অল্প সময়ে অনেক ধর্মঘটের ধকলটা কার?

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-09-01 10:50:28

বহুদিন দেশে হরতাল-ধর্মঘট ছিল না। আবার শুরু হয়ে গেছে এসবের ধকল। মজার ব্যাপার হলো এবারের ধর্মঘট অভিনব। একজনের দায় আরেকজনের ঘাড়ে চাপিয়ে ঘন ঘন ধর্মঘট ডেকে দেয়া হচ্ছে নির্দ্বিধায়। পরিবহন ধর্মঘটের নামে স্থল, জল, হাঁটাপথ সবকিছুতেই বাধা দেয়া হচ্ছে হঠাৎ করেই। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে- যেদিন বিরোধী দল বা বিএনপি বিভাগীয় সমাবেশের ডাক দিচ্ছে সেই দিনকে উপলক্ষ্য করে শাসক দল সেই বিভাগে তিনদিন আগে থেকেই সব পরিবহন চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে দিচ্ছে। পরিবহন সমিতির উপর দায় চাপিয়ে শুধু সেই বিভাগের জেলা-উপজেলা, গ্রাম-গঞ্জ থেকে নয়- ভিন্ জেলা বা দেশের ভিন্ন কোন এলাকা থেকে সমাবেশমুখী যানবাহন চলাচল করতে বাধা দেয়া হচ্ছে।

যে উদ্দেশ্যে এসব ধর্মঘট ডেকে আড়ালে থেকে কৌতুক করা হচ্ছে ধর্মঘটীদের সে উদ্দেশ্য কি আসলে সফল হচ্ছে? এ নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক শুরু হয়েছে। সাধারণ জনগণ এর জন্য খুবই বিব্রত ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে চলেছে। অথচ এ ব্যাপারে সরকার বা প্রশাসনের কোন বিকার নেই।

ঘন ঘন ধর্মঘটের ফলে বিরোধী প্রতিবাদের ভাষার সাথে আরো বেশি তেজ ও জেদ লক্ষ্য করা গেছে। দেশের আটটি বিভাগের মধ্যে ছয়টিতে ইতোমধ্যে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ শেষ হয়েছে। ছয়টি সমাবেশে ধর্মঘটের কোন সুফল না থাকা সত্ত্বেও সিলেটের বিভাগীয় সমাবেশ ১৯ নভেম্বরের দুদিন আগে হবিগঞ্জসহ সব জেলা থেকে পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়েছে। পথের সকল বাঁধা বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে বিএনপি সমর্থকরা সেসব সমাবেশে বহু আগে থেকে হাজির হয়ে সমাবেশগুলোকে উচ্ছল প্রাণসঞ্চালণা দিয়েছে। কুমিল্লা বিভাগীয সম্মেলনে একই ঘটনা দেখা গেছে। এমনকি ৪ ডিসেম্বর রাজশাহী বিভাগীয সম্মেলনের দুদিন আগেই সমর্থকরা এসে হাজির। এখানে একসঙ্গে দুই-তিন হাজার মোটর সাইকেলের র‌্যালি নিয়ে নওগাঁ, চাপাই নবাবগঞ্জ ও নাটোর থেকে হুইসেল বাজিয়ে সমর্থকরা আগের দিন এসে উপস্থিত হয়েছে। আগের রাতে জড়ো হওয়া সমর্থকরা সময় কাটানোর জন্য যাতে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখতে যাতে না পারে সেজন্য বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে বাধা দেয়া হয়েছে। মোবাইল নেটওয়ার্ক ধীরগতি করে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ধর্মঘটের ফলে তারা আগেই সমাবেশস্থলে আসায় তাদের উপস্থিতি ও গণমাধ্যমে ভরপুর প্রচারণা দেখে যারা শুধু নির্দিষ্ট দিনে আসতো বা আসতে চাইতা না তারাও যে কোন প্রকারে সমাবেশে হাজির হয়েছে।

অর্থাৎ, সমাবেশের একদিনের প্রচারণা এবার তিনদিন আগে থেকেই প্রচারিত হয়ে বিরোধী শক্তিকে আরো বেশি উজ্জীবিত করে তুলেছে। অর্থাৎ, শাসক দলের ধর্মঘট ডাকার প্রয়াস একটি ছলনা হিসেবে প্রতীয়মান হয়ে যাওয়ায় সাধারণ ও ভুক্তভোগী মানুষ আরো বেশি উৎসাহী ও কৌতুহলী হয়েছে বিভাগীয় সমাবেশগুলির প্রতি। তারা বলছেন, যেমন ঠাকুর, তেমন মুগুর। পথে পথে তল্লাশি, হোটেলে অভিযান ইত্যাদির জন্য সমর্থকগণ সমাবেশস্থলের মাঠে তাঁবু গেড়ে একসঙ্গে অবস্থান করছেন। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তাইতো তারা তিন-চারদিন আগে থেকেই পুটলিতে চিড়া-মুড়ি, নাড়ু বেঁধে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মাধ্যমে সমাবেশস্থলে হাজির হয়ে পিকনিক করে গান গাইতে সুযোগ পেয়েছে। সেখানে তারা সারি সারি চুলা জ্বালিয়ে রান্নাবান্না করে খাওয়ারও সুযোগ পেয়েছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে- এটা ঘটতো না যদি শাসক দলের অহেতুক ভুল নীতি ব্যবহারের বাস্তব প্রতিচ্ছবির জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার কথা জানা থাকতো।

এভাবে বার বার জনসভাকে কেন্দ্র করে এধরণের হঠকারীতামূলক পরিবহন ধর্মঘট ডাকা শাসক দলে উন্নয়ন কাজ করার জনপ্রিয়তা যতটুকু ছিল সেটুকুও ম্লান করে দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। জনসভার বিরুদ্ধে ডাকা এসব ধর্মঘট তাদের জনভীতিকে আরো প্রামাণ্য করে তুলছে এবং এটা তাদের জন্য আরো বুমেরাং হচ্ছে বৈ কিছু নয়।

আর সরকারের ভয়ে পরিবহন সমিতিগুলো উপায়ন্তর না দেখে নিজেদেরকে বাঁচানোর জন্য ধর্মঘট ডেকে আড়ালে থেকে মজা করছে। প্রশাসনযন্ত্র তাদের চাকুরী বাঁচানোর জন্য ধর্মঘটে দায়সারা দায়িত্ব পালন করছে। সবাই এসব উদ্ভট সিদ্ধান্তের কাজকে ছলনা ও এক ধরণের প্রতারণা মনে করে মনক্ষুন্ন হয়ে যেনতেন কাজ মনে করছে। ফরিদপুর বিভাগের মহাসমাবেশকে ঘিরে গণপরিবহন ধর্মঘটের পাশাপাশি মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয়ার অভিযোগ শোনা গেছে। এতে একদিক এসব ধর্মঘট বুমেরাং হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে জনসমাগমকে আরো বেশি বেগবান করে সফল সমাবেশ করে চলেছে। বিশ্লেষকগণ মনে করেন, দেশের সব মানুষ তো আর রাজনীতি করে না। জনভোগান্তি সৃষ্টিকারী এসব ধর্মঘট না ডাকলে বিভাগীয় সমাবেশগুলো এত প্রাণ পেত না।

খুলনা সমাবেশের আগে সেখানকার বিরোধী নেতারা বলেছেন, যানবাহন বন্ধ করে কোন লাভ নেই। ‘মনে চাইলে মানুষ পায়ে হেঁটেও মক্কা যেতে পারে।’ ফরিদপুরের জনসভায় বক্তারা বলেন, পরিবহন ধর্মঘট সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের দুর্গে লক্ষ মানুষ জমায়েত হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা জানাচ্ছে। তবুও সরকার খেলার নামে অরাজনৈতিক কথাবার্তা বলে অবজ্ঞা করছে। এবার নির্বাচন নিয়ে যেনতেন খেলা খেলতে দেয়া হবে না। মানুষ গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। তাই সব বিভাগীয় সমাবেশের বহু আগেই ধর্মঘট ডাকা হলেও জনসমাগম ঠেকানো যায়নি। গত কয়েকদিন ধরে নেতাদের মধ্যে বাকযুদ্ধ ও পাল্টা বাকযুদ্ধ চলছেই। জনভোগান্তির কথা ভাবনায় নেই কারো।

দেশের বাকী জনগণতো ‘ওয়াচডগ’। তারা গণমাধ্যমে ধর্মঘটের নামে নিরীহ ভুক্তভোগী মানুষের দুর্দশা দেখে সহানুভূতি প্রকাশের ভাষাও হারিয়ে ফেলেছে। কারণ, এসব ধর্মঘট তো আর একটি-দুটি নয়। অনেক হবে। হয়তো সামনে আরো অনেক হতে থাকবে। তবে এসব পরিবহণ ধর্মঘট কি কোন জনসমাবেশ ঠেকাতে সক্ষম? নাকি শুধু জনভোগান্তি সৃষ্টির কারণ?

আরেকটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ঢাকায় একটি রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের সূবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানের মহাসমাবেশকে ঘিরে লক্ষ্যণীয় ছিল। সেটা হলো- বিআরটিসি বাসে দলীয় ব্যানার টাঙ্গিয়ে আসা। উন্মুক্ত মাঠে ফটক বানিয়ে পুলিশি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দলীয় সমাবেশ করাকে অনেক গণমাধ্যম আওয়ামী লীগের ভয় পাবার বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেছে। এছাড়া ডলারের রিজার্ভ সংকট ঠেকাতে আইএমএফ-এর ঋণ গ্রহণকে অথর্নীতিবিদগণ প্রথম কিস্তি পাবার পর কঠিন প্রেসক্রিপশণ হাতে ধরিয়ে দেবার আশঙ্কা করছেন। যার মূল মিটিং আইএমএফ এখনও করেনি এবং বিদেশী সাংবাদিকরা দেশের অর্থনীতিকে আইসিইউ-এ থাকার সংগে তুলনা করেছেন। তা-না হলে এই সময়ে আইএমএফ-এর ঋণ গ্রহণ এত প্রয়েজনীয় মনে হলো কেন?

একটি দলীয় অনুষ্ঠান বা কর্মসূচির জন্য সরকারি পরিবহন ব্যবহার করা যায় না। এমনকি সেজন্য সরকারী পরিবহন বা যানবাহন ভাড়া করারও বিধান নেই। এটা দেশবাসীর দৃষ্টিকটু লাগায় সমালোচনার উদ্রেক করেছে।

একদিকে বিরাধী দলের সমাবেশকে পন্ড করার মানসে পরিবহণ ধর্মঘট চালু থাকা এবং সরকারের নির্লিপ্ত থাকার ভূমিকা অন্যদিকে সরকারী যানবাহনে দলীয় ব্যানার লাগিয়ে ঢাকায় সমাবেশস্থলে সমর্থক নিয়ে আসাটা বড় ক্ষতিকর সিদ্ধান্ত। নিজেরটা সরকারী নিরাপত্তার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত ও অনেকটা যান্ত্রিক কিন্তু বিরোধীদেরটা হচ্ছে স্বত:স্ফুর্ত ও প্রাকৃতিক। আজকাল গণমাধ্যমের কল্যাণে এসবের কোনটাই সাধারণ মানুষের চোখ এড়ায় না। প্রবাদে আছে- ‘নিজের বেলা আটিসাঁটি, পরের বেলা চিমটি কাটি’- অহেতুক নিষ্ফল পরিবহন ধর্মঘট ডেকে এমন ভাব প্রদর্শণ করছি কেন?

আর এগুলোই কোন শাসনকালের ইতিহাসের প্রতিপাদ্য হিসেবে লেখা হয়ে থাকে। নাগরিকদের কল্যাণের জন্য গৃহীত যে কোনকিছুই একদিন মহান হয়ে ভেসে আসে। হযরত ওমর রাতের বেলা দু:খী প্রজাসাধারণের প্রকৃত অবস্থা যাচাই করতে একা একা চুপি চুপি দেখতে যেতেন। দরিদ্র মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরে এক রাতে তিনি শুধু পানির পাত্র উনুনে জ্বাল দিতে দিতে অভুক্ত সন্তানদেরকে সান্তনা দিতে দেখা এক অসহায় মায়ের সন্ধান পেয়েছিলেন। তাদের জন্য নিজেই গাধার পিঠে করে খাবার বহন করে এনে দিয়ে মানব কল্যাণে ইতিহাসের এক উজ্জল অংশ হয়ে আজও বেঁচে আছেন। আমরা গণতন্ত্রের জন্য নূর হোসেনের বুকের লেখা শ্লোগানকে বুলি করছি, নিজের অবস্থান খেয়াল না করে অপরের কথা বলা নিয়ে বার বার উপহাস করছি। কিন্তু নিজেরা ভাল হতে চেয়েও ভাল হতে পারছি কই?

ঢাকায় লক্ষ কর্মী-সমর্থকের সমাবেশের দিনেও নিজের ভিটা ও দুর্গে যখন আরো ভিন্ন লক্ষ লক্ষ প্রতিবাদী মানুষ গণতন্ত্র, ভোটাধিকার প্রয়োগ, জ্বালানি সংকট, উচ্চদ্রব্যমূল্য নিয়স্ত্রণের দাবি জানাতে জড়ো হয় তখন সেটাকেও গুরুত্ত্ব দিয়ে ভাবার বিষয়। এগুলোকে নিছক খেলার সংগে তুলনা করাটাও ঠিক নয়। ‘পুকুরে বাচ্চারা ঢিল ছুঁড়ে খেলায় মত্ত হলে অগভীর জলে বাস করা ব্যাঙদের অকালমৃত্যু ঘটতে পারে’-একথা ভুলে গেলে চলবে কি করে? এজন্য দায়িত্বরত থাকা সবাইকে আরো দায়িত্বজ্ঞানহীন মনে হয়। কারণ দ্রব্যমূল্য সন্ত্রাসের এই সময়ে নিম্ন আয়ের মানুষেরা সেই অসহায় ব্যাঙের মতো অতি অগভীর পুকুরে বাস করছে।

বার বার সরকারি ইঙ্গিতের সমর্থনে পরিবহন ধমর্ঘটের ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ঝান্ডা যখন লোভী ব্যবসায়ীরা আরো অগ্নিমূল্যের দিকে তাড়া করে নিয়ে যায় এবং ছা-পোষা, দরিদ্র মানুষকে পরিবারসহ পেটের ক্ষুধায় কাতর করে নির্ঘুম রাখতে বাধ্য করে তখন বড় বড় সমাবেশের নামে প্রতিযোগিতা করে অর্থ ব্যয় করা ও জৌলুষ দেখানোর নামে মানুষের কষ্ট বাড়ানো কি সমীচিন মনে হয়? এত অল্প সময়ে এসব অনেক বেশি ধর্মঘটের ধকলটা আসলে কার?

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর