ধরে রাখতে হবে এ জাগরণ

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ | 2023-08-30 03:59:58

সাফ উইমেন চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের আগে ফুটবলার সানজিদা আখতারের একটা ফেসবুক পোস্ট ভাইরাল হয়েছিল। সেখানে ছাদখোলা চ্যাম্পিয়ন বাসের প্রসঙ্গ এসেছিল। আক্ষেপ কিংবা বাস্তবতা যা-ই থাকুক না কেন সামাজিক মাধ্যম লুফে নিয়েছিল সে পথ, সংবর্ধনার বিপুল আয়োজনের পথ রচনা হয়েছিল ওখানে। সামাজিক মাধ্যমের সেই তোলপাড় পৌঁছেছিল গণমাধ্যম হয়ে সরকারের উচ্চ মহলে। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল সানজিদার ইঙ্গিতবহ আকুতি কিংবা স্বপ্ন আর সামাজিক মাধ্যমের ঝড়ে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ব্যবস্থা করেছিলেন একটা ছাদখোলা বাসের।

রাজধানীতে আমাদের ছাদখোলা বাস ছিল না। ছাদসহ বাসকে ছাদখোলা বাসে রূপান্তরের ব্যবস্থা হয়েছে বিদ্যুৎ গতিতে। সরকারি পর্যায়ের সেই কর্মোদ্যম আমাদেরকে নাড়া দিয়েছিল, পুরো দেশে আলোড়ন তুলেছিল। সাফ উইমেন চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা ফুটবলাররা তুমুল সংবর্ধনা পেয়েছেন রাষ্ট্রের। ছাদখোলা চ্যাম্পিয়ন বাসে করে বিমানবন্দর থেকে বিজয়ীরা এসেছেন মতিঝিলের বাফুফে ভবনে। সেখানে সংবাদ সম্মেলন হয়েছে। ফুটবল ফেডারেশনের কর্মকর্তারা ছিলেন, প্রতিমন্ত্রী ছিলেন, সচিব ছিলেন; ছিলেন আরও অনেকেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ঢাকাবাসী বিজয়ী ফুটবলারদের তুমুলভাবে গ্রহণ করেছে। দিনভর অপেক্ষায় থেকেছে লক্ষ লোক, পথে পথে ছড়ানো হয়েছে ফুল, হয়েছে মিষ্টি বিতরণ। এ অভূতপূর্ব জাগরণ এক, নবজন্ম যেন ফুটবলের!

ফুটবল বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। আমাদের জাতীয় ফুটবল দল আন্তর্জাতিক ম্যাচ খুব বেশি খেলে না, খেললেও সাফল্য পায় না। কিন্তু যখনই ফুটবলের কোন অর্জন হয়েছে তখনই বিপুল জাগরণ হয়েছে দেশে। নিজেদের দেশের খেলা ছাড়াও এখনও রাত জেগে মানুষ ইউরোপীয় বিভিন্ন লিগের খেলা দেখে, আর বিশ্বকাপ ফুটবল এলে তো কথাই নেই-পুরো দেশ বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই বিভক্তির পুরোভাগে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ঠিক, তবে অন্য কিছু দেশের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সমর্থকও আছে দেশে। বিশ্বকাপ ফুটবলের সময়ে সারাদেশ ছেয়ে ভিনদেশের পতাকায়। পছন্দের দেশের ফুটবল দলের জয়ে উল্লাস করে, হারে ব্যথিত হয়; আবার বিভক্তিতে ঝগড়াফ্যাসাদেও জড়ায়। মানুষের শিরায়-শিরায় যে ফুটবল সেটা বিশ্বকাপ এলে টের পাওয়া যায়। গল্পটা যদিও ভিনদেশের ফুটবলকেন্দ্রিক, তবে এটা যে মানুষের আনন্দের অনুষঙ্গ সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

জাতীয় দলের ফুটবলাররা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাফল্য না পাওয়ায় আমাদের মাঝে হতাশা আছে, ফুটবল সংগঠকদের প্রতি খেদ আছে। তাদের ব্যর্থতা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বাদ-প্রতিবাদও আছে। তবে যখনই উপলক্ষ হয়েছে আনন্দের তখন সবাই বরণ করতে চেয়েছে ফুটবলারদের। সদ্যসমাপ্ত সাফ উইমেন চ্যাম্পিয়নশিপে ফুটবলাররা যখন শিরোপা জিতেছে তখন অন্তর্গত সেই উল্লাসে প্রকাশিত হয়েছে ফের। তৃতীয় পক্ষ হয়ে উল্লাস করে আসা আমরা এবার নিজেদের অর্জন নিয়েই আনন্দ করেছি, করছি। যদিও এটা বৈশ্বিক এমনকি এশিয়ারও শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি নয়, আঞ্চলিক একটা টুর্নামেন্টের শিরোপা; তবুও। ফাইনাল জেতার আগ থেকে শুরু হয়েছে আলোচনা, ফাইনাল জিতে হয়েছে তার বড়সড় প্রকাশ। এই কিছুদিন সামাজিক মাধ্যমে একটাই আলোচনা ছিল; ফুটবল এবং ফুটবল!

আমাদের কৃষ্ণা-সানজিদা-রূপনা চাকমারা যে পরিবেশে বেড়ে ওঠছে সেখানে পদে-পদে মৌলবাদের চোখ রাঙানি, ভয় আর অপবাদ। নারীর পোশাক নিয়ে যখন খোদ দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা অঙ্গনে একশ্রেণির লোক ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে যায়, তখন প্রান্তিক এই মেয়েরা ও তাদের পরিবার কী অবস্থার মধ্যে তা ভাবা যায়? তার ওপর আছে অনেকের আর্থিক দৈন্য। আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া লোকজন সামাজিকভাবেই পিছিয়ে থাকে, এ চিত্র অজানা নয় আমাদের। সেই অবস্থা থেকে ওঠে আসা আমাদের মেয়েরা দেশে খেলতে এবং বিদেশে সাফল্য পেতে কী পরিমাণ সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে তা কেবল তারাই জানে। তারা একেকজন একেক সংগ্রামী। আর সে সংগ্রামের পথ ধরে তারা রচনা করেছে সাফল্যের সিঁড়ি।

শিরোপাজয়ী আমাদের ফুটবলারদের নিয়ে আমরা গর্ব করছি। প্রতিক্রিয়াশীলদের ধারাবাহিক চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে বলছি, এটা আঞ্চলিক এক ফুটবল টুর্নামেন্টের শিরোপা জয়ই কেবল নয়, এটা মানুষের মানুষ হিসেবে প্রকাশের বার্তা। আমরা বলছি, সামাজিক মাধ্যম, গণমাধ্যমসহ নানা জায়গায় এই বার্তা দিতে চেষ্টা করছি, কিন্তু তাদের যে সংগ্রাম সেটা তাদেরকেই করতে হয়। উদযাপন শেষে আমরা প্রত্যেকেই নিজস্ব পরিমণ্ডলে ফিরব, তারাও ফিরবে তাদের জায়গায়। সে সময় যদি ফিরে যায় পূর্বতন সময়ে, তখন কী হবে? এখানে দায়িত্ব নেওয়া উচিত রাষ্ট্রের। উদযাপন পর্ব শেষে এটাও যেন আমাদের মোহমুক্তির আরেক অনুষঙ্গ না হয়। বাসে ওঠলে কেউ যেন তাদের লাঞ্ছিত না করে, কেউ যেন টিপ্পনী না কাটে ফুটবলারদের।

একটা টুর্নামেন্টে জেতা নারী ফুটবলারদের নিয়ে সমাজে বিরাজমান সকল অপ-ধারার বিলোপ হয়ে যাবে এমনটা ভাবছি না। সম্ভবও না। তবে শুরুটা হতে পারে। টিপ্পনী কাটা, পোশাক নিয়ে কটু মন্তব্য ও খেলাধুলা নিয়ে সামাজিক যে সমস্যা তার সমাধানের পথে এই বিজয় অনুঘটক হতে পারে। নারীদের অবরোধবাসিনী করে রাখার যে ধারা সেটা থেকে বেরিয়ে আসার পথ খোঁজার আরেক উপলক্ষ হতে পারে। যদিও কঠিন, তবু শুরু তো হতেই পারে।

বিজয়ী ফুটবলাররা নারী, অনেকের আর্থিক দৈন্য রয়েছে, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের আর্থিক সমস্যাও রয়েছে; সবকিছু আমলে নিতে হবে। প্রথমে নারী ফুটবলারদের সম্মানজনক বেতন-ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে। পুরুষ ও নারী ফুটবলারদের মধ্যে যে বৈষম্য রয়েছে তার সন্তোষজনক সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। যখন নারী ফুটবলার কিংবা ক্রিকেটাররাও পুরুষদের মতো সমান কিংবা সম্মানজনক পর্যায়ের বেতন-ভাতা পেতে শুরু করবে তখন আর্থিক বৈষম্য কমার পাশাপাশি সামাজিক বৈষম্যও কমতে শুরু করবে। অনেক নারী ফুটবল, ক্রিকেট এবং অন্য খেলার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠবে। আর যখন বিপুল সংখ্যক নারী খেলাধুলাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ হবে তখন সামাজিক বৈষম্যও ক্রমে কমতে শুরু করবে, সমাজে সম-অধিকারের বার্তা প্রতিষ্ঠা হবে।

সাফ উইমেন চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা ফুটবলাররা দেশে এক জাগরণের সৃষ্টি করেছেন। এই জাগরণ ধরে রাখতে হবে। সানজিদা-কৃষ্ণা-রূপনারা জাগরণের ঢেউ তুলেছেন, এই ঢেউ স্তিমিত যেন না হয়!

এ সম্পর্কিত আরও খবর