সরকারের ‘কৃচ্ছ্রতাসাধন নীতি’ সফল হোক

, যুক্তিতর্ক

শাহ্ ইসকান্দার আলী | 2023-09-01 12:27:27

সকল সরকারি কর্মকর্তাগণ তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যে এক রকম আচরণ এবং মানসিকতা পোষণ করেন না। তাদের মধ্যে যারা নিজ বাড়িতে মিতব্যয়ী, তারা সরকারি অফিসের অপচয় রোধ করেন, অপচয় রোধ করার কাঠামো উন্নয়ন করেন- তারাই সৎ ও দেশ প্রেমিক কর্মকর্তা।

একজন কর্মকর্তা সম্পর্কে জানা যায়, যিনি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে আসীন থেকেও তার সন্তানদের পাবলিক বাসে করে স্কুল-কলেজে পাঠিয়ে সুশিক্ষিত করেছেন। এ সৎ কর্মকর্তার অফিস জনসেবায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ্য ও পুরস্কৃত হয়েছেন। আরও একজন সরকারের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ পদের কর্মকর্তা যিনি সরকারী চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তার পেনশনের টাকায় কেনা ফ্লাটে সিলিং ফ্যানের স্থলে সম্প্রতি একটি এসি ব্যাবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাও তার স্কুল পড়ুয়া আদরের কন্যার রুমের জন্য। এসব কর্মকর্তাদের কাছে জাতি কৃতজ্ঞ।

আমাদের দুর্ভাগ্য যে, রাষ্ট্রের অধিকাংশ সরকারি কর্মকর্তাগণ জনগণের টাকায় বেতন ও সুবিধাদি নিয়ে নিজেদের হোমড়া-চোমড়া ভাবেন, তারা তাদের অধীনে থাকা রাষ্ট্রের সম্পত্তি বা অর্থ নিজের বা পরিবার কিংবা আত্মীয়স্বজনের প্রয়োজনে কাজে লাগাতে বেশি উৎসাহ বোধ করেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার সরকারি কেনাকাটায় অনিয়ম করেন, বিদেশে টাকা পাচার করে পরিবারের অধিক নিরাপত্তা ও আরাম-আয়েসের জন্য সেকেন্ড হোম বানিয়ে উন্নত দেশের নাগরিকত্ব নেন। তারা রাষ্ট্রের টাকা অপচয় করে অহেতুক বিদেশ ভ্রমণ করেন, অবসরের ১৫ দিন পূর্বেও অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে রাষ্ট্রের অর্থনাশ করে বিদেশ ভ্রমণ করা জনৈক কর্মকর্তার কথা পত্রিকান্তরে শোনা যায়। কর্মকর্তাদের কেউ কেউ রাষ্ট্র ও জনগণের বিপুল পরিমান টাকা তসরুপ করে পালিয়ে যান অন্য দেশে। দেশপ্রেমহীন অসৎ এসব সরকারি কর্মকর্তার দুর্নীতির বোঝা বইতে হয় দেশের নাগরিকের, বেকায়দায় পড়ে সরকার।

পেশাগত কাজে ১৯৯১ সনে বেনাপোল স্থলবন্দর গিয়েছিলাম। সেখানে এক ভারতীয় নাগরিকের দেশপ্রেম দেখে অবাক হই, তিনি একজন ড্রাইভার। আমদানিকৃত সুতা ভর্তি ট্রাক নিয়ে বেনাপোল সীমানায় ঢুকেছেন। আশেপাশে খাবার কিনে খাওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও তিনি তার দুপুরের খাবারের জন্য ভারত থেকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন একটি অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচি, প্লেট, দুটো কাঠের লাকড়ি, দিয়াশলাই, চাল, আলু ও রান্নার মসলা। তিনি কেবল বাংলাদেশে তিনটি ইট খুঁজে নিয়ে রান্না করে মধ্যাহ্নভোজন সারেন। যেন তিনি ভারতীয় একটা রুপি অন্য দেশে খরচ করতে নারাজ। তিনি ভরতীয় সচেতন নাগরিক, তিনি দেশ প্রেমিক বটে। বড় দেশ ভারত আমাদের  প্রতিবেশি। তাদের নাগরিকদের আচরণ ও সরকার ব্যবস্থাপনা থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি।

সম্প্রতি আরোপিত সরকারের রাষ্ট্রীয় কৃচ্ছ্রতা সাধন প্রচেষ্টা নীতি একান্ত অপরিহার্য ছিলো। ভারতে সরকারি কর্মকর্তাগণ সেদেশে তৈরি মারুতি ৮০০ সিসি গাড়ি এবং ডিজেল চালিত নিজেদের তৈরি অ্যাম্বাসেডর গাড়ি ব্যবহার করেন। অথচ আমাদের দেশে এর উল্টো চিত্র দেখা যায়।

ধানমন্ডি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল পাড়ায় প্রয়শই চোখে পড়ে রাস্তার পাশে পার্ক করা এসি চালু অবস্থায় অমুক মন্ত্রণালয়-তমুক মন্ত্রণালয়ের স্টিকারযুক্ত দামি গাড়ির সারি, যেখানে কর্মকর্তার সন্তানকে স্কুলে দিয়ে সরকারি ড্রাইভার সাহেব শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে লম্বা ঘুম দিচ্ছেন। এ অপচয় রোধ করতে হবে।

সরকারের প্রচেষ্টায় উন্নয়ন হয়েছে দেশের, উদ্বোধন হয়েছে স্বপ্নের পদ্মাসেতু। রাজধানীর সাথে স্বল্প সময়ে সংযোগের কারণে নিকটবর্তী হয়েছে প্রত্যন্ত ২১টির বেশি জেলা। যোগাযোগের উন্নতির ফলে মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে দেশের সম্পদের। সহজলভ্য হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে মাছ, শাক-সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর। সরকারের এ উন্নয়ন তখনি ফলপ্রুস হবে যখন নাগরিকরা দেশপ্রেম ও রাষ্ট্রের প্রতি তাদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে তারা সচেতন হবেন। পদ্মাসেতু খুলে দিয়েছে পর্যটন শিল্পের স্বপ্নের দুয়ার। পর্যটনের উদ্দেশ্যে দেশের অভ্যন্তরে নাগরিকদের যাতায়াত বৃদ্ধির জন্য সমুদ্র সৈকতসহ অন্যান্য স্থানে  পর্যটন শিল্প খাতে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।

পদ্মাসেতু খুলে দেয়ার ক’দিনের মধ্যেই পাল্টে গেছে  ভারতে কলকাতার পর্যটন শিল্পের চিত্র। পেট্রাপোল ও কলকাতা নিউমার্কেট এলাকায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছে বাংলাদেশি পর্যটক। সেখানে হোটেলের রুমভাড়া আকাশচুম্বী হয়েছে। হোটেলে আবাসন স্থান না পেয়ে ক’দিন ধরে রাস্তায় লাগেজের উপড় শুয়ে রাত কাটাচ্ছেন বাংলাদেশি পর্যটকরা। তারা দেদারছে খরচ করছেন বৈদেশিক মুদ্রা, পাচার হচ্ছে দেশি মুদ্রা। স্থানীয়ভাবে কলকাতায় দাম বেড়েছে ভারতীয় রুপির। দাম কমেছে বাংলাদেশি টাকার। বাংলাদেশি টাকার মূল্যমান ভারতীয় রুপির বিপরীতে কয়েকদিন পূর্বে ৮১% হলেও বর্তমানে তা নেমে দাঁড়িয়েছে ৭৩ % এ ।

তাই দেশের অর্থনীতির স্বার্থে নাগরিকদের সচেতন ও দায়িত্বশীল হওয়া জরুরি। সেইসাথে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে পর্যটন শিল্পের আর্থিক খাতের বৈষম্য কমাতে হবে। সরকারসহ ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের দেশের পর্যটন শিল্প উন্নতির নতুন পরিকল্পনা সাজাতে হবে। পাশাপাশি দেশি বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তা প্রদান এখন সময়ের দাবি।

এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের এই স্বাধীন স্বদেশ। মা, মাটি, প্রিয়তমা ও প্রজন্মের জন্য পতঙ্গের মতো আত্মাহুতি দিয়েছেন আমাদের বীরমুক্তিযুদ্ধাগণ। এ স্বাধীন দেশ আমার, আপনার, আমাদের সকলের। শুধু সরকারি কর্মকর্তা নয় আসুন প্রজন্মের স্বার্থে আমরা সকলে সচেতন হই।

সরকারের রাষ্ট্রীয় কৃচ্ছ্রতা সাধন নীতি সফল হোক, সচেতন হোক নাগরিক। দেশ ও জাতির স্বার্থে সকলের মধ্যে জাগ্রত হোক দেশপ্রেম ও বিবেকবোধ।

লেখক: শাহ্ ইসকান্দার আলী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর বার্তা২৪.কম, সহ-সভাপতি ফ্রন্টিয়ার রিপোর্টার্স সোসাইটি অব বাংলাদেশ

এ সম্পর্কিত আরও খবর