সাকিব, বিসিবি এবং ক্রিকেট

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ | 2023-08-30 04:15:55

'উচিত' শব্দটা একবার লিখতে অন্তত তিনবার ভাবি। শব্দের ধার, ভার, গুরুত্ব বিবেচনায় আমাকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমার্থক অন্য শব্দের আশ্রয় নিতে হয়। কারণ এই শব্দে স্রেফ মতামত-মন্তব্যই থাকে না, বেশি থাকে সিদ্ধান্ত। যদিও সিদ্ধান্ত মূলত ব্যক্তিগত, তবু এই সতর্কতা।

প্রসঙ্গের অবতারণা অন্যতম বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের সঙ্গে একটি স্পোর্টস নিউজ পোর্টালের পণ্যদূতের চুক্তি, বিসিবির অবস্থান এবং শেষমেশ সমাধান। প্রথমত চলতি ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান বিসিবিকে না জানিয়ে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছেন। দ্বিতীয়ত ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অনলাইন জুয়া খেলার একটি প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক। 'বেট উইনার নিউজ' নামের ওই প্রতিষ্ঠানটিতে যদিও বলা হচ্ছে বেটিং কিংবা জুয়া খেলার সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। এদিকে 'বেট উইনার' নামের একটি জুয়ার ওয়েবসাইট দেখা যাচ্ছে অনলাইনে, প্রতিষ্ঠানটি যতই বলুক সম্পর্ক নাই তাতে তাদের সরাসরি কিংবা দূরতম সম্পর্ক মিথ্যা হয়ে যায় না। জুয়ার প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহক ভেড়াতে নানা কৌশল অবলম্বন করে, এটাও হতে পারে তাদের কৌশলের অংশ।

বাংলাদেশে অনলাইন জুয়ার বৈধতা নেই। জুয়া বিষয়ক কোন প্রতিষ্ঠানের প্রচারণাও স্বাভাবিকভাবে সিদ্ধ নয়। এক্ষেত্রে অনলাইন বেটিংয়ের নামাঙ্কিত কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সাকিব অথবা কোন ক্রিকেটারের পণ্যদূত হওয়া উচিত নয়। কারণ তার তারকামূল্য অবৈধ ওইসব প্রতিষ্ঠান ও কার্যক্রমের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করবে। বিসিবির কঠোর অবস্থান তাই সঠিক এবং অভিভাবকসম। বিসিবির সাবেক-বর্তমান একাধিক দায়িত্বশীলের বিরুদ্ধে যতই আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক অভিযোগ থাকুক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশের ক্রিকেটের অভিভাবক প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব আছে, সাকিবের ক্ষেত্রে তারা সে দায়িত্ব পালন করেছে। তাদের বর্তমান ভূমিকা তাই সমর্থন করি।

'বেট উইনার নিউজ' নিজেদেরকে খেলাধুলা বিষয়ক অনলাইন নিউজ পোর্টাল দাবি করছে। নিউজ পোর্টাল হিসেবে তারা নিশ্চয় তথ্য মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধনের অনুমতি চেয়েছে। অনুমতি চাইলে এই ওয়েসাইটের প্রকাশক-সম্পাদকসহ এর সঙ্গে জড়িত সকলের তথ্য মন্ত্রণালয়ে থাকার কথা। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক তাদের নিয়ে তদন্ত হওয়ার কথা, প্রতিবেদন পাওয়ার কথা; আবার সবগুলো ধাপ সম্পন্ন না হলে সেগুলো নিশ্চয় প্রক্রিয়াধীন। 'বেট উইনার' বেটিং সাইটের সঙ্গে বেট উইনার নিউজের সম্পর্ক আছে কি নাই সেটা তাই প্রশ্ন-পাল্টা প্রশ্নের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে প্রমাণ হয়ে পড়ার কথা, অন্তত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেই। এছাড়া কথিত এই স্পোর্টস নিউজ পোর্টাল যদি তথ্য মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধনের অনুমতি না চায় তাহলে তাদের ওয়েবসাইট বাংলাদেশে বন্ধ করে দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

দেশে কয়েক হাজার অনলাইন নিউজ পোর্টাল নিবন্ধন চেয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে। গত ছয় বছরে মাত্র শতাধিক আবেদনের নিষ্পত্তি করতে পেরেছে মন্ত্রণালয়। 'বেট উইনার নিউজ' নিয়ে যখন আইনত অসিদ্ধ একটা বেটিং সাইটের যোগ বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের মিটিংয়ে, সেখানে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়-সংস্থা উদ্যোগ নিতে পারে। বিটিআরসি চাইলে পারে বেট উইনার নিউজ পোর্টালকে দেশে বন্ধ করতে। কারণ সাকিবের পণ্যদূত হওয়া, বিসিবির কঠোর অবস্থান, গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনার পর বেট উইনারের নাম সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সাকিব বেট উইনার নিউজের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত জানানোর পরও তাদের যে প্রচার হয়েছে সেটাই যথেষ্ট তাদের পরিচিতি ও মার্কেটিংয়ে। চুক্তি বাতিলে সিদ্ধান্ত স্বত্ত্বেও সাকিবের তারকামূল্য এখানে ব্যবহার হয়েই গেছে।

ক্যাসিনোকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে সাবেক পরিচালক লোকমান হোসেন ভুইয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পরেও বিসিবি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপন লোকমান হোসেনকে তার 'বন্ধু' দাবি করে এমন কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় অভিযোগে 'বিস্মিত' হয়ে প্রমাণের অপেক্ষা করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট পাপনের একটা ছবি সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশের পর খোদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী 'ছবিটি দেশের নয়' বলে ব্যবস্থা নিতে আইনি সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়েছিলেন। পরিচালক ও দলের সঙ্গে নিয়মিত বিদেশ সফর করতে থাকা সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ সুজন একটা ক্যাসিনোতে যাওয়ার ছবি প্রকাশের পর 'ডিনার করতে' গিয়েছিলেন বলে দাবি করেছিলেন। এছাড়া আছে প্রেসিডেন্ট পাপনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ। বিসিবির বেশিরভাগ বৈঠক সংস্থাটির অফিসে না করে নিজের করপোরেট অফিসে করেন, টস জিতলে ব্যাটিং নাকি ফিল্ডিং এটা পূর্ব-সিদ্ধান্তে করতে অধিনায়ককে চাপ দেন, দলে অযথা হস্তক্ষেপ করেন, প্রধানমন্ত্রীর নাম জড়িয়ে নানা কথা বলাসহ একপ্রকার স্বেচ্ছাচারের পরিবেশ তৈরি করেছেন। সবকিছুতে তার হস্তক্ষেপের কারণে প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিসিবি দাঁড়াতে পারছে না। তার কথাই শেষ কথা, হুটহাট নানা কথা বলার কারণে কোন সিদ্ধান্ত নিতে তিনি কারও সঙ্গে আলোচনা করেন এমনটাও মনে হয় না। এতে তিনি ব্যক্তিগতভাবে প্রভাবশালী হলেও প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিসিবি দুর্বল হয়েছে, দিন-দিন আরও হচ্ছে।

বিসিবির যখন এমন পরিবেশ তখন সাকিবও বিসিবিকে পাত্তা দেন না, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রায়ই ভঙ্গ করেন। তিনি ইচ্ছে হলে খেলেন, না হলে ছুটি কাটান। বিদেশের বিভিন্ন ফ্রাঞ্চাইজি লিগের প্রতি তার প্রবল আগ্রহ, এমন অভিযোগও আছে। আনুষ্ঠানিক ফটোসেশান প্রায়ই এড়িয়ে চলেন। তিনি জানেন তার বিকল্প তৈরি হয়নি। ফলে বিসিবির সঙ্গে তার দ্বৈরথ চলে প্রায়ই। যদিও এটাকে বেশিরভাগ লোক; পাপন-সাকিব দ্বন্দ্ব' বলে মনে করেন। এর কারণ মূলত একজন নিজেকে বিসিবিতে সর্বেসর্বা মনে করেন, অন্যজন দলে। এমন অবস্থায় প্রতিষ্ঠানে যেমন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ধ্বংস হচ্ছে, তেমনি দলেও। এ থেকে বেরিয়ে আসা দরকার আমাদের, এগুলো পরিহার করা উচিত।

সাকিব এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের একমাত্র সুপারস্টার, তবে তিনি নিশ্চয় সর্বশেষ নয়। আমাদের বিশ্বাস আরও অনেক ক্রিকেটার আসবে যারা সাকিবকেও ছাড়িয়ে যেতে পারেন। এমনটা হলে দেশের ক্রিকেটেরই মঙ্গল। সাকিব অনেকের 'আইডল', তাই তার সকল কিছু যে ভাবেই হওয়া উচিত যাতে ক্রিকেট থাকে ক্রিকেটের পথেই। একইসঙ্গে বিসিবিকেও দায়িত্বশীল হতে হবে। স্বেচ্ছাচারের পরিবেশ রুখতে প্রয়োজনে ঢেলে সাজানো উচিত বিসিবিকে।

একক কর্তৃত্ব বিসিবিকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুর্বল করেছে। প্রাতিষ্ঠানিক এই দুর্বলতায় জায়গায়-জায়গায় কর্তৃত্ববাদ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠেছে। দলে ও বিসিবিতে 'বিকল্প কোথায়' এই প্রচারণা-দাবি ও মনোভাব পরিহার করে ক্রিকেটের বৃহত্তর স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে। তা না হলে আমাদেরকে কিছুদিন পর পর এমন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে যেখানে ক্রিকেটই হুমকির মুখে থাকবে, অথচ আমরা এর নাম দেব 'সাকিব-পাপন দ্বৈরথ'!

আমরা সাকিবে মুগ্ধ ঠিক, কিন্তু সাকিব-অন্ধ নই; আমরা বিসিবি প্রেসিডেন্টে বিরক্ত, কিন্তু তার বিরোধিপক্ষ নই। আমাদের পক্ষ একটাই; ক্রিকেট, ক্রিকেট এবং ক্রিকেট!

এ সম্পর্কিত আরও খবর