প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে কোন সুরাহা হয়নি। আশ্বাসেই সীমাবদ্ধ থেকেছে বহুল আলোচিত ও প্রত্যাশিত এই পানিবণ্টন চুক্তি। তিস্তা অববাহিকার মানুষদের স্বপ্নপূরণ না হলেও সিলেটের কুশিয়ারা নদীর পানিবণ্টন বিষয়ে সমাধান এসেছে। এতে তিস্তার কান্না একদিকে দীর্ঘায়িত হয়েছে, অপরদিকে আনন্দে ভাসার উপলক্ষ হয়েছে কুশিয়ারা পাড়ের মানুষদের।
তিস্তা পানিবণ্টন ইস্যুটি কেবল উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষদের গলার কাঁটা হয়ে বিঁধছে না, এর রাজনৈতিক তাৎপর্যও আছে। এই পানিবণ্টন ইস্যু নিয়ে বারবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী পর্যায় থেকেও আশ্বাস পেয়ে আসছি আমরা, কিন্তু চুক্তি সম্পাদন হয়নি। ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরের সময়ে এই নদীর পানিবণ্টন নিয়ে আশ্বাস দিয়েছিলেন, কিন্তু বাধ সেধেছিল পশ্চিমবঙ্গ। সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী রাজি হননি চুক্তি সম্পাদনে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও আশ্বাস দিয়েছেন, কিন্তু মমতা ব্যানার্জি রাজি হননি। এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী দিল্লিতে আমন্ত্রিত ছিলেন না, তাই স্বাভাবিকভাবেই এই চুক্তিও সম্পাদনের সম্ভাবনা নাই। তবে এবারও মিলেছে চিরায়ত আশ্বাস, যা দীর্ঘদিন ধরে আমরা পেয়ে আসছি।
তিস্তা চুক্তি যে এবারও হচ্ছে না তার ধারণা মিলেছিল গত মাসে সমাপ্ত যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) বৈঠকে। এক যুগের বেশি সময় পর অনুষ্ঠিত হওয়া ওই বৈঠকে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি দ্রুততম সময়ের মধ্যে সইয়ের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হলে সর্বাত্মক চেষ্টা ভারতীয় পক্ষ থেকে করা হবে বলে জানানো হয়। বৈঠকে গঙ্গা, তিস্তা, মনু, মুহুরি, খোয়াই, গোমতী, ধরলা, দুধকুমার এবং কুশিয়ারা নদী নিয়ে আলোচনার প্রেক্ষিতে জানানো হয় বাংলাদেশকে না জানিয়ে অভিন্ন নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করবে না ভারত।
জেআরসির ওই বৈঠক থেকে ধারণা করা হয়েছিল কুশিয়ারা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে এবার সমাধান হবে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময়ে সেটা হয়েছে। কুশিয়ারা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে দেশের মধ্যে জোর আলোচনা না থাকলেও সুরমা-কুশিয়ারা পাড়ের মানুষেরা জানে এই নদীর পানিবণ্টন বিষয়ে দুদেশের ঐক্যমত্য কতটা জরুরি। শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রত্যাহার আর বন্যা মৌসুমে পানি ছেড়ে দেওয়া নিয়ে যে সমস্যার মুখোমুখি সিলেটের বিশেষত জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ এলাকার মানুষ সেটা কেবল তারাই জানে। ভারতের একতরফা পানিব্যবস্থাপনার কারণে ওই এলাকায় চাষাবাদ যেমন ব্যাহত হয় তেমনি অকাল বন্যায় ভেসে যায় সিলেটের বিস্তীর্ণ অঞ্চল।
কুশিয়ারা নদীর পানিবণ্টনের বিষয়টি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে সিলেটের জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ উপজেলার প্রায় ৫৪ হেক্টর এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি নিষ্কাশন সুবিধাসহ প্রায় ১০ হাজার ৬শ হেক্টর ভূমি চাষাবাদের আওতায় আসবে। এই চুক্তির গুরুত্ব যদি আমরা চিন্তা করি তাহলে একটু পেছন ফিরে তাকাতে হবে। ২০১০ সালে খাদ্য নিরাপত্তার অংশ হিসাবে অনাবাদী জমি চাষের আওতায় আনতে সিলেটের জকিগঞ্জে রহিমপুর খালে পাম্প হাউস নির্মাণের উদ্যোগ নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রকল্পের সুবিধার্থে ২০০৯ সালে কুশিয়ারা নদীর পাড়ে খালের উৎসমুখে বাঁধ নির্মাণ করা হয়।প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের ধারণা এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে জেলার তিনটি উপজেলার প্রায় ১০ হাজার ৬শ হেক্টর ভূমি বোরো ধান চাষ ও মৌসুমি ফসলের আওতায় আসবে। পাউবোর আপার সুরমা-কুশিয়ারা প্রকল্পের অধীনে এর ব্যয় ধরা হয় তিনশ কোটি টাকা। খনন করা হয় বেশ কয়েকটি খাল। মূল প্রকল্প পাম্প হাউস ও রহিমপুর খাল খনন প্রকল্প শুরু করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ২০১৬ সালে সেচ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। কুশিয়ারা নদীর সাথে সংযোগ স্থলের বাঁধের ৪১০ মিটারের মধ্যে ৩২৫ মিটার সম্পন্ন হয়। এরপর নদী হতে খালটির সংযোগস্থলে বাঁধ কাটতে গিয়ে বিএসএফের বাধার মুখে পড়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড। পানির উৎসমুখ বন্ধ থাকায় দীর্ঘ রহিমপুর খালটি মরাখালে পরিণত হয়। তালনদী, চিকানালা ও সদাখালে পানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে পারেনি রহিমপুর খাল। মুখথুবড়ে পড়ে শত কোটি টাকার প্রকল্প, এবং বঞ্চিত হয় তিন উপজেলা। কুশিয়ারার পানিবণ্টন যথাযথ বাস্তবায়ন হলে এই এলাকার মানুষের সামনে সম্ভাবনার যে দ্বার খুলছে সেটা বলাই বাহুল্য।
ফিরে আসি তিস্তা প্রসঙ্গে। তিস্তা প্রসঙ্গটি অনেক পুরনো। স্বাধীনতার পর পর ১৯৭২ সালে তিস্তার পানি নিয়ে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে আলোচনা হয়েছিল, কিন্তু সমাধান আসেনি। তবে ১৯৮৩ সালে অভিন্ন এই নদী নিয়ে দুদেশের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন যে চুক্তি হয়েছিল সে অনুযায়ী বাংলাদেশ ৩৬ শতাংশ, ভারত ৩৯ শতাংশ পানি পাওয়ার কথা ছিল, বাকি ২৫ ভাগ পানি ছিল নদীর নাব্যতা বজায় রাখার জন্যে। দুই বছর মেয়াদি সেই চুক্তি শেষ হলে এরপর আরও দুই বছরের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। এরপর তিস্তা নিয়ে আর কোন অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। এরপর বাংলাদেশে অনেক সরকার এলো-গেলো কিন্তু কেবল ভারতের একতরফা ভূমিকার কারণে চুক্তি করতে পারেনি। চুক্তি নিয়ে বেশ কবার প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের আশ্বাস মিললেও সমাধান হয়নি। অভিন্ন নদীর পানির ব্যবস্থাপনা নিয়ে আন্তর্জাতিক আইন থাকলেও এক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা একতরফা। আওয়ামী লীগ সরকার প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি এবং পরে ফেনি নদীর পানিবণ্টন চুক্তি করতে পারলেও তিস্তা নিয়ে বারবার ব্যর্থ হয়েছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের উভয় সরকারই বলে দুদেশের মধ্যে নিবিড় ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা। দুদেশের শীর্ষ পর্যায়ের নিয়মিত সফর ও বক্তব্য এই কথা বললেও দীর্ঘদিনের তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি অমীমাংসিত হয়ে থাকা এই দাবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। হ্যাঁ, এটা ঠিক কেবল তিস্তা দিয়েই সম্পর্কের গভীরতা পরিমাপ ঠিক নয়, তবে একই বিষয়ে বারবার আশ্বাস সত্ত্বেও সেটা পূরণ না হওয়া নিশ্চয়ই সুখকর উদাহরণ নয়। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রেল, সড়ক ও নদীপথের যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অগ্রগতি হয়েছে সত্য, তবে এই অগ্রগতিতে একতরফা না হোক বহুলাংশে লাভবান হয়েছে ভারতই। পানিবণ্টনে যেখানে আমাদের লাভের অংশ বেশি ছিল সেখানে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি বারবার। এটা একদিকে যেমন প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের স্বার্থপরতা, অন্যদিকে আমাদের কূটনৈতিক ব্যর্থতাও।
কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক।