ছিন্নমূল মানসিক বিকারগ্রস্থ নারীদের জীবনের বাস্তবতা

, যুক্তিতর্ক

চিত্রা গোস্বামী        | 2023-08-31 21:06:48

গত ২৫-২৭ জুলাই অনুষ্ঠিত হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা । আমার বাসায় কয়েকজন আত্মীয় পরীক্ষা দিতে এসেছিলো । গত ২৬ জুলাই পরীক্ষা দিয়ে ওরা ২৭ জুলাই চলে যায়। ২৭ জুলাই সকাল ছয়টার সময় আমি ওদের নিয়ে ট্রেন স্টেশনে গিয়েছিলাম ট্রেনে তুলে দিতে।

স্টেশনে অনেক ভিড় দেখে আমার ড্রাইভার বললো ম্যাডাম আপনি গাড়িতেই বসে থাকুন আমি গিয়ে তুলে দিয়ে আসছি।  আমি কয়েক দিন আগে পায়ে একটু ব্যাথা পেয়েছিলাম বিধায় আমি আর  এগোলাম না। কারণ আমার পায়ের যে অবস্থা তাতে আমার পক্ষে ট্রেনে ওঠাটা কষ্টকর হয়ে যেত।  তাই আমি গাড়িতেই বসে থাকলাম। 

গাড়িতে বসে থেকে বাইরে মানুষগুলো দেখছিলাম। অনেক পরীক্ষার্থী এবং তাদের বাবা-মা সবাই ছুটছে ট্রেন ধরবার জন্য গাড়িতে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ আমার চোখ পড়ল একটা মেয়ের দিকে।  তার দিকে চোখ যাওয়ার পর থেকে আমি কিছুতেই আমার চোখ সরাতে পারলাম না। মেয়েটির বয়স কতই বা হবে? হয়ত আঠারো /উনিশ? অথবা আর একটু কম বেশি। ওকে দেখে আমার মেয়ের বয়েসই মনে হচ্ছিল। মেয়েটার গায়ে একটা ছেঁড়া জামা ও ছেঁড়া পায়জামা এবং কোলে একটি ফুটফুটে বাচ্চা। বাচ্চাটির বয়স হয়তো দুই তিন মাস।

মেয়েটিকে দেখে বুঝতে পারলাম সে পুরোপুরি না হলেও কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন। সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল হয়তো রাতের আঁধারে মেয়েটির অসুস্থ্যতার সুযোগ নিয়ে কেউ তার সর্বনাশ করেছে। আর তারই ফলশ্রুতিতে আজকের এই সন্তান তার কোলে। আমাদের সমাজে গরীব অসহায় মেয়েদের-যাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, লজ্জা নিবারণের জন্য একটা ভালো কাপড় নেই , রাস্তায় একমাত্র ভরসা।

এই ধরণের মেয়েদের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই বিধায় যে কেউ চাইলেই তাদের দেহটা নিজেদের খুশি মতো ভোগ করতে পারে। আবার কাম -লালসা চরিতার্থ হলে সাথে সাথে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে রাস্তায়। আমার মনে হয় এদের জন্ম হয় শুধু মাত্র একশ্রেনীর মানুষের কাম - লালসা মেটানোর জন্য।

আমি মেয়েটি ও তার বাচ্চাটিকে দেখে ভাবছিলাম মেয়েটি নিজেও হয়তো জানেনা কে তার সন্তানের বাবা! এই বাচ্চাটি যখন বড় হবে তখন আমাদের এই সমাজ কি তাকে স্বীকৃতি দিবে? যখন স্কুলে ভর্তি হতে যাবে তখন স্কুল কি তাকে তার পিতৃ পরিচয় ছাড়াই ভর্তি নিবে? আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে এই বাচ্চাটি কোনো দিনই তার বাবাকে খুঁজে পাবে না। কোনো দিনও জানবে না কে তার বাবা?

মেয়েটি মানসিক ভারসাম্য হীন হওয়ায় তা একেবারেই সম্ভব না। হয়তো বাচ্চাটির বাবা তারই আশেপাশে থাকবে কিন্তু সে কোনো দিনই জানবে না বা খোঁজ নিবেনা যে, রাস্তা -ঘাটে তারা এরকম কত সন্তানের জন্ম দেয়!

তাদেরই রক্ত রাস্তা -ঘাটে অবহেলায় পড়ে থেকে মানুষ হয়। মেয়েটিকে দেখলাম বাচ্চাটা কোলে নিয়ে এক পাশে বসলো এবং বাচ্চাটাকে দুধ খাওয়াতে লাগলো। অত্যন্ত অবহেলায় বাচ্চাটার একহাত ধরে টেনে তুলছিলো এবং এপাশ - ওপাশ করাচ্ছিল। বাচ্চাটার মনে হয় হাতে ব্যাথা লাগছিল বিধায় সে খুব কান্নাকাঁটি করছিল। মেয়েটি তার বাচ্চাটাকে খাওয়াতে খাওয়াতে বার বার ওরনা দিয়ে তার নিজের গা হাত- পা ঢাঁকছিলো।তার পরণের জামা পায়জামা দুটোই ছেঁড়া।

আমি জানিনা যে মেয়েটি আদৌও জানে কিনা যে সন্তান কি জিনিস!

আমাদের সমাজের কত বিত্তবান মানুষ আছে যারা একটা সন্তান পাবার জন্য সারাজীবন হাহাকার করছে! লাখ লাখ টাকা ডাক্তারের পেছনে খরচ করছে একটা সন্তানের জন্য! তারপরেও ঈশ্বর তাদের কোলজুড়ে একটা সন্তান দেয়না! যে সন্তান তাদের জন্য মানুষ করা কোনো ব্যাপারই না। আবার সন্তানের অভাবে কোটিকোটি টাকার সম্পত্তির মালিকানা পেয়ে যাচ্ছে অন্যরা। অথচ মানসিক ভারসাম্যহীন সে মা হয়তো বুঝেই না সন্তান কি জিনিস! তার কোলজুড়ে ঈশ্বর দিয়ে রেখেছেন ফুটফুটে একটি দেবদূত!!

যে কিনা মানুষ হবে রাস্তা ঘাটে পড়ে থেকে, একবেলা খেয়ে না খেয়ে, মানুষের ঝাঁটা -লাথি খেয়ে! হায়রে ঈশ্বরের কি অসম বণ্টন!!!!!

মেয়েটিকে দেখার পর থেকে আমি কেন যেন তাকে ভুলতেই পারছিনা! এই সকল মেয়েদের দায়িত্ব কি রাষ্ট্র নিতে পারে না? বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তাঁর বাবা সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিরলসভাবে পরিশ্রম করে চলেছেন। তিনি দরিদ্র মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য বিভিন্ন ধরণের কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন। গৃহহীনদের জমির মালিকানাসহ ঘর প্রদান করছেন। এবার প্রয়োজন এই ছিন্নমূল মানুষদের দিকে দৃষ্টি দেওয়া। বাংলাদেশে হাজার হাজার এই ধরনের মানসিক ভারসম্যহীন ছিন্নমূল নারী রয়েছে। আমাদের সমাজে এক শ্রেণির মানসিক বিকারগ্রস্থ পুরুষ রয়েছে যারা এই ধরণের মেয়েদেরকে ভোগের বস্তু হিসেবে মনে করে। তাদের বুদ্ধিহীনতার সুযোগ নিয়ে তাদের ভোগ করে রেখে যার ভোগের চিহ্ন হিসেবে অনাগত সন্তান। এই সন্তানরাই এক সময় বিভিন্ন অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পরে।

ফলে সময় এসেছে এই সকল মেয়েদের জন্য কিছু করার। আমার জানি যে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ রয়েছে এই সকল মেয়েদের দেখাশোনা করবার জন্য। প্রতিটি জেলায় এই ধরণের মেয়েদের খুঁজে বের করে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যেয়ে তাদের চিকিৎসাসহ অন্যান্য সকল প্রকার প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করা প্রয়োজন। এ ধরণের মেয়েদের সন্তানদের সরকারি ব্যবস্থাপনায় শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করা হলে একটি প্রজন্ম নষ্ট হবার হাত থেকে বেঁচে যাবে। আমি বিশ্বাস করি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই বিষয়গুলি বিবেচনা করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এই বিষয়গুলি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে উন্নয়ন অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে।

লেখিকা গৃহিণী।   

এ সম্পর্কিত আরও খবর