শান্তিচুক্তির ২৫ বছর: পাহাড়ে শান্তি, সম্প্রীতি, উন্নয়নের শত্রু কারা?

, যুক্তিতর্ক

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-09-01 22:08:40

এই ছবিটি ২৫ বছর আগে ধারণ করেছিলেন চট্টগ্রামের বিশিষ্ট আলোকচিত্র সাংবাদিক, দৈনিক পূর্বকোণ-এর মনজুরুল আলম মঞ্জু। মারাত্মক অস্ত্র সজ্জিত আত্মসমর্পণ করতে আসা সামরিক ট্রেনিং প্রাপ্ত শান্তি বাহিনীর একটি অংশের ছবিটি এতো বছর পরেও প্রাসঙ্গিক। কারণ পাহাড়ে এখনও বন্ধ হয় নি অস্ত্রবাজ সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর দৌরাত্ম্য।

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির ২৫ বছর পূর্তিতে পাহাড়ে যখন পালিত হচ্ছে রজত জয়ন্তী, তখন তৎপর শান্তির প্রতিপক্ষ। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক চেষ্টায় আস্থা ও বিশ্বাসের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে শান্তি, সম্প্রীতি, উন্নয়ন গতিশীল হয়েছে। তারপরেও নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কারণে প্রশ্ন উঠেছে, পাহাড়ে শান্তি, সম্প্রীতি, উন্নয়নের শত্রু কারা? কারা রাজনৈতিকভাবে এবং সশস্ত্র সন্ত্রাসবাদী পন্থায় শান্তির অব্যাহত ধারায় বিভেদ ও অশান্তির বীজ বপন করছে?

এসব প্রশ্নের পাশাপাশি সবার মধ্যেই তৈরি হয়েছে বড় আকারের সংশয়। আর তা হলো, চুক্তির আওতায় সত্যিকার অর্থে সম্পূর্ণরূপে অস্ত্রগুলো আদৌ জমা পড়েছে কিনা? যদি হয়ে থাকে, তাহলে কেন অস্ত্রের মহড়া এখনও বন্ধ হয়নি পাহাড়ে? কেন এই সশস্ত্র সন্ত্রাস? কেন পাহাড়ে প্রতিদিন হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি অবাধে চলছে?

গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমান অস্ত্রধারীরা উপজাতি রাজনীতির ছত্রছায়ায় লালিত-পালিত। তারা নিজস্ব স্বার্থে বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসমূলক অপকর্ম করছে। এতে বাধা দিতে গিয়ে অনেক উপজতি ও বাঙালি হত্যার শিকার হচ্ছে। সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করছে সাধারণ মানুষদের। এসব কারণে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের দুই যুগ পার হলেও চলছে টানাপড়েন। আর এর ফলে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি আজো।

শান্তিচুক্তির ২৫ বছরে পাহাড়ে যুগান্তকারী অবকাঠামোগত ও মানবিক উন্নয়ন সাধিত হলেও হানাহানি আর ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে পার্বত্য অঞ্চল অশান্ত। সরকারের পক্ষ থেকে অধিকাংশ শর্ত পূরণের কথা বলা হলেও পার্বত্য আঞ্চলিক সংগঠনগুলো তাদের শর্তগুলো পূরণ হয়নি বলে অভিযোগ করে আসছে। এহেন বিরোধিতার ধারায় শক্তি পাচ্ছে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। অন্যদিকে, বাড়ছে হতাশা। পাহাড়ে বসবাসকারী বাঙালিরাও ক্ষুব্ধ। চুক্তির কিছু বিষয় বাস্তবায়ন নিয়ে তাদের মধ্যে রয়েছে প্রবল বিরোধিতা।

সবকিছু ছাপিয়ে প্রধান সমস্যা এখন সন্ত্রাস ও অস্ত্রবাজি। অভিযোগ রয়েছে যে, সশস্ত্র পার্বত্য আঞ্চলিক সংগঠনগুলো তাদের অবৈধ অস্ত্রই এখনও জমা দেয়নি বরং তাদের বহরে ধীরে ধীরে যুক্ত হয়েছে এসএমজি, এলএমজি, রাইফেল, স্নাইপার রাইফেলসহ অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। আর এই সব অস্ত্র ব্যবহার করে তারা পুরো পার্বত্য এলাকায় একের পর এক হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এতে করে এলাকায় শান্তির পরিবর্তে অশান্তি সৃষ্টি করে চলেছে।

ফলে শান্তিচুক্তির ২৫ বছরেও পাহাড়ে থামেনি অস্ত্রের ঝনঝনানি। এখনো গোলাগুলির শব্দে গভীর রাতে ঘুম ভাঙে বিভিন্ন এলাকায় বসবাসরত সাধারণ মানুষের। সশস্ত্র সংঘর্ষে পড়ছে লাশের পর লাশ। অব্যাহত রয়েছে পাহাড়ি আঞ্চলিক দলগুলোর সন্ত্রাসী বাহিনীর আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। থেমে নেই পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠন (সন্তু লারমার গ্রুপ) পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, (মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা গ্রুপ) পার্বত্য জনসংহতি সমিতি সংস্কারপন্থি ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) নামের সংগঠনগুলোর সশস্ত্র কর্মকাণ্ড।
এছাড়া পাহাড়ে নতুন করে জন্ম নিয়েছে ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ (কেএনএফ) নামে সশস্ত্র গোষ্ঠী। তারা বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি বিলাইছড়ি সীমান্ত ঘেঁষা দুর্গম পাহাড়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসা কিছু তরুণকে জঙ্গি প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।

অথচ একথা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে,
পার্বত্য শান্তিচুক্তি একটি ঐতিহাসিক চুক্তি, যা পাহাড়ে জাতিগত সংঘাত ও ভ্রাতৃঘাতী রক্তপাতের আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটিয়েছে। এটি বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত একটি চুক্তি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী সিদ্ধান্ত ও শান্তির পক্ষে তার যে অবস্থান সেটিই তিনি প্রমাণ করেছেন এই পার্বত্য শান্তিচুক্তির মাধ্যমে।

এই চুক্তির ফলে ২৫ বছরের মধ্যে সরকার তিন পার্বত্য জেলার অধিবাসীদের জন্য শান্তি প্রতিষ্ঠায় সদিচ্ছার কোনো ঘাটতি দেখায়নি। এরই মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি কমিশন, আঞ্চলিক পরিষদ গঠন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবন মান উন্নয়নে অন্তত ৭০ ভাগ বাস্তবায়িত করছে, যার স্পষ্ট প্রমাণ পার্বত্য জনপদ ও পাহাড়ে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও পার্বত্য-বাঙালিদের জীবনে প্রতিফলিত হয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, শান্তিচুক্তির ফলে সৃষ্ট অনুকূল ও ইতিবাচক পরিবেশে-পরিস্থিতিতে প্রশাসনসহ বিভিন্ন সরকারি ক্ষেত্রে অনেক পাহাড়ি নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা চাকরি পেয়েছেন। উচ্চশিক্ষা ও রাজনৈতিকভাবে তারা বেশ এগিয়েছেন। শান্তি প্রতিষ্ঠার একটি বাতাবরণ তৈরি হয়েছে এর মাধ্যমে। এটি সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়।

তবে এখনো যেসব সমস্যার সমাধান হয়নি সেজন্য, পার্বত্য চট্টগ্রামে যেসব পাহাড়ি রাজনৈতিক দল বা সংগঠন রয়েছে তাদেরও আন্তরিক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণের মধ্য দিয়েই এগুতে হবে সমস্যা সমাধানের জন্য। সরকারসহ অন্যান্য যেসব রাজনৈতিক দল রয়েছে তারা সবাই যদি আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে চুক্তির অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে আন্তরিকভাবে বসে সমাধানের চেষ্টা করেন তাহলে চুক্তির বাস্তবায়ন কঠিন নয়।

প্রসঙ্গত, পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিক নয়- জনসংহতি সমিতির এমন অভিযোগ সর্বাংশে সত্যি নয়। এসব অভিযোগের রাজনীতির অংশ এবং সমস্যাকে দীর্ঘস্থায়ী করার অপচেষ্টা স্বরূপ। বরং পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব ও দেশের সব রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এ ব্যাপারে গঠনমূলক সৌহার্দ্যপূর্ণ আলোচনার মধ্য দিয়েই অগ্রসর হতে হবে। শুধু পরস্পরেকে দোষারোপ করলে সমস্যার সমাধান হবে না। আলোচনাই একমাত্র পথ।

এটাও মনে রাখা জরুরি যে, শান্তি প্রতিষ্ঠায় মূল বাধা সশস্ত্র সন্ত্রাসবাদ। পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো যেসব সন্ত্রাসী ৬/৭টি গ্রুপ রয়েছে তাদের সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী পথ ছেড়ে পাহাড়ি জনপদে শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের উন্নয়নে সহযোগিতা করার রাজনীতি করলেই শান্তি, উন্নয়ন, সম্প্রীতি আসবে। শান্তি প্রতিষ্ঠার নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে অস্ত্রের কোনও স্থান নেই, এই বাস্তব সত্য সংশ্লিষ্টদের মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে হবে। তবেই বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।

শান্তি ও উন্নয়নের সঙ্গে নিরাপত্তার সম্পর্ক নিবিড়। ফলে শান্তি, সম্প্রীতি, উন্নয়ন ও নিরাপত্তাকে নিয়ে একসূত্রে সবাইকে কাজ করতে হবে। দুঃখজনকভাবে পাহাড়ের অনেক উগ্র রাজনীতিক দল ও নেতা সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিচ্ছে এবং শান্তি, সম্প্রীতি, উন্নয়ন ও নিরাপত্তাকে নিয়ে একসূত্রে কাজ করছে না। যেমন, 'পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক বাহিনীর অবস্থানগুলো সরিয়ে নেয়া হয়নি বলে জেএসএস বা অন্য পাহাড়ি সংগঠনের পক্ষ থেকে যে অভিযোগ করা হচ্ছে', তার মধ্যে রয়েছে পার্বত্যাঞ্চলের নিরাপত্তার প্রতি উদাসীনতা ও বিদ্বেষ। কারণ, তিন পার্বত্য জেলা সীমান্তবর্তী অবস্থান অত্যন্ত নাজুক ও বিপদজনক। বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তার ঝুঁকি রয়েছে সেখানে। সীমান্তের অপর পাশে ভারতের উত্তপ্ত সাতটি রাজ্যে রয়েছে। পাশেই সামরিক জান্তা-শাসিত মিয়ানমারের অবস্থান সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্তে উত্তেজনা বাড়িয়েছে। আবার, পাহাড়ের অস্ত্রধারী গ্রুপগুলোর পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী কক্সবাজারে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের বিষয়টিও নিরাপত্তার নানামুখী বিপদ বাড়িয়েছে। অতএব, সকল ধরনের নিরাপত্তা বিষয়ক ইস্যুগুলো নিয়েও ভাবতে হচ্ছে সরকার ও নীতি নির্ধারদের। জাতীয় নিরাপত্তার খাতিরে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার বদলে মহল বিশেষ কর্তৃক বিদ্বেষ ছড়ানো হলে তা হবে আত্মঘাতী এবং উত্তেজনা সৃষ্টিকারী বিপদের কারণ।

আবার এটাও বিবেচনায় নিতে হবে যে, পার্বত্য অঞ্চলটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল রূপে পরিগণিত হচ্ছে। তাই নিরাপত্তার অগ্রাধিকারমূল সকল দিক বিবেচনায় সামরিক স্থাপনাকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি অত্যন্ত সন্দেহজনক ও জাতীয় স্বার্থের বিরোধী। অবশ্যই জাতীয় নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিয়ে বিষয়গুলোকে দেখতে হচ্ছে সরকারকে। পাহাড়ের সকল রাজনৈতিক পক্ষকেও জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে সরকারকে সহযোগিতা করা কর্তব্য। এবং শান্তিচুক্তির ২৫ বছর পূর্তিতে গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমেই পাহাড়ে বিদ্যমান রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিষয়ক সমস্যাগুলোর সমাধান করে পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি, সম্প্রীতি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নকে অব্যাহত রাখতে হবে।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম

এ সম্পর্কিত আরও খবর