সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনপ্রিয় সংস্কৃতির প্রসার ও প্রভাব

, যুক্তিতর্ক

মো. বজলুর রশিদ | 2023-09-01 16:29:25

জনপ্রিয় সংস্কৃতি (Popular Culture বা সংক্ষেপে Pop culture) সাধারণভাবে একটি নির্দিষ্ট সমাজের ঐতিহ্য এবং বস্তুগত সংস্কৃতিকে বোঝায়। আধুনিক পশ্চিমা জগতে, জনপ্রিয় সংস্কৃতি বলতে সাংস্কৃতিক পণ্য যেমন সঙ্গীত, শিল্প, সাহিত্য, ফ্যাশন, নৃত্য, চলচ্চিত্র, সাইবার কালচার, টেলিভিশন এবং রেডিওকে বোঝায় যা সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা গ্রহণ করে। জনপ্রিয় সংস্কৃতি হল সেই ধরনের মিডিয়া যেগুলির ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা এবং আবেদন রয়েছে।

জনপ্রিয় সংস্কৃতি শব্দটি উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আর্বিভূত হয়েছিল এবং এটি রাষ্ট্র বা শাসক শ্রেণির "অফিসিয়াল সংস্কৃতি" এর বিপরীতে জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে নির্দেশ করে। বিস্তৃত ব্যবহারে, গুণগত পরিভাষায় সংজ্ঞায়িত করলে- জনপ্রিয় সংস্কৃতিকে প্রায়শই শৈল্পিক অভিব্যক্তির উপরিভাগ বা কম মানসম্পন্ন হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

পণ্ডিতেরা শিল্প বিপ্লব উদ্ভূদ মধ্যবিত্ত শ্রেণির দ্বারা জনপ্রিয় সংস্কৃতি উত্থানের উৎস খুঁজে পেয়েছেন। তাদের মতে, শিল্প বিপ্লবের ফলে যারা শ্রমিক শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এবং তাদের ঐতিহ্যগত কৃষি জীবন থেকে অনেক দূরে শহুরে পরিবেশে চলে এসেছিল- তারা তাদের পিতামাতা এবং মনিবদের থেকে আলাদা হওয়ার অংশ হিসাবে তাদের সহকর্মীদের সাথে দু:খ, কষ্ট ভাগ করে নেওয়ার জন্য তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি তৈরি করতে শুরু করে এবং তা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সমাপ্তির পর, গণমাধ্যমের উদ্ভাবনের ফলে পশ্চিমে উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিবর্তন ঘটে। একই সময়ে, বিশেষ করে পুঁজিবাদ মুনাফা তৈরির প্রয়োজনীয়তা থেকে বিপণনের ভূমিকা গ্রহণ করেছিল এবং নতুন উদ্ভাবিত সাংস্কৃতিক পণ্যগুলি বিভিন্ন শ্রেণির কাছে বাজারজাত করা হতো। জনপ্রিয় সংস্কৃতির অর্থ তখন গণসংস্কৃতি, ভোক্তা সংস্কৃতি, চিত্র সংস্কৃতি, মিডিয়া সংস্কৃতি এবং গণভোগের জন্য নির্মাতাদের দ্বারা তৈরি সংস্কৃতির সাথে মিশে যেতে শুরু করে।

ব্রিটিশ মিডিয়া বিশেষজ্ঞ John Storey তার "Cultural Theory and Popular Culture" গ্রন্থে জনপ্রিয় সংস্কৃতির ছয়টি ভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তিনি বলেন,

১. জনপ্রিয় সংস্কৃতি হল এমন সংস্কৃতি যা অনেক লোকের দ্বারা ব্যাপকভাবে পছন্দ বা ভালভাবে পছন্দ হয়: এর কোনও নেতিবাচক অর্থ নেই।

২. জনপ্রিয় সংস্কৃতি হল "উচ্চ সংস্কৃতি" কী তা চিহ্নিত করার পরে যা অবশিষ্ট থাকে: এই সংজ্ঞায়, জনপ্রিয় সংস্কৃতি কে নিকৃষ্ট হিসাবে বিবেচনা করা হয়, এবং এটি মর্যাদা এবং শ্রেণির চিহ্নিতকারী হিসাবে কাজ করে।

৩. জনপ্রিয়  সংস্কৃতিকে বাণিজ্যিক বস্তু হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে যা  নিন্ম শ্রেণির ভোক্তাদের দ্বারা ব্যাপক ভোগের জন্য উত্পাদিত হয়। এই সংজ্ঞায়, জনপ্রিয় সংস্কৃতি হল একটি হাতিয়ার যা অভিজাতদের দ্বারা জনসাধারণকে দমন বা সুবিধা নেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়।

৪. জনপ্রিয় সংস্কৃতি হল লোকসংস্কৃতি, এমন কিছু যা তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে জনগণ থেকে উদ্ভূত হয়: জনপ্রিয় সংস্কৃতি খাঁটি (মানুষ দ্বারা সৃষ্ট) বাণিজ্যিক (বাণিজ্যিক উদ্যোগ দ্বারা তৈরি)।

৫. জনপ্রিয় সংস্কৃতি  আংশিকভাবে প্রভাবশালী শ্রেণি দ্বারা আরোপিত, এবং আংশিকভাবে অধস্তন শ্রেণি দ্বারা প্রতিহত বা পরিবর্তিত হয়। প্রভাবশালীরা সংস্কৃতি তৈরি করতে পারে কিন্তু অধীনস্থরা সিদ্ধান্ত নেয় তারা কী রাখবে বা বাতিল করবে।

৬. Storey এর আলোচিত জনপ্রিয় সংস্কৃতির শেষ সংজ্ঞাটি হল যে উত্তর-আধুনিক বিশ্বে, আজকের বিশ্বে, "প্রমাণিক" বনাম "বাণিজ্যিক" এর মধ্যে পার্থক্যটি অস্পষ্ট। আজ পপ সংস্কৃতিতে, ব্যবহারকারীরা কিছু উত্পাদিত বিষয়বস্তু গ্রহণ করতে, তাদের নিজস্ব ব্যবহারের জন্য এটি পরিবর্তন করতে, বা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করতে এবং তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি তৈরি করতে স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে।

Storey এর ছয়টি সংজ্ঞা এখনও ব্যবহার করা হচ্ছে, তবে সেগুলি প্রেক্ষিতের উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়। একুশ শতকের শুরু থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিস্তারের ফলে জনপ্রিয় সংস্কৃতি এতটাই নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে যে পণ্ডিতরা এর গতি-প্রকৃতি ও প্রকরণ ঠিকভাবে বুঝে ওঠার আগেই তা পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। গণমাধ্যম বলতে এখন কেবল মুদ্রণ (সংবাদপত্র এবং বই), সম্প্রচার (টেলিভিশন এবং রেডিও), এবং সিনেমা (চলচ্চিত্র এবং তথ্যচিত্র) বোঝায়। অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং এর ধরনগুলি একটি বিশাল বৈচিত্র্যকে ধারণ করে।

 

একটি বৃহৎ মাত্রায়, জনপ্রিয় সংস্কৃতি আজ বিশেষ ব্যবহারকারীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে গণযোগাযোগ এখন অনেক এগিয়েছে এবং ভবিষ্যতে তা আরো বিস্তৃত হবে। সাধারণ মানুষ এখন বিভিন্নভাবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের সাথে অতি সহজেই যোগাযোগ করতে পারে। তাদের প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। যা ভালো বা মন্দ উভয়ই হতে পারে। আর এভাবে সমাজস্থ মানুষের মানস কাঠামোর পরিবর্তনও সাধন করে।

সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিক কার্ল মার্কসের মতে, সমাজের মৌল কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে উপরি কাঠামো। সংস্কৃতি উপরি কাঠামোর অংশ। সমাজ বিবর্তেনর ধারায় বিভিন্ন পর্বে সমাজের মৌল কাঠামো পরিবর্তিত হয়েছে। সেই সাথে পরিবর্তিত হয়েছে উপরি কাঠামো তথা সংস্কৃতিও। প্রায় প্রত্যেক পর্বেই দেখা গেছে বিশাল জনগোষ্ঠী বৈষম্য, দুঃখ, কষ্ট ও যন্ত্রণার শিকার হয়ে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি তৈরি করেছে যা সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছে। ভালো মন্দের বিচারে অনেক সংস্কৃতি টিকে গেছে আবার অধিকাংশই পরিত্যক্ত হয়েছে। 

সমালোচকদের মতে, চর্তুথ শিল্প বিপ্লব যুগেও সমাজের উপরি কাঠামোর পরিবর্তন ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। আর স্মার্ট প্রযুক্তি এক্ষেত্রে অনন্য মাত্রা যোগ করেছে। পুঁজিবাদ প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে মুনাফা তৈরি করে। আজ প্রত্যেকেরই হাতে হাতে ইন্টাররেট যুক্ত মোবাইল ফোন। পুঁজিবাদ বলছে তুমিই হতে পারো সেরা এবং তুমি নিজেই পয়সা উপার্জন করতে পারো তোমার মেধা, প্রতিভা ও শরীর দিয়ে।

আর এজন্য তোমার কারো দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন নেই। তোমার মেধার বিকাশ ঘটাও তোমার সেল ফোনের মাধ্যমে এবং ছড়িয়ে দাও জগৎময়। তুমিই হবে সেরা এবং পূরণ করো তোমার স্বপ্ন। তোমার মেধাও নেই, প্রতিভাও নেই। তাতে কী হয়েছে? তোমার তো একটা শরীর আছে। তাই দিয়ে তুমি অর্থ উর্পাজন করো। তোমার খ্যাতি শেষ। স্বপ্ন পূরণ হয়নি। কোনো সমস্যা নেই। বাস্তবে না হলেও কল্পনায় তুমি সব সুখ উপভোগ করো। এজন্য তুমি বেছে নাও কিছু “মেডিসিন” (মাদক) যা তোমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে তোমার স্বপ্নের জগতে।

এভাবেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রসার ঘটছে জনপ্রিয় সংস্কৃতির। ইউটিউব, টিকটক ভিডিও, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, স্নাপচ্যাট এমনি হরেক রকম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আজ প্রসার ঘটছে জনপ্রিয় সংস্কৃতির। জনপ্রিয় সংস্কৃতি আগেও ছিল এখন তা আরো বিস্তৃত হয়েছে। আজকের বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেমন, ফেসবুক রিলস, টিকটক ভিডিও, ওটিটি প্লাটফর্ম, ইউটিউব, ইমেজ ও ভিডিও শেয়ারিং সাইট, কম্যুনিটি ব্লগ, ভিডিও হোস্টিং সাইট ইত্যাদিতে আমরা জনপ্রিয় সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার দেখতে পাই যা সারা বিশ্বের জনসংখ্যার একটি বৃহৎ অংশ দেখে থাকে ও প্রতিক্রিয়া জানাই।

একথা ঠিক আজকের এই অতি আধুনিক ও স্মার্ট প্রযুক্তির যুগে জনপ্রিয় সংস্কৃতিকে অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে জনপ্রিয় সংস্কৃতির ভালো দিকও যেমন আছে তেমনি রয়েছে মন্দ দিকও। ভালো ও মন্দ দিকটি সমাজ ও সংস্কৃতিভেদে বেছে নেওয়ার দায়িত্ব সেই সমাজ ও সংস্কৃতির জনগোষ্ঠীর। তবে বৃহত্তর কল্যাণে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণও জরুরি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

মো. বজলুর রশিদ: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর