মিথ্যা ঘোষণায় মদ আমদানি ও জাতির অবক্ষয়

, যুক্তিতর্ক

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | 2023-08-31 07:56:46

চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে বার কোটির অধিক টাকা শুল্ক ফাঁকি দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় বিদেশী মদ আমদানি করে ধরা পড়েছে একটি জালিয়াত চক্র। শুধু তাই নয় সেট চালানের ছাড়পত্র দেবার কাজ সম্পন্ন হয়ে গেলে সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে লরীভর্তি মালামাল আটক করা হয় ঢাকার কাছে সোনারগাঁও এলাকার রাস্তা থেকে। সংবাদে জানা গেছে- এই ধরনের মিথ্যে ঘোষণা দিয়ে মাদকদ্রব্য আমদানি করা নতুন ঘটনা নয়। বলা হয়, ‘চোরের দশদিন গৃহস্থের একদিন’- হয়তোবা এ কাজে নির্দিষ্ট তারিখটির দিকে গৃহস্থের বিশেষ নজরে ছিল।

সংবাদে জানা গেছে, নীলফামারী উত্তরা ইপিজেডের ডং জিন ইন্ডাস্ট্রিয়াল (বিডি) কোং লিমিটেডের নামে আইপি জালিয়াতি করে এক কনটেইনার মদ আমদানি করে জালিয়াতচক্র। গত ১৬ জুলাই, ২০২২ চালানটি চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। চালানটি খালাসের জন্য ২০ জুলাই এসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে বিল অব অ্যান্ট্রি দাখিল করে সিএন্ডএফ প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। কাস্টমসের এআইআর শাখার ডেপুটি কমিশনার জানান, ‘শতভাগ কায়িক পরীক্ষা শেষে চালানটিতে ১২ কোটি ৪৫ লাখ টাকার শুল্ক ফাঁকির চেষ্টা করা হয়েছে।’

‘এতে শুল্কায়নের জন্য শতভাগ পলেসটার সুতা ঘোষণা দেওয়া হয়। ওই দিনই চালানটির শুল্কায়ন কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়। একদিন আগে নারায়ণগঞ্জ থেকে একই সিএন্ডএফ প্রতিষ্ঠানের মিথ্যা ঘোষণায় আনা দুটি চালান আটক করা হয়। এজন্য প্রতিষ্ঠানটির অন্য চালানগুলোও পর্যালোচনা করতে কাস্টমসের এআইআর শাখা খালাস স্থগিত করে এসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে লক করা হয়। পরে কনটেনারটি খোলা হলে সুতার পরিবর্তে সেখানে মদ পাওয়া যায়।’

আমাদের দেশে মাদকদ্রব্য আমদানি, উৎপাদন, বিপণণ ও ভোগ করার জন্য ২০১৮ সালে প্রণীত আইন রয়েছে। এটি বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। সেখানে দেশের মুসলিমদের জন্য মদ অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। শুধু অমুসলিম, বিশেষ পেশায় কর্মরত-মুচি, মেথর, ডোম, চা বাগানের শ্রমিক ইত্যাদি) বিশেষ ‘পারমিট’ নিয়ে দেশী মদ কিনতে পারবেন। সেটা ২১ বছরের বয়স হবার পর এবং বিদেশীদের জন্য নির্দিষ্ট হোটেল বা সংরক্ষিত স্থানে মদ ক্রয় ও ব্যবহার করার কথা উল্লেখ রয়েছে।

শুধু নতুন যে বিষয়টি সংযুক্ত করা হয়েছে তা হলো- আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শপিং সেন্টারে প্রতিষ্ঠিত ক্লাব বারে মদ কেনা বেচা ও পানের সুযোগ রাখা। সেক্ষেত্রে ঐ আধুনিক শপিং সেন্টারে ক্লাব থাকতে হবে এবং ক্লাবের সদস্যদের অন্তত: ২০০ জনের লিখিত অনুমতি থাকতে হবে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও ব্যবহার বিধি থেকে একথা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশে মদ বিক্রি, ক্রয় ও ব্যবহারের বিষয়গুলো বেশ কঠিন।

বিশেষ করে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জনশুমারি রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৯২.৭ ভাগ মুসলিম। এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের জন্য এদেশে মাদকদ্রব্য ব্যবহার নিষিদ্ধ।

এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, “এখন পর্যন্ত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, মুসলিম প্রহিবিশন রুল ১৯৫০ ও এক্সাইজ ম্যানুয়াল (ভল্যুম–২) ও প্রয়োজন অনুযায়ী নির্বাহী আদেশে অ্যালকোহল বা মদ্যপান ও কেনাবেচার বিষয়টি নিয়ন্ত্রিত হয়। অস্পষ্টতা থাকায় অ্যালকোহল বা মদ্যপান ও কেনাবেচা, আমদানি–রপ্তানি নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। সে কারণে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ অনুযায়ী অ্যালকোহল জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের জন্য বিধিমালা হচ্ছে। তবে আগের মতোই এ দেশের মুসলিম নাগরিকদের জন্য মদ অবৈধই থাকছে। কোনো মুসলমান চিকিৎসার প্রয়োজন ছাড়া মদ বা মদ জাতীয় পানীয় পান করতে পারবেন না। চিকিৎসকের সনদ নির্ধারিত ফরমে যুক্ত করে তাঁকে আবেদন করতে হবে।”

এছাড়া আরো বলা হয়েছে, “ স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা চিন্তা করে প্রতিটি দেশি ও বিদেশি মদ, বিয়ার বা এ–জাতীয় মাদকদ্রব্যের বোতল, মোড়ক বা পাত্রের গায়ে ‘মদ্যপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, আইনের বিধান ব্যতীত মদ্যপান দণ্ডনীয় অপরাধ’ কথাগুলো লাল কালিতে পরিষ্কারভাবে মুদ্রিত থাকার বাধ্যবাধকতা থাকবে।”

একথা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, আমাদের দেশে আইনগতভাবে মুসলিমরা মদ গ্রহণ করতে পারেন না। তবে বিদেশীদের জন্য বৈধ পারমিট নিয়ে ব্যবসা করার অনুমতি রয়েছে। “মদ বিক্রির সুযোগ থাকছে লাইসেন্সপ্রাপ্ত হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট ও রেস্টুরেন্টের মালিক, ক্লাবের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক বা ব্যবস্থাপনা পরিচালক, অফ শপ অর্থাৎ মদ যেখানে শুধু বিক্রি হবে কিন্তু খাওয়া যাবে না এমনকি দোকানের যেকোনো বাংলাদেশি নাগরিকের কাছে।” তবে এই ব্যবসা করতে গিয়ে নানা ছল-চাতুরী ও কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে।

বিপুল অঙ্কের কর ফাঁকি দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় বিদেশ থেকে মদ আমদানি করার জন্য পাঁচ কন্টেনার মদ জব্দ করা হয়েছে এবং এজন্য পাঁচটি মামলা দায়ের করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। সুতা আমদানির ঘোষণা দিয়ে মদ আমদানি করায় জালিয়াতি ধরা পড়েছে।

মুসলিমপ্রধান দেশ হওয়ায় আমাদের দেশে মদের প্রচলন তেমন নেই বললেই চলে। তবে অন্যান্য মাদকদ্রব্যের ব্যবহারকারীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। অনেকে বলেন, দেশে অ্যালকোহল বা মদের ব্যবহার সহজ করে দিলে মাদকের বিস্তার কমবে তা মোটেই যুক্তিসংগত নয়। এছাড়া মুসলিমপ্রধান দেশে মদের ব্যবহার সহজ করার নির্দেশনা বা শিথীল আইন করা হলে সেটা হবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বা ইসলামের অবমাননা করা। তাই মদ অথবা মাদক উভয় ব্যাপারে এদশে কঠোর আইন প্রয়োগ করে সকল ধরনের মাদকদ্রব্যের বিস্তার নির্মূল করা ছাড়া অন্যকোন গত্যন্তর নেই।

মদ এমন একটি বস্তু যা বিবেককে আচ্ছন্ন করে ফেলে। আর বিবেক আচ্ছন্ন হলে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। এজন্য রাসূল (সাঃ) বলেছেন, মদ হচ্ছে সকল অশ্লীল কর্মের মূল। উল্লেখ্য যে, মদ কোন নির্ধারিত বস্তুর নাম নয়। যেসব বস্তু বেশি পরিমাণ খেলে বিবেকের ক্ষতি হয় তার অল্প বস্তুও মদ। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! নিশ্চয়ই মদ জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য নির্ধারক শরসমূহ শয়তানের অপবিত্র কর্ম। অতএব তোমরা এগুলি থেকে বেঁচে থাক। যাতে তোমরা কল্যাণ প্রাপ্ত হও। শয়তান তোমাদের মাঝে মদ ও জুয়ার মাধ্যমে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত করতে চায় এবং আল্লাহর যিক্র ও ছালাত থেকে তোমাদেরকে বিরত রাখতে চায়। তাহলে কি তোমরা বিরত থাকবে? (সূরা মায়িদাহ ৯০-৯১)।

ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘সব নেশাদার দ্রব্য মদ আর সব ধরনের মদ হারাম। যে ব্যক্তি সর্বদা নেশাদার দ্রব্য পান করে তাওবা বিহীন অবস্থায় মারা যাবে সে পরকালে সুস্বাদু পানীয় পান করতে পাবে না’ (মুসলিম ২/১৬৭ পৃষ্ঠা ‘মদ্যপান’ অধ্যায়, ‘সকল নেশাদার দ্রব্য হারাম’ অনুচ্ছেদে, মিশকাত হা/৩৬৩৮; বাংলা ৭ম খণ্ড)।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নেশাদার দ্রব্য পান করবে আল্লাহ তার ৪০ দিন ছালাত কবুল করবেন না। যদি এ অবস্থায় মারা যায় তাহ’লে জাহান্নামে যাবে। যদি তওবাহ করে তাহলে আল্লাহ তার তওবাহ কবুল করবেন। আবার নেশাদার দ্রব্য পান করলে আল্লাহ তার ৪০ দিন ছালাত কবুল করবেন না। যদি এ অবস্থায় মারা যায় তাহ’লে জাহান্নামে যাবে। আর যদি তওবাহ করে তবে আল্লাহ তার তওবাহ কবুল করবেন। আবার যদি নেশাদার দ্রব্য পান করে আল্লাহ তার ৪০ দিন ছালাত কবুল করবেন না। এ অবস্থায় মারা গেলে জাহান্নামে যাবে। তওবাহ করলে আল্লাহ তার তওবাহ কবুল করবেন। লোকটি যদি চতুর্থবার মদ পান করে আল্লাহ তাকে ক্বিয়ামাতের দিন ‘রাদাগাতুল খাবাল’ পান করাবেন। সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! ‘রাদাগাতে খাবাল’ কী? রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘আগুনের তাপে জাহান্নামীদের শরীর হতে গলে পড়া রক্তপূজ মিশ্রিত গরম তরল পদার্থ’ (ছহীহ ইবনু মাজাহ হা/ ২৭৩৮, সহীহ হাদীছ)।

উল্লিখিত বিষয়গুলো ছাড়াও এভাবে আরো অনেক জায়গায় ইসলামের ধর্মীয় বিধিনিষেধের মাধ্যমে মদ পানকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এরপরও আমরা নিষিদ্ধ দ্রব্যের প্রতি অনুরক্ত হয়ে শয়তানকে অনুসরণ করছি। নিষিদ্ধ দ্রব্যের ব্যবসা করার অনুমতি দিচ্ছি এবং সেই অনুমতি নিয়ে মিথ্যের বেসাতি সাজিয়ে আরেক জালিয়াতির মাধ্যমে নিজেকে ধ্বংস করছি ও অন্যদিকে কোটি কোটি টাকার কর ফাঁকির মাধ্যমে দেশের ক্ষতি করছি। এজন্য আমাদের সবার নৈতিক বোধদয় ও ইতিবাচক পরিবর্তন প্রয়োজন।

আমাদের দেশে মাদক ব্যবসার প্রকুতি ও ধরণ অনুসন্ধান করলে এরকম নানা অন্যায়ের প্রতিচ্ছবি চোখের মাসনে ভেসে উঠে। সামান্য কয়জন বিদেীকে বাদ দিলে দেশে এত মাদকের আমদানী হয় কেন? তাহলে জালিয়াতির মাধ্যমে দেশে ঢুকানো এসব হারাম দ্রব্যের ভোক্তা কারা?

আমাদের মজ্জায় ময়লা ঢুকে সয়লাব হয়ে গেছে। রক্ত, মাংস, শিরায় পাপাচার জমে মজ্জাগতভাবে কিছু জালিয়াত, বেঈমান ও অপরাধীচক্র সাধারণ মানুষের চরিত্র নষ্ট করে সামাজিক ভাঙ্গনকে ত্বরান্বিত করে তুলছে। ওরা মুসলিম হতে পারে না। এসব নামস্বর্বস্ব মুসলিম গোটা মুসলিম জাতির জন্য কলঙ্ক হয়ে আমাদের চারদিকে বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিচ্ছে।

এজন্য সকল লোভ-লালসা ত্যাগ করে সেবাদানকারীদের কর্মে একনিষ্ঠতা, নৈতিক দায়িত্ববোধ এবং কমিটমেন্ট প্রয়োজন। তাঁদেরকে সর্বচ্চো ত্যাগ দিয়ে আইনের কঠোরতায় এই অন্যায় কাজে প্রবিন্ধকতা তৈরি করে এটাকে সমূলে রুখতে হবে। অন্যথায় মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স শুধু মুখের কথা হয়ে সবাইকে অনন্তকাল উপহাস করতে থাকবে।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: fakrul@ru.ac.bd

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর