংগঠনের সদস্যরা এই ঘটনার সংবাদ করার জন্য স্থানীয় দুজন সাংবাদিককে নাজেহাল করেছেন বলেও সংবাদ হয়েছে।

অর্থাৎ, হিরো আলমের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার বিষয়টিকে সবাই একটি ছেলেখেলা হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যে জেতার জন্য অতি কাছাকাছি চলে আসবেন সেটা তাদের ধারণাতেও ছিল না। আর এখানেই ঘটেছে যত বিপত্তি। এই বিপত্তি ঠেকাতে সর্বশেষ দশটি কেন্দ্রের ফলাফল আটকে রেখে সেগুলো পরে প্রকাশ করা হয়েছিল এবং সেই ফলাফলের কপি হিরো আলমের এজেন্টদের নিকট আগে দেয়া হয়নি বলে তিনি সংবাদ সম্মেলণ করে এর প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।

অন্যায়ভাবে আনুকূল্য পাবার জন্য দেশের রাজনীতি ও প্রশাসনে তোয়াজ-তোষণের মচ্ছবের কথা বেশ আগেই চালু হয়েছিল। কিন্তু সেই মচ্ছব এখন অতি নোংরাভাবে প্রকাশিত হবার ক্ষেত্র তৈরী করেছে। ‘হোয়াইট কলার হিরোইজমের’ নিকট জনাব হিরো আলমের সিনেমায় হিরোগিরি তেমন কোন বিষয় মনে না হলেও সংসদে গেলে তাকে স্যার বলে সম্বোধন করলে তাদের মান-ইজ্জত ধূলোয় মিশে যেতে পারে একথা তিনি সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেছেন অকপটে। এখানেই আসল গণতন্ত্রের সাথে দুষ্ট গণতন্ত্রের আমলাতান্ত্রিক ভাবধারার নেতিবাচক চরিত্রটি পরিস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। সেরকম একটি সমাজে আমরা বাস করছি। আগেকার দিনে সমাজে অপরাধ করতো কিছু সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি। এখন পুঁজি ও পদ দখলের লোভে সব সেক্টরে অগণিত কেতাদুরস্ত অপরাধী চক্র সক্রিয় হয়েছে। যারা অন্যের পাকা ধানে মই দিয়ে ভাগ-বাটোয়ারা পাবার আশায় সবসময় ওঁৎ পেতে থাকছে।

আর এজন্যই একজন আইন প্রণেতা অত্যন্ত ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়ে মহান জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপর বক্তব্য দেবার সময় প্রচলিত দুষ্ট গণতন্ত্রের আমলাতান্ত্রিক ভাবধারার দুষ্ট চরিত্রগুলা সম্পর্কে ক্ষেদোক্তি করতে মোটেও কুন্ঠিত হননি। এই বাস্তব সময়ে তার মূল্যবান বক্তব্য হতাশ জাতিকে আশার আলো দেখাতে পারে বলে মনে করা যায়।

এই সৎসাহস সব সাংসদগণের হোক, সব ভোটপ্রার্থীদের হোক, বঞ্চিত, নির্যাতিত, নিপিড়ীত মানুষের কন্ঠে ধ্বণিত হোক। মূল কথা হলো- শুধু বক্তব্য ও প্রতিবাদী অভিযোগের বেড়ায় বন্দী না থেকে এসব অভিযোগের যেন অতিদ্রুত যথার্থ আইনী সমাধান লাভ করা সম্ভব হয় সেজন্য আদালত-ইসি-দেশের সর্বচ্চো কর্ণধার সবার ঐকান্তিক সহযোগিতা দরকার। আমরা শুধু উপ-নির্বাচন নিয়ে নয়, ছোট-বড় গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ে স্মার্ট তস্করদের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে আর কোন ব্যাপারেই এ ধরণের প্রতিবাদী অভিযোগ শুনতে চাই না।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর