গ্রামীণ চট্টগ্রামে শীতের সংস্কৃতি: ঐতিহ্য ও রূপান্তর

, যুক্তিতর্ক

মোহাম্মদ আলম চৌধুরী | 2023-09-01 19:56:25

বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। ঋতুবৈচিত্র্যের কারণে গ্রামীণ সংস্কৃতিতেও পরিবর্তন দেখা যায়। এ পরিবর্তন শুধু পোশাক-পরিচ্ছদে নয় খাবার, খেলাধূলা আর উৎসবেও থাকে। তাই প্রত্যেক ঋতুতেই প্রকৃতির খেয়ালের প্রতি খেয়াল রেখে প্রস্তুতি নিতে হয় ঋতু বরণের, যা গড়ে উঠেছে চট্টগ্রামের জনসমাজের চিরায়ত ঐতিহ্যে পরম্পরায় এবং সমাজ প্রগতির রূপান্তরের ধারাবাহিকতায়।

পৌষ আর মাঘ মাস নিয়েই শীতকাল। কিন্তু আমার নানী বলতেন ‘শীতের জন্মের মাস হচ্ছে ভাদ্র মাস’। ভাদ্র মাসের শেষের দিকেই শীত অনুভূত হতে থাকে। বাঙালির সংস্কৃতিতে শীত একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। শীতকে কেন্দ্র করে পুরো জাতি মেতে উঠে নানা রকম উৎসবে। শীতের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথেই শুরু হয় পিঠা উৎসব। হরেক রকমের পিঠা দিয়ে নিজেদের চাহিদা মেটানোর পর অতিথি আপ্যায়নের চল রয়েছে। আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত করে পিঠা খাওয়ানো হয় আবার ক্ষেত্রবিশেষে আত্মীয়ের বাড়িতেও পাঠানো হয়।
কয়েক দশক ধরে দেখা যাচ্ছে আনুষ্ঠানিকভাবে শীতকালে পিঠা মেলার আয়োজনও হচ্ছে। রসনাবিলাসী হিসেবে বাঙালির তো সুনামই রয়েছে। বিচিত্র রকমের পিঠা মনে যেমন আনন্দের সূচনা করে ঠিক তেমনি রসনার পূর্ণতাও দেয়। শুধু তাই নয়, পিঠা এখন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ারও একটি উপকরণে পরিণত হয়েছে। তাই বাণিজ্যিকভাবে এখন পিঠা বানানো হয়। হাতের সাহায্যে যেমন পিঠা বানানো হয় তেমনি মেশিনের মাধ্যমেও এখন পিঠা বানানো হচ্ছে। বিভিন্ন রঙ আর নকশায় খচিত পিঠা দৃষ্টিনন্দন আর রুচির পরিচায়ক, যা বাঙালির খাদ্য-সংস্কৃতির নান্দনিক উপমা।

শীতের সকালে গাঁছি কাঁধে করে খেঁজুরের রস বিক্রি করে। সামর্থ্যানুযায়ী যে যতটুকু পারে সংগ্রহ করে রসনা তৃপ্ত করে। শুধু তাই নয় আঁখের গুড় দিয়েও শীতকালে বিভিন্ন রকমের পিঠা বানানো হয়। খেঁজুরের রস দিয়ে রাফ বানানো হয় আর সেই রাফে ভাপা পিঠা ও চিতল পিঠা চুবিয়ে খেতে দারুণ লাগে।

শীতকালে চট্টগ্রামের গ্রামীণ জনপদের সংস্কৃতি বড়ই বৈচিত্র্যময়। বাচ্চারা আমপারা বুকে জড়িয়ে মক্তবে ছুটে আর রাখাল গরু-ছাগলের পাল নিয়ে মাঠে যায়। কাঠুরিয়া কাঠ কাটতে যায় বনে। বিভিন্ন ধাচের পেশাজীবিরা পেশানুযায়ী কাজে বেরিয়ে পড়ে। সন্ধ্যার আগে-ভাগেই বাড়ি ফেরার চেষ্টা থাকে শীতের কামড় থেকে নিজেকে রক্ষার্থে। পাহাড় ও সমুদ্রের রাখিবন্ধনে চটগ্রামে দৃশ্যমান হয় বহুবিচিত্র এক সাংস্কৃতিক প্রভা, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অনন্য এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাংস্কৃতিক মিথষ্ক্রিয়ার প্রোজ্জ্বল।

কুয়াশামাখা ভোরেই চিড়া আর মুড়ির মোয়া কাঁধে বেপারি পাড়ায় পাড়ায় ডাক হাঁকে। গুড়ের জিলাপী মাটির হাঁড়িতে করে গ্রামের আনাচে-কানাচে ছুটে বেপারি। কনকনে শীতে তাজা মচমচে মোয়া আর গরম জিলাপীতে রসনা তৃপ্ত হয়।

টাকা অথবা ধান-চালের বিনিময়ে নগদ কিংবা বাকিতে বিকিকিনি হয়। বয়স্করা কাঁথা-কম্বল, শাল জড়িয়ে আর জাম্পার ও সোয়েটার গায়ে কম বয়স্করা রাস্তার দিকে খেয়াল রাখে কখন বেপারি আসে।

শীতকালীন পিঠার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ফুলপিঠা, পাটিসাপটা, চিতলপিঠা, পাকনপিঠা, গুরাপিঠা, ভাপাপিঠা (ধুঁইপিঠা) বেশ জনপ্রিয়। দিন পরিবর্তনের পালায় এখন আরও বহু রকমের পিঠা বানানো হয়। এখন অবশ্য নানামাত্রিক ব্যস্ততার কারণে আগের সেই উৎসবমুখরতা নেই গ্রামীণ জীবনে।

গ্রামীণ জনপদে শীতের সকালে আগুন পোহানোর সংস্কৃতি বেশ পুরনো। উঠানের এককোণে লতাপাতা আর লাকড়ি দিয়ে আগুনের উত্তাপ নিতে সবাই গোল হয়ে বসে পড়ে। আগুন পোহানোর কালে নানা রকমের গল্প চলে আর লাল টুকটুকে কয়লায় ভাপাপিঠা পুঁড়ে খাওয়ার ধুম চলে। সত্যি বলতে কি এ সংস্কৃতি এখন অনেকাংশে সচরাচর গোচরীভূত হয় না। নগরায়নের আছরে গ্রামীণ সংস্কৃতি হুমকির সম্মুখীন আর বিদায় নিয়েছে ইতোমধ্যে অনেক কিছু। পালাবদলের প্রহরে গ্রামীণ সংস্কৃতিও নানা রূপান্তরের সম্মুখীন।

ছোটবেলায় দেখেছি পাশ্ববর্তী কুমোরপাড়া থেকে মাটির তৈরি নানা রকমের তৈজসপত্র কাঁধে করে কুমোর ফেরি করতো প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনপদে। নানা রঙের নকশা করা মাটির ব্যাংক আর ছোট আকারের হাড়ি যেগুলোকে আমরা কুয়াশা বলতাম তা কিনে খুশিতে আত্মহারা হতাম। মাটির ব্যাংকে পয়সা জমানোর রীতিমতো প্রতিযোগিতা ছিল। এখন কুমোর পাড়া আছে কিন্তু কুমোরের পেশা নেই। তাঁরা পূর্ব-পুরুষের পেশা ছেড়ে বিভিন্ন রকমের কর্মে যোগ দিয়েছে।

স্কুল ও মক্তব বন্ধের দিন শীতের সকালে গ্রামের ছেলেমেয়েরা বিলে সদ্য ধানকাটা সারা হওয়ার পর ইদুরের গর্তে ধান কুড়োতে যেত। আইলের ফাঁকে হাত ঢুকিয়ে কিংবা কোদাল দিয়ে ইদুরের গর্ত খুঁড়ে ধান সংগ্রহ করতো আর সেই ধান দিয়ে নিজের পছন্দ মতো কিছু কেনাকাটা করতো কিংবা মোয়া ও জিলাপী খেত। এখনও প্রত্যন্ত গ্রামে এ সংস্কৃতি রয়েছে।

শীতকালে গ্রামে বিয়ের ধুমধামও বেশি হয়। আগে গ্রামের বাড়ির উঠানে বড় তাঁবু দিয়ে পাটি ও ছফ (বিশেষ ধরনের পাটি) বিছিয়ে আপ্যায়ন করা হতো এখন যেটা অতি নগন্য পরিমাণে হয় আর এখন সেটা কমিউনিটি ক্লাবে সম্পন্ন হয়।

মাঘ মাসে শীতের বেশ তীব্রতার কারণে মাঘের শীত নিয়ে বচনও রয়েছে যা আমি আমার নানীর মুখ শুনেছিলাম আর আঞ্চলিক প্রবচনে তা হচ্ছে ‘মাঘের শীতে বাঘ গুজুরে (কাঁদে)’। তাই মাঘ মাসের শীতে থাকে কামড়যন্ত্রনা। মাঘ মাসে পুকুরের পানিও কমতে থাকে আর এ সময় পুকুরের মাছ দিয়ে নানা পদের রেসিপি তৈরি করা হয়। শীতকালীন সবজি দিয়েও নানা প্রকার ভর্তা বানানো হয়।

শীতের সন্ধ্যায় আমরা পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে শিয়ালের ডাক শুনতাম। শিয়ালের হুক্কাহুয়া ডাকের সাথে সাথে আমাদের কুকুর টাইগার আর রাজুইল্যাও ঘেউ ঘেউ ডাকে কানফাটা আওয়াজ তুলতো। দুই বিরোধী শিবিরের চিৎকার চেচাঁমেচিতে ছাগল আর মুরগীর ঘরে খিল দিতো আমাদের রাখাল মন্তাজ মিয়া। হালে চারপাশের অসভ্য মানুষের কুৎসিত চিৎকারের কাছে হার মেনেছে পশুদের প্রাকৃতিক কোলাহল!

জলবায়ু পরিবর্তনের এবং সামাজিক বিন্যাসের অধঃপতনের কারণে শীতের সেই আমেজ, অনুষঙ্গ ও তাৎপর্য হারিয়ে যাচ্ছে বহুলাংশে। ইতোমধ্যে ঋতুচক্রে ব্যাপক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমরা যারা প্রত্যন্ত গ্রামীণ সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠেছি তাদের কাছে শীতের যে অমোঘ স্মৃতি তা ভবিষ্যতে 'রূপকথার গল্পে' রূপ নেবে। শীতের রাতে উঠোনে ব্যাডমিন্টন খেলা, খড়ের গাদায় লাফালাফি, প্রতিবেশির বাড়িতে ওয়াজ মাহফিলে যাওয়া, কিচ্ছা-কাহিনী শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যাওয়া, মুয়াজ্জিনের আজানের পর আস-সালাতু খায়রুম মিনান নাউম বলে নামাজের দিকে আহ্বান জানিয়ে মসজিদে যেতাম।

আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতি এখন পাল্টে গেছে। বৈশ্বিক প্রভাবে গ্রাম এখন আর শাশ্বত-গ্রাম নেই। শীতের রাতে এখন আগের মতো প্রাকৃতিক কোলাহলও নেই। শীত মোকাবেলার প্রস্তুতি হিসেবে শীতের আগমনের আগে-ভাগেই কাঁথা সেলাইয়ের ধূম পড়ে যেত। এখন এসব আর চোখে পড়ে না।

ঘন গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ গ্রাম এখন বিরান ভূমি। বন উজাড় করে ইটের ভাটায় লাকড়ি জ্বালানোর কারণে বাড়ির ফলদবৃক্ষও রক্ষা পাচ্ছে না। গ্রামীণ খেলাধূলায়ও ব্যাঘাত হচ্ছে মাঠ সঙ্কট ও রাজনৈতিক কোন্দলের কারণে। শীতকালে রোদের তেজ কম থাকার কারণে দুপুরের পরেই বিলে ডাংগুলি, ফুটবল হা ডু ডু আর ভলিবল খেলার আয়োজন হতো। রাস্তার সরুপথে চলতো মার্বেল খেলা। এসব ক্রমশ চলে যাচ্ছে স্মৃতির অতল গর্ভে।

শীতকাল চট্টগ্রামবাসীর, বিশেষত লোকায়ত গ্রামীণ সমাজের কাছে শুধু একটি ঋতুর নাম নয়- সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ আর ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা, যা নানা পরিবর্তন ও রূপান্তরের আঘাতে ক্রমেই অপসৃত।

লেখক: প্রফেসর, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর