কাজের মঙ্গাকে গুরুত্ব দিন

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-08-30 04:29:21

 

অধুনা ‘মঙ্গা’ শব্দটি বললেই ভাবা হয় অন্যকিছু। ধরে নেয়া হয় সেখানে রাজনীতি অথবা অপপ্রচার শুরু হয়ে গেছে। মঙ্গা শুধু ভাত বা খাদ্যের অভাবের জন্য নাও হতে পারে। যিনি যেভাবে ভাবুন না কেন-বড় মানুষের বড় বড় জিনিষের জন্য মঙ্গা আর খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষের মঙ্গা মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্রমাগত অপূরণ থেকে হতে পারে।

কারণ, মঙ্গার বাংলা অর্থ সংকট বা বড় অভাব। মূলত: প্রায় সবার ঘরের ধান-চাল তথা খাবার নি:শেষ হলে এবং খাদ্য কেনার সামর্থ্য না থাকলে যে সংকট সৃষ্টি হয় সে থেকে চারদিকে হাহাকার তৈরী হলে সেটাই মঙ্গা নামে পরিচিত। “মঙ্গা একটি বিদেশী শব্দ। হিন্দী ও উর্দুতে বলা হয় ম্যোঙ্গা। দেশের কুমিল্লা ও নোয়াখালি অঞ্চলে উচ্চারিত হয় মাঙ্গা। উত্তরাঞ্চলের রংপুরে একে বলা হয় মঙ্গা। এর আভিধানিক অর্থ উচ্চ মূল্য, এমন মূল্য যা সর্ব সাধারণের নাগালের বাইরে।”

বলা হয়-কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে মঙ্গার চিত্র পাল্টে গেছে। তবে দেশের চরাঞ্চল ও দরিদ্র জেলাগুলোতে বিপুল সংখ্যক ভূমিহীন মানুষের কর্মসংস্থান না থাকায় মৌসুমী বেকারত্ম ও বেঁচে থাকার অবলম্বন সংকুচিত হওয়ায় মঙ্গার চিত্র চেখে পড়ে। যেমন, কুড়িগ্রাম জেলায় দারিদ্র্যের হার ৭০.৮ শতাংশ (বিবিএস)। বিআইডিএস-এর মতে, কুড়িগ্রামে অতিদরিদ্রের হার ৫৩.২ শতাংশ (প্রথম আলো জুলাই ৩০, ২০২২)। খাদ্যের মঙ্গা কমে গেলেও প্রতিবছর বন্যা আর নদীভাঙ্গনের কারণে দারিদ্র্যের সংগে লড়াই করতে হয় লক্ষ লক্ষ মানুষকে। অভাব বিমোচনের বিভিন্ন প্রকল্পে যাদের অনেকের নেই কোন সংযোগ ও অংশগ্রহণ।

চিলমারীর জোড়গাছ বাজারের ব্রহ্মপুত্রের চরে কাজ করে একজন দিনমজুর জমির আল থেকে হেলেঞ্চা শাক তুলে বাড়ি ফিরছেন। সম্প্রতি তিনি একটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় হেলেঞ্চার বোঝাসহ সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন। তার এলাকায় বন্যার পর খাদ্য ও কাজের দারুণ অভাব দেখা দিয়েছে। দৈনিক মজুরীভিত্তিক কাজ না থাকলে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় তাদের আর কি-ই বা করার আছে? একজন বা দু’জন তো নয়। যেখানে অতিদরিদ্র মানুষের হার তিপ্পান্ন শতাংশ। সেখানে কাজের মঙ্গা শ্রমিকদের জন্যে। ওদের গ্রামে কাজ নেই। শহুরে ভাসমান মানুষ ও বস্তিবাসীদের কথা বাদ দিলাম। আর আর দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ৪০ ভাগের বেশী। এদের চাকুরী নেই। সুতরাং কাজের মঙ্গা গ্রাম-শহর সব জায়গায়।

আমাদের চারদিকে চোখ মেললেই কতকিছুর প্রাচুর্য্য দেখি আবার চোখ মেলা বা বন্ধ করা অবস্থাতে অনুভব করি নানা অভাব। তবে যারা অভাবকে অভাব বলে কপটতা করেন বা স্বীকার করেন না- তাদের কথা আলাদা। কারণ, কিছু মানুষের অভাববোধ নেই। যেসব মানুষের অভাব বোধ নেই তারা অতিমানব অথবা পেটে পাথর বেঁধে কায়ক্লেশে বেঁচে থাকা সুখী মানুষের নামান্তর।

মাটির মানুষের শরীরে রক্তমাংস তাই প্রতিটি মানুষের অভাববোধ থাকে। তাইতো ‘ঝিনুক দিয়ে মেপে খেলেও রাজার ভান্ডার ফুরিয়ে যায়’। পৃথিবীতে শক্তির নিত্যতা নীতি অনুযায়ী সবকিছু পরিবর্তিত হয়। একবার বেশী হয়, আবার কমতে কমতে নি:শেষিত হয়ে যায়। ভাঙ্গা-গড়া ও কমা-বাড়ার মধ্যে ঘুরতে থাকে ঘড়ির চাকা। সেজন্য ধনী-দরিদ্র হয় আর দরিদ্র হয়ে যায় ধনী।

এটা স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু কিছু মানুষ সেটা স্বীকার করতে লজ্জা পায়। অথবা অস্বীকার করে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দেয়। এই হাম্বরা ভাব ও বাস্তবতাকে লুকানোর কপটতা মানুষের অভাব ও দারিদ্রের আরেকটি বড় কারণ। সেজন্য আমরা সুখী মানুষের দেশের তালিকার শীর্ষে বার বার আসি আবার পরক্ষণে বন্যার স্রোতের মতো দু:খের সাগরে ভেসে যাই।

আমাদের চেপে রাখা অভাব আর মুখের সাজানো হাসির আমন্ত্রণ একটি বিশেষ কৃষ্টি এবং ঐতিহ্যও বটে। এজন্য গভীর রাতে গৃহস্থ বাড়িতে অতিথি এলে ঘরের ডিমপাড়া পোষা মুরগীটা জবাই করে আপ্যায়ন করতে দ্বিধা করি না।

সেদিন আমাদের পরিবারের একজন বিদেশিনী ভাবী বলেছেন, তোমাদের বাড়ির ভেতরটা সুন্দর। ড্রইংরুমটা আরো সুন্দর, খুব গুছানো থাকে। কিন্তু সেটার সাজসজ্জা দেখে বলার উপায় নেই সব জায়গায় একই রকম। বাড়ির পাশের রাস্তা কেন এত নোংরা? বিশেষ করে বাইরের হাট-বাজারের অবস্থা কিরকম তা জানি না কিন্তু রাজধানীতেই কাঁচা বাজারে একহাঁটু পানি, কাদা, ময়লা। আমার নিজ হাতে বাজার করতে ইচ্ছে হয় কিন্তু বাজারের পরিবেশ এত নোংরা! তার উপর দামের হেরফের। বাজারে গেলে টোকাই ও ভিক্ষুকরা জামা ধরে টানাটানি করে। আমি ভীমড়ি খেয়ে যাই। দেশের মানুষের অভাবটা সেখানেই চোখে পড়ে। ওনার পর্যবেক্ষণমূলক কথা শুনে আসলেই ভীষণ লজ্জা লাগে। তার উপর তিনি পেশায় একজন ডাক্তার।

কিন্তু কিছু মানুষের সেসব চোখে পড়ে না। তারা অভাব, মঙ্গা, দারিদ্র, হতাশা, চুরি, দুর্নীতি ইত্যাদি নিয়ে কথা বললে রাগ করে। তাদের নিজেদের অভাববোধ নেই, নিত্য সকালে বাজারে যেতে হয় না। ভিক্ষুক এসে তাদের বাসার কলিং বেল বার বার টেপার অধিকার পায় না। অথবা দারোয়ান বাসার দরজা পর্যন্ত ভিক্ষুক প্রবেশের সেই সুযোগটা হরণ করে নিয়েছে মালিকের আদেশে। তাই তারা চারদিকের গিজ গিজ করা অভাবী মানুষের সঠিক সংখ্যাটা জানেন না।

গত জুন ২৭, ২০২২ তারিখে প্রকাশিত জনশুমারীর প্রাথমিক রিপোর্ট দেখে প্রথমেই হোঁচট খেতে হলো। সেখানে মোট জনসংখ্যার কথা বলা হয়েছে ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। তার মধ্যে নারী ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার ২০৬ জন। পুরুষ ৮ কোটি ১৭ লাখ ১২ হাজার ৮২৪ জন। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সংখ্যা ১২ হাজার ৬২৯ জন। এই তিন শ্রেণি আলাদা করে যোগ করলে দাঁড়ায় ১৬ কোটি ৫০ লাখ ৬৫৯ জন। যা হিসেবকৃত মোট জনসংখ্যার চেয়ে ৮৫ হাজার ৯৫৭ জন কম দেখায়। অতিরিক্ত ৮৬ হাজার কম জনসংখ্যা সম্বলিত তথ্যবিভ্রান্তি হয়তো পরবর্তী সংশোধনীতে ঠিক করা হবে। কিন্তু শুরুতেই এতবড় অসামঞ্জস্য নানা সন্দেহের উদ্রেক করেছে। এমন বিভ্রান্তিকর পরিসংখ্যান যেখানে- সেখানে এক শ্রেণির মানুষ দেশের প্রত্যন্ত এলাকার শতকরা তিপ্পান্ন ভাগ অতিদরিদ্র মানুষের মঙ্গা বা অতিঅভাবের কথা স্বীকার করতে চাইবেন না-এটাই স্বাভাবিক।

এত কষ্টের নিয়তি নিয়ে দরিদ্র মানুষগুলোর কষ্টের কথা বলা যাবে না। বললেই রাজনৈতিক অপপ্রচার ও উপহাস দিয়ে ‘তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ার’ লোকের অভাব নেই। এই ধরনের দৈন্য মানসিকতার জন্য দেশের দারিদ্র ক্রমাগত জিইয়ে থাকে। অনেক সময় দেশের প্রথম সারির গণমাধ্যমেও সেগুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয় না। তারা ধনী-গরীব নির্বিশেষে সকল সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করার নৈতিক দায়িত্বটুকুও অবহেলা করে বসেন। ফলে সবকিছু পিছিয়ে চলে যায় গহীন অন্ধকারে। সমাজের কল্যাণের নিমিত্তে এসব মৌলিক বিষয়ের সমালোচনাকারীরা কারো কোন পক্ষ নন। বরং জাতীয় গুরুত্বপূর্ন এসব বিষয় নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনাকারীরা নীতিমালা গ্রহণের ক্ষেত্রে ছায়াসিদ্ধান্ত প্রদানকারী।

আমাদের দেশে সব ধরনের পরিবর্তন একসংগে শুরু হওয়ায় একটি ক্রান্তিকাল চলছে। এই পরিবর্তনে নেতিবাচক দিকগুলোকে সতর্কতার সাথে পরিহার করার জন্য কর্র্তপক্ষের সূক্ষ চিন্তাভাবনা থাকতে হবে। শুধু ইতিবচাক পরিবর্তনগুলো যেন সামনে যাবার গতিবেগপ্রাপ্ত হয় সেজন্য সব ধরনের ছলচাতুরী পরিহার করার মানসিকতা থাকতে হবে।

তা-না হলে গলার গামছায় হেলেঞ্চা শাকের আঁটি বেঁধে বিষন্নচিত্তে দাঁড়িয়ে থাকা চিলমারীর দিনমজুর হযরত আলীর মতো করুণ চাহনিধারী মানুষের সংখ্যা দিন দিন আরো বেড়ে যাবে। সামাজিক বঞ্চনা ও বৈষম্য আমাদের সবাইকে অহেতুক পরস্পরকে প্রহসন ও হেয় করতে শেখাবে। নিশ্চয়ই এই অবস্থা আমরা কেউই আর হতে দিতে চাই না।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

এ সম্পর্কিত আরও খবর