নির্মাণে ন্যূনতম জননিরাপত্তায় অবহেলা

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-08-31 08:07:22

 

জনবহুল ও গাড়িবহুল ব্যস্ত রাস্তায় দিনদুপুরে খোলা ক্রেন দিয়ে ভারী কংক্রিট উঠানামা করা হচ্ছিল। একশত পঞ্চাশ টন ওজনের বক্স গার্ডারকে উপরে তুলতেই ক্রেনের চাকা উপরে উঠে বেসামাল হয়ে পড়তেই দুর্ঘটনা ঘটে যায়। চলন্ত কারের মধ্যে গার্ডারটি চাপা দিলে গাড়িতে থাকা সাতজনের মধ্যে পাঁচজনের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, গাড়িতে আটকা পড়ে আহত শিশু দুটি  অনবরত কাঁদতে কাঁদতে মুত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। এসব নির্মাণ কাজে মানুষ ও গাড়ি চলাচল বন্ধ করে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করে কাজ করার নিয়ম থাকলেও তার ব্যত্যয় ঘটেছে।

পনেরই আগস্ট ছুটির দিনের বিকেল হওয়ায় মানুষ বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠান এবং জিয়ারতের উদ্দেশ্যে ঘরের বাইরে বের হয়েছিল। আলোচ্য গাড়িটিতে বৌভাতের অনুষ্ঠান শেষে বাবা নিজে ড্রাইভ করে তার ছেলে সহ বৌমাকে শ্বশুরবাড়ি পৌঁছিয়ে দিচ্ছিলেন। বিকেল সোয়া চারটায় এই আকস্মিক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত গাড়ি থেকে দু’জন দরজা ঠেলে বের হয়ে আসতে পারলেও বাকি পাঁচজন বের হতে পারেননি। ফ্লাইওভার তৈরির বক্সগার্ডার অত্যন্ত ভারী জিনিষ। এসব উঠা-নামা করার জন্য নিরাপত্তাসুরক্ষা জোরদার করার প্রয়োজন ছিল অনেক বেশী। কিন্তু ন্যূনতম নিরাপত্তাব্যবস্থা চোখে পড়েনি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বিআরটি ধারণাটি বিশ্বের বড় বড় শহরগুলোতে একটি এক্সক্লুসিভ বাসওয়ে সিস্টেম। এটা সর্বপ্রথম কানাডার অটোয়ায় ১৯৭৩ সালে শুরু হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে ব্রাজিলের কুরিটিবাসহ নানা দেশে বিআরটি ব্যবস্থা চালু হয়। এশিয়ায় সর্বপ্রথম বিআরটি চালু হয়েছে জাকার্তায়। ২০০৪ সালে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় চালু হওয়া ২৫১.২ কি.মি.দীর্ঘ  ট্রান্সজাকার্তা বিআরটি বিশে^র দীর্ঘতম বিআরটি সিস্টেম।

ঢাকা বিআরটি কোম্পানি ২০১৩ সালে চালু হয়। তারা উত্তরা থেকে টঙ্গী হয়ে গাজীপুর পর্যন্ত ২০.কি.মি. দীর্ঘ ফ্লাইওভার নির্মাণের বর্তমান কাজ পেয়েছিল। ‘বাস র্যাপিড ট্রানজিট’ বা বিআরটি নামে সে কাজ সমাপ্ত হবার কথা ছিল আরো অনেক আগে। কিন্তু নানা সমস্যায় যথাসময়ে কাজ শেষ করা হয়নি। সেটাকে এদেশীয় ঠিকাদারের মাধ্যমে দেরীতে করানো হচ্ছে।

একই প্রতিষ্ঠানের কাজে এর আগেও গার্ডার দুর্ঘটনা ঘটেছে। গত ১৫ জুলাই গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তার নিকট গার্ডার পড়ে এক ব্যক্তি মারা গেছেন। আহত হয়েছেন আরো কয়েকজন। তবুও টনক নড়েনি প্রতিষ্ঠানটির। একটি জাতীয় ট্রাজেডির দিনে আরেকটি মর্মন্তুদ ঘটনা মানুষকে আরো বেশী কষ্ট দিয়েছে। সিসি ক্যামেরায় বিয়েবাড়ি ফেরত যাত্রীদের গাড়িতে ভারী বস্তু দিয়ে চাপা দিয়ে চ্যাপ্টা করার করুণ দৃশ্য দেখে আঁৎকে উঠেছে দর্শকের প্রাণ। ভাবা যায়, মৃত্যু কি এত সহজে স্পর্শ করতে পারে মানুষকে?

এগুলো অহরহ ঘটে চলেছে। তাই অনেককে হয়তো আহত করে না। কিন্তু নির্মাণ কাজ তো শুধু দু’একদিনের কোন ব্যাপার নয়। এগুলো এখন পেশাদার প্রতিষ্ঠানের বারোমাসী কাজ। কিন্তু তাদের মধ্যে পেশাদারিত্বের বিন্দুমাত্র লক্ষণ দেখা যায় না। নির্মাণ কাজে জননিরাপত্তার নিশ্চিত করার ব্যাপারে চুক্তি করা হয়ে থাকে। তাহলে সেসব কি কাগুজে চুক্তি মাত্র?

আপাতত দৃষ্টিতে দেখা যায়, জনবহুল রাস্তায় ছিল না কোন ব্যারিকেড, সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড বা বিপদসংকেতের নোটিশও নেই। ব্যবহৃত ক্রেনটি খুব হাল্কা প্রকৃতির। সেটি এত ভারী কাজের জন্য উপযুক্ত ছিল না। দুর্বল ক্রেন হোক বা সবল ক্রেন হোক্, জনবহুল জায়গায় মানুষ ও গাড়ি চলাচলের মধ্যে সেগুলো ব্যবহার করা কি চুক্তির মধ্যে গণ্য আছে? নিশ্চয়ই নেই।

তাহলে এধরণের অবহেলা ও উদাসীনতা দেখানোর কারণ কি? আইন না মেনে চলা আমাদের মজ্জাগত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইনের বিধি-নিষেধ মেনে না চলার ব্যাপারে সবাই বেশ বেপরোয়াভাব পোষণ করে থাকে। কারণ, দুর্নীতির মাধ্যমে আইনের ফাঁক-ফোকর গলিয়ে পার পাবার ব্যবস্থা থাকে। এজন্যই জনদুর্ভোগের কথা মাথায় না এনে অন্যায় ও যেনতেনভাবে দায়সারা গোছের কাজ করা হয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি যদি ভাবতো যে, একটি গার্ডার ছিটকে পড়লে কারো মৃত্যু না হোক, কিন্তু ছয়-সাত ঘণ্টার জন্য এই জনবহুল রাস্তাটিতে চলাচল বন্ধ হয়ে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হবে তাহলে তারা প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে কাজ করতো। কিন্তু তাদের সেই ভাবনা কই?

বিশেষ করে দেশের সবচেয়ে বড় আর্ন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাবার একমাত্র রাস্তা সেটি। আরো একটি বিশেষ বিষয় হলো- জনবহুল রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটলে ট্রাফিক জ্যামের কারণে অকুস্থলে পুলিশ বা ফায়ার ব্রিগেডের উদ্দারকারী দল সেখানে কোনভাবেই সময়মতো পৌঁছাতে পারেন না। গতকাল উত্তরার দুর্ঘটনায় একই সমস্যা হয়েছে। পথচারীরা চিৎকার, হা-হুতাশ করেও কোন কুল-কিনার করতে পারেননি অসহায় মানুষকে সাহায্যের জন্য। সেখানে আরেকটি বড় ক্রেন না আসা পর্যন্ত গার্ডারটি সরিয়ে গাড়ির ভেতর থেকে আহতদেরকে উদ্ধার করা যায়নি। আমাদের উদ্ধারকারী দলের সামর্থ্য নেই বললে ভুল হবে। তাদের যথেষ্ট শক্তি ও সামর্থ্য রয়েছে। কিন্তু সময়মতো তারা নিজেদের সক্ষমতার ব্যবহার করতে পানে না । এক্ষেত্রে ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেছে’ বেশীরভাগ দুর্ঘটনায়।

তবে ঠিক সময়মতো অকুস্থলে পৌঁছুতে না পারাটাও আমাদের উদ্ধার কাজে সক্ষমতা না থাকার একটি শর্ত। এজন্য রাস্তার থার্ড লেনকে সবসময় নির্দিষ্ট স্পিড দিয়ে ব্যবহার করার ব্যবস্থা চালু করতে হবে। কোনভাবেই রিক্সা বা ধীরগতির যানবাহনকে থার্ড লেনে উঠতে দেয়া যাবে না। উন্নত বিশে^ শহর এলাকাতেও শুধু হাই স্পিডের গাড়িগুলো থার্ড লেনে উঠে দ্রতগতিতে চলে যাবার নিয়ম রয়েছে। বিপদের সময় আমাদের সব লেনকেই রিক্সা দ্বারা বা জ্যাম দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে থেমে থাকতে দেখা যায়। তাহলে এম্বুলেন্স ও ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি দ্রুত চলবে কীভাবে?

উদ্ধারকারী দলের অতি দ্রুত বা দৌড়ে কোন দুর্ঘটনাস্থলে যেত না পারাটা আমাদের দেশে দুর্ঘটনার মৃত্যুসংখ্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে। আহতদেরকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা সেবা শুরু করতে পারলে অনেক মূল্যবান জীবনকে হয়তো বাঁচানো সম্ভবপর হতো। আহত হয়ে আর্তনাদ ও আহাজারি শুনে দয়ালু পথচারীদের মন কাঁদলেও শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে সবাই দর্শকের ভূমিকা পালন করেন। এটাই বড় হতাশার, এটাই ভয়ের।

সাধারণত: বিদেশী প্রকৌশলী ও ঠিকাদার আমাদের দেশের মেগা প্রকল্পে কাজ বাগিয়ে নেন। কিন্তু এসব কাজের শ্রমিক ও মূল দায়িত্ব পালন করেন আমাদের দেশের মানুষ। বিদেশীরা নিজেদের দেশে যত সতর্কতার সাথে নির্মাণ কাজের নিয়ম-কানুন মেনে কাজ সম্পন্ন করেন আমাদের দেশে ঠিক ততটাই অবহেলা করেন। তারা মানসম্মত ও উপযুক্ত মেশিন ও ব্যবহার করছেন না। আমাদের শ্রমিক ও নির্মাণ এলাকায় জননিরাপত্তা গ্রহণের ক্ষেত্রেও যেনতেন প্রকারে দুর্বলভাবে কাজ চালিয়ে নেন। কারণ, এদেশে এসব আইন ও নিয়ম-কানুনের ক্ষেত্রে শিথীলতা দেখে তারাও চরম উদাসীন হয়ে দায়সারা নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন। যার চরম খেসারত দিতে হচ্ছে পথচারীদের মূল্যবান জীবনের মৃত্যুর বিনিময়ে।

আমাদের দেশে প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটে আর মানুষের আর্তনাদ ও কষ্ট বাড়ে। কর্তপক্ষ কোন কোন ক্ষেত্রে বড় দুর্ঘটনার জন্য শুধু শোক প্রকাশ করে ক্ষান্ত দেন। সকল দুর্ঘটনাই যে দুর্ঘটনা নয় তা যাচাই করার ফুরসৎ থাকে না। অনেক দুর্ঘটনাই হত্যাকাণ্ডের শামিল। এসব হত্যাকাণ্ডের দায়ভার কে নেবে? এগুলো যে হত্যাকাণ্ড সেজন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে শক্তহাতে বিচার করতে হবে, শাস্তি দিতে হবে।

প্রায়শই: তদন্ত কমিটি গঠিত হয় ঘটনা ঘটে যাবার পর। কিন্তু কোন ঘটনা ঘটতে পারে এমন আইনগুলো অমান্য করে চরেছে বা মানা হচ্ছে না- সেটা অবলোকন করার জন্য আগে কেন তদন্ত কমিটি গঠিত হয় না? নির্মাণ কাজে প্রতিদিন কতশত ক্রেন, ভারী মেশিন রাস্তায় চলাচলকারী মানুষের মাথার উপর দিয়ে ঘুড়ছে- তা কোন কর্তৃপক্ষ আগেভাগে দেখার প্রয়োজন মনে করে না। যারা জনগণের মাথার উপরে নিত্য ক্রেন চালু করে লাভের অঙ্ক কষে তাদের ব্যাপারে পূর্বাহ্নেই কোন তদন্ত করা হয় না। সেটাও দায়িত্বের অবহেলা। এই অন্যায়গুলোকে কেউ গ্রাহ্য করে না।

অথচ, নির্মাণ কাজে দুর্ঘটনা ঘটলে হঠাৎ কাজ বন্ধ করে দিয়ে আরো জনদুর্ভোগ বাড়ানোর জন্য পরামর্শদাতার অভাব নেই। একটি দুর্ঘটনার জন্য গোটা কাজ বন্ধ ঘোষণা করা হলে কোন একটি সুযোগ সন্ধানী পক্ষের আরো মুনাফা করার সুযোগ তৈরি হয়। এত কষ্ট বাড়ে শ্রমিকদের, কষ্ট বাড়ে ভুক্তভোগী জনগণের। তাই হঠাৎ কাজ বন্ধ করে দেয়াটা হঠকারীতা, অন্যায়। অর্থাৎ, নির্মাণ কাজের সাথে জড়িত কেউ কেউ শুরু থেকে শেষ অবধি নানা অন্যায়, অবহেলা ও উদাসীনতার মাধ্যমে জনদুর্ভোগ বাড়িয়ে তোলার কাজে তৎপর রয়েছেন।

এতে সময় ব্যয় হচ্ছে ও সম্পদের অপচয় হচ্ছে। নির্মাণ কাজে এসব দুর্বল যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার পূর্বে সেগুলোর উপযুক্ততা যাচাই করে নিতে হবে। শ্রমিক ও সংশ্লিষ্ট জনগণের সার্বিক নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিয়ে যথাযথ নিরাপদ ও নিরাপত্তা করে তবেই কাজে হাত দিতে হবে। আমরা এভাবে হঠাৎ কারা মৃত্যু ঘটুক তা হতে দিতে চাই না। কোন আহত শিশুর অনবরত কান্নাকে মর্মান্তিক মৃত্যু দিয়ে সমাপ্ত করতে চাই না। দেশে আরো অনেক নির্মাণ কাজ হবে। এজন্য নতুনভাবে সতর্কতা ব্যবস্থা গ্রহণের নীতিমালা চাই। নির্মাণ কাজে মূল্যবান জীবন রক্ষার্থে ও ন্যূনতম জননিরাপত্তা নিশ্চিত কল্পে এসব ঐচ্ছিক গাফিলতি ও অবহেলার আশু অবসান হোক।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

এ সম্পর্কিত আরও খবর