ঔপনিবেশিক বঙ্গদেশে দুর্ভিক্ষের স্মৃতি ও শিক্ষা

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-08-31 10:20:28

 

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন অন্তর্হিত হওয়ার ৭৫ বছরের পাশাপাশি ঔপনিবেশিক দুর্ভিক্ষের ৮০ বছর বা আট দশকের দুঃসহ স্মৃতি পুরো দক্ষিণ এশিয়াকে গ্রাস করেছে। ঔপনিবেশিক কুশাসনের অনেক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার মতো খাদ্যাভাব বা দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। বিশেষ করে, বহু মূল্যায়নের মাধ্যমে একটি প্রশ্নের উত্তর জানা গেছে যে, দুর্ভিক্ষ বা খাদ্যাভাব শুধু প্রকৃতিক কারণেই হয় না। তা বহুলাংশে এক শ্রেণির মানুষের সৃষ্টি, যার মধ্যে রয়েছে রাজনীতিবিদগণ, ব্যবসায়ীমহল, আমলাচক্র ও যুদ্ধবাজ ব্যক্তি ও গোষ্ঠী।

বর্তমান বিশ্বের দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশ ও অঞ্চলের দিকে তাকালে এই সত্যই প্রতিভাত হয় যে, প্রাকৃতিক কারণ ছাড়াও খাদ্যাভাবের পেছনে কার্যকর কারণের মধ্যে রয়েছে যুদ্ধ ও সংঘাত, দুর্নীতি ও কুশাসন, প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা, আর্থিক নীতি, বিপণন ও পরিবহণের অব্যবস্থা। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলো যার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।

ঔপনিবেশিক দুর্ভিক্ষের পেছনের কাজ করেছিল ব্রিটিশদের ভ্রষ্ট নীতি ও দুঃশাসন। আজ থেকে ঠিক ৮০ বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনে ১৯৪৩ সালে বাংলার দুর্ভিক্ষে প্রাণ গিয়েছিল অন্তত ত্রিশ লক্ষ বঙ্গবাসীর। ৮০ বছরে পা দেওয়া বাংলার দুর্ভিক্ষ তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের কর্মকালের এক কালো অধ্যায় বলে মনে করেন ব্রিটেনের এখনকার প্রজন্ম এবং গবেষকগণ।

ব্রিটেনে এক সময় চার্চিলই নায়ক ছিলেন। বিশেষত, এখন যাঁদের বয়স ষাটের উপরে, তাঁদের অনেকেই মনে করেন যে, ঔপনিবেশিক রাজত্বকালে চার্চিল ব্রিটেনের অন্যতম সফল শাসক তথা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু ব্রিটেনের বর্তমান সেকেন্ডারি স্কুলগুলির ছাত্রছাত্রীদের বাংলার দুর্ভিক্ষের ইতিহাস পড়াচ্ছেন তাদের শিক্ষক-শিক্ষিকারা। যেখানে বলা হচ্ছে, বাংলার শস্যভান্ডারে টান পড়বে জেনেও জোর করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়াইরত ব্রিটিশ সেনাদের জন্য বস্তা বস্তা চাল পাঠিয়েছিলেন চার্চিল।

গবেষণায় আরও জানা যাচ্ছে, সরকারি ও বেসরকারিভাবে মাত্রাতিরিক্ত খাদ্য গুদামজাত করা হয়। ব্যক্তি পর্যায়ে খাদ্যের মজুদদারিও চলে অবাধে। ফলে অতিদ্রুত বাজারে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। সৃষ্টি হয় কৃত্রিম সঙ্কট। খাবার না পেয়ে অকাতরে মারা যায় মানুষ।

ঔপনিবেশিক বঙ্গদেশে দুর্ভিক্ষের স্মৃতির চেয়ে  এর শিক্ষা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এর থেকে শিক্ষা নিয়ে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা জরুরি। যেজন্য, মজুদদারি ও সিন্ডিকেট ঠেকানো বিশেষ কর্তব্য। বাজার ব্যবস্থা ও খাদ্যনীতিতেও নজরদারি জরুরি।

 

প্রসঙ্গত মনে রাখা দরকার যে, দুর্ভিক্ষ খাদ্যের অভাবে হয় না, হয় বণ্টনের অভাবে। কথাটি বলেছেন নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। অতীতের অভিজ্ঞতা ও চলমান বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালে জাতিসংঘসহ দেশে-বিদেশের অর্থনীতিবিদরা খাদ্য বিপর্যয় তথা দুর্ভিক্ষ আশঙ্কার পটভূমিতে এসব কথা নতুন করে আলোচনার দাবি রাখে। কেননা, দুর্ভিক্ষ হচ্ছে খাদ্য সরবরাহে ঘাটতির কারণে কোনও এলাকার মানুষের অনাহারজনিত চরম অবস্থা। সাধারণত কোনো এলাকায় ফসলহানি ঘটলে এবং সেখানে প্রয়োজন মেটানোর মতো খাদ্য সরবরাহ না থাকলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এছাড়াও খরা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি ইত্যাদি প্রাকৃতিক কারণে, গবাদিপশুর রোগ বা ফসলের রোগ, পশু-কীটপতঙ্গ বা ইঁদুররাও অনেক সময় দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী হতে পারে। প্রাকৃতিক এসব কারণের বাইরেও ত্রুটিপূর্ণ নীতি, পরিকল্পনা, পরিবহন ও খারাপ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে চালু বাণিজ্যপ্রবাহে বাধা আসলে কৃত্রিম খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে।

বর্তমান করোনাকালেও এমন পরিস্থিতির উদ্ভবের শঙ্কা বিদ্যমান। যেমনভাবে অতীতে মহাযুদ্ধ ও ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণে খাদ্য সঙ্কট ও চরম দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। এজন্য করোনাকালের পটভূমিতে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) বলেছে, “করোনা মহামারির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট বিশ্বজুড়ে তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা দেখা দিতে পারে। প্রায় সাড়ে ২৬ কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষপীড়িত হতে পারে, যা হবে বর্তমানের দ্বিগুণ। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি যে মানুষ না খেতে পেয়ে আক্ষরিক অর্থে মারা যাবে।

ফলে বিভিন্ন দেশের সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে হবে আর অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে। খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ করার ক্ষেত্রে অধিকতর মনোযোগের মাধ্যমে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

এদিকে, যুক্তরাজ্যভিত্তিক অর্থনীতিবিষয়ক নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এফএম গ্লোবাল থেকে ‘গ্লোবাল রেসেলিয়ানস ইনডেক্স-২০১৯’ বা বৈশ্বিক সহিষ্ণুতা সূচক-২০১৯ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। করোনাভাইরাসের কারণে উদ্ভূত সঙ্কট কোন দেশ, কতো ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারবে, তা ওই সূচকে বোঝা যাবে বলে ধরা হচ্ছে। সেখানে দেখা গেছে, ১৩০টি দেশের মধ্যে ওই সূচক অনুযায়ী শীর্ষ তিনটি দেশ হচ্ছে নরওয়ে, ডেনমার্ক ও সুইজারল্যান্ড। আর ওই তালিকায় সবার নিচের দিকে থাকা তিনটি দেশ হচ্ছে হাইতি, ভেনেজুয়েলা ও ইথিওপিয়া। আর বাংলাদেশের অবস্থান এ ক্ষেত্রে ১৩০টি দেশের মধ্যে ১০৬ নম্বরে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মধ্যে ভারত ও শ্রীলঙ্কার অবস্থান যথাক্রমে ৫৮ ও ৮১। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেই বাংলাদেশের রেজেলিয়ান্স বা সহিষ্ণুতার ক্ষমতা কম।

ওই সূচক তৈরি করা হয়েছে মূলত দেশগুলোর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, করপোরেট সুশাসন ও ব্যবসার পরিবেশকে আমলে নিয়ে। এই বিষয়গুলো যে দেশে ভালোমতো চলছে, সেই দেশের পক্ষে করোনাভাইরাসের মতো স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক খাতের চাপ সহ্য করার সক্ষমতা তত বেশি থাকবে। অতএব, এসব ক্ষেত্রে সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুত হওয়া দরকার।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম।

এ সম্পর্কিত আরও খবর