দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন

, যুক্তিতর্ক

কবির য়াহমদ | 2023-09-01 19:01:54

একদিনের মধ্যেই ভেসে গেছে পুরো সুনামগঞ্জ ও সিলেটের বিস্তীর্ণ এলাকা। মাত্র একদিনের বাড়তি পানিতে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বিদ্যুৎ সরবরাহ। বন্ধ হয়ে পড়েছিল মোবাইল সেবা, ইন্টারনেট সেবা। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ওসমানী বিমানবন্দরের ফ্লাইট উঠানামা। সড়ক পথে বন্ধ হয়ে পড়েছিল সুনামগঞ্জ। সবধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল দুই জেলার কোটি মানুষ।
 
সিলেট এমনিতেই দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল। এখানে ভূমিকম্পের শঙ্কা সবসময়, ভূমিধসে মানুষ মারা যায় নিয়মিত। বানে ভেসে যায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল। এবারও হয়েছে তাই। অতিবৃষ্টি ও উজানের ঢলে ভেসে গেছে পুরো এলাকা। এনিয়ে এবার তৃতীয়বারের মতো বন্যা আঘাত হানলো এই অঞ্চলে। প্রথম দফা বন্যায় বোরো ধানের ক্ষতি হয়েছে। দ্বিতীয় দফা বন্যা আঘাত হেনেছিল গত মাসে, এবং এবারের বন্যা তো ইতিহাস ধরে টান দিয়েছে।
 
গত মাসের বন্যায় বিদ্যুতের একাধিক উপকেন্দ্রে পানি ঢুকেছিল। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করতে হয়েছিল পুরো সুনামগঞ্জসহ সিলেটের অনেক এলাকার। এবার ফের বিদ্যুতে আঘাত। জাতীয় গ্রিডের কুমারগাঁও ১৩২/৩৩ কেভি উপকেন্দ্রে পানি ঢুকে বিপর্যস্ত  সিলেট-সুনামগঞ্জের বিদ্যুৎব্যবস্থা। এর প্রভাবে মোবাইল-ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ হয়ে যায়। লক্ষ-লক্ষ লোক যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতায় আদতে নিখোঁজ হয়ে যায়। এরপর সেনাবাহিনীর সহায়তায় অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা হয়। সেনাবাহিনী, সিটি করপোরেশন ও বিদ্যুৎ বিভাগের এই ব্যবস্থা সাময়িক, বলা যায় আপৎকালীন। ফের যদি আক্রান্ত হয় কুমারগাঁও উপকেন্দ্র, তবে কি ফের বন্ধ হয়ে যাবে বিদ্যুৎসহ সকল সেবা, তবে কি আপৎকালীন ব্যবস্থার দিকে যাবে বিদ্যুৎ বিভাগ? ইতিহাস তো তা-ই বলে, কারণ গতমাসের বন্যা থেকে শিক্ষা নেয়নি বিদ্যুৎ বিভাগ। শিক্ষা নিলে স্থায়ী সমাধানের পথেই যেত তারা। এই বন্যা আবার হুট করেই আসেনি। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জুনে আরেকটি বন্যার পূর্বাভাস দিয়েছিল। সেই পূর্বাভাস সকল পর্যায়েই রুটিন-নোটিস হিসেবে থেকেছিল। বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে মাঠপর্যায়ের প্রশাসন কেউ আমলে নেয়নি।

একদিনের মধ্যে সবকিছু ভাসিয়ে নেওয়ার পর জায়গায়-জায়গায় আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে, কিন্তু সেখানেও অব্যবস্থাপনা চোখে পড়েছে। খাবারের জন্যে হাহাকার করেছে মানুষ, হাহাকারের মধ্যেই আছে মানুষ। উদ্ধার তৎপরতায় তাৎক্ষণিক শুরু করা যায়নি। মানুষ ভেসে যাওয়ার পর এবং পানিবন্দি হয়ে দীর্ঘসময় আটকে থাকার পর সেনাবাহিনীর সহায়তা চাওয়া হয়েছে। সেনাবাহিনী কাজে নেমেছে। বিশাল এলাকার তুলনায় স্বাভাবিকভাবেই লোকবলের স্বল্পতা আছে ওখানে। প্রত্যন্ত অনেক অঞ্চলে পৌঁছাতে সময় লেগেছে স্বাভাবিকভাবেই। ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় দুর্গতদের জন্যে খাদ্য ও অর্থ সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, কিন্তু সেগুলো মানুষের কাছে পৌঁছাতে সময় লাগছে। অনেক জায়গায় খাদ্যগুদাম পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সময়মতো খাদ্যশস্য বের করে আনতেও সময় লেগেছে। দায়িত্বশীলদের বরাত দিয়ে আসা এসব গণমাধ্যমের খবর।

বন্যার সপ্তাহখানেক হতে চললো। সিলেট-সুনামগঞ্জের অনেক জায়গা থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। অনেক এলাকা নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ ফিরতে শুরু করেছে, ফিরেছে অনেক জায়গায়। মোবাইল টাওয়ারগুলোর অধিকাংশ সচল হয়েছে। ইন্টারনেট পরিষেবা চালু হয়েছে। আক্রান্ত এলাকার মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় ত্রাণ কার্যক্রম চলছে, চলছে বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে পরিচালিত ত্রাণ কার্যক্রম। এরইমধ্যে মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেট সফর করে গেছেন। হেলিকপ্টার থেকে তিনি এই দুই এলাকাসহ নেত্রকোনার বন্যা পরিস্থিতি পরিদর্শন করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের পর আশা করা যায় সরকারি পর্যায়ে পরিচালিত ত্রাণ কার্যক্রমের গতি বাড়বে। সঙ্গে বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগের কার্যক্রম তো আছেই।
 
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন কেবল বন্যার সময়েই নয় সবসময় তার সরকার ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে থাকবে। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা হবে বলেও জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তার এই বক্তব্য আশাব্যঞ্জক, একইসঙ্গে সতর্কতার প্রয়োজন কারণ যারা তালিকা করবে তারা সঠিক লোকদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করছে কি-না এটাও তদারকির দাবি রাখে। জনপ্রতিনিধিরাই সর্বশেষ আশ্রয় মানুষের, জনপ্রতিনিধিরাই আবার সর্বশেষ আস্থার জায়গাও নয় মানুষের; এখানে তারা জবাবদিহির আওতায় না থাকলে সরকারপ্রধানের সৎ ইচ্ছার সলিল সমাধিও হতে পারে!

দেশের নানা দুর্যোগ-দুর্বিপাকে সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরাও এগিয়ে আসেন। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তবে এখন পর্যন্ত যে খবর মিলছে তাতে দেখা যাচ্ছে সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত অনেক এলাকায় ত্রাণ পৌঁছায়নি এখনও। দিরাই, শাল্লা, দোয়ারাবাজার, জগন্নাথপুর, তাহিরপুরসহ অনেক এলাকায় সরকারি ত্রাণ যেমন উল্লেখযোগ্যভাবে পৌঁছায়নি তেমনি পৌঁছায়নি বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে পরিচালিত ত্রাণ। এমনিতেই দরিদ্র এবং মৌসুমি দারিদ্রের আঘাতে জর্জর মানুষদের বেশিরভাগই তাই অভুক্ত, সুপেয় জলের অভাবে পিপাসার্ত। এমন অবস্থা চলতে থাকলে সেসব এলাকায় মানবিক বিপর্যয় নেমে আসবে। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে রোগে-শোকে প্রাণ হারানোর উপক্রম হতে পারে অনেকের।

কেবল সিলেট-সুনামগঞ্জেই নয় এবারের বন্যা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের অন্য অঞ্চলেও। শুরুতে নীরব থাকা জাতীয় পর্যায়ের গণমাধ্যম এখন ব্যস্ত কেবল সিলেট-সুনামগঞ্জ নিয়েই। বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগ এখনও সীমাবদ্ধ এ অঞ্চলেই। এদিকে, অন্য অঞ্চলগুলোও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে। আলোচনা যেখানে সেখানে সরকারি উদ্যোগগুলোও। এমন অবস্থায় মানবেতর অবস্থায় পড়তে যাচ্ছেন অন্য এলাকার বন্যাদুর্গতরাও। তাদের দিকেও দৃষ্টি দেওয়া জরুরি।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ বিশ্বে রোলমডেল- এমন একটা প্রচারণা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু এবারের বন্যা পরিস্থিতি এই প্রচারণার অন্তঃসারশূন্যতা দেখিয়ে দিলো। বারবার বন্যা আঘাত হানার পরেও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের বিকল্প ব্যবস্থা নেই এটা এবার প্রমাণ হলো। বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় বন্ধ হয়ে গেল সিলেটের সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা। চিকিৎসার মতো মৌলিক এবং অতি-আবশ্যক সেবা এভাবে বন্ধ হয়ে পড়ায় মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়া সত্ত্বেও যেন কিছুই করার নেই কর্তৃপক্ষের! মোবাইল-ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লাখ-লাখ মানুষ নিমিষেই সকলের যোগাযোগের বাইরে চলে গিয়ে কেমন নিখোঁজ হয়ে গেল! ডিজিটাল বাংলাদেশের এমন হাল স্রেফ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা, অযোগ্যতার কারণেই নয় কি? সিলেট-সুনামগঞ্জ পরিস্থিতিতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না ঠিক, তবে সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন এঁকে দিয়েছে!
 
এই বন্যা আমাদের অনেক কিছু নিয়ে গেছে। আস্থার পরিবেশকেও দোদুল্যমান করে দিয়ে গেছে। এতকিছু সত্ত্বেও এটা যদি আমাদের শিক্ষণীয় হয় তবে এখান থেকে ইতিবাচক কিছু মিলতেও পারে। বন্যা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রকে যদি মেঠোবক্তৃতার দাবি থেকে সরিয়ে এনে সত্যিকার বাস্তববাদী করে তবে এখান থেকেও আসতে পারে ভালো কিছু। সরকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব দিক- আশা এটুকুই!

সিলেট-সুনামগঞ্জের বন্যার ছবি দেখে আমার ছেলে রাইআন বলে- পুরো সিলেট নদী হয়ে গেছে। উঠানের পানি দেখে তার বিস্ময় ও প্রশ্ন- কাল বৃষ্টি হলো না তবু এত পানি কেন। পানিগুলো সেচের মাধ্যমে সরিয়ে দিতে আবদার তার। সে অনুমানই করতে পারে না বানের পানি সেচে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব না। তার দাবি- পানি সরাতে হবে, আমাদেরকে বাঁচতে হবে, আমরা না বাঁচলে দেশের মানুষকে বাঁচাবো কীভাবে? আমার কৌতূহলী প্রশ্ন তার কাছে- আমরা সবাইকে বাঁচাবো কীভাবে? বয়সে আট রাইআন বলে- মানুষকে খাবার দিয়ে, থাকার জায়গা দিলে বাঁচানো যাবে। ছোট্ট রাইআনও বুঝতে পারে এই মুহূর্তে মানুষের দরকার আশ্রয় আর খাবার। রাষ্ট্রও বুঝে, তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় কিছুটা দেরি করে!  

কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর